ভারতবর্ষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে ধর্ম নিষিক্ত। তার সনাতন ইতিহাস আধ্যাত্মিক ফল্গুধারার স্রোত। কার্যত অধ্যাত্মবাদ ও ধর্মই ভারতের আদি ও চিরন্তন নিয়ন্ত্রক। প্রাত্যহিক ক্রিয়া, আনুষ্ঠানিক আচার আচরণ, ধ্যানধারণা সংস্কৃতি, জন্মের পূর্ব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ভারতীয় জীবন ধারায় অধ্যাত্মবাদ তথা ধর্মের অপরিসীম প্রভাব লক্ষণীয়। ১২০০ বছর আগে আদি শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব সনাতন হিন্দু ধর্মকে সার্বিক পতন থেকে রক্ষা করে এবং ভারতের ধর্মীয় ও সামাজিক আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর ঐশী সত্ত্বায় জ্ঞান ভক্তি ও কর্মের অপরূপ ত্রিবেণী সঙ্গম রচিত হয়েছিল। কী বেদ, কী ভগবদ্গীতা, কী বেদান্ত দর্শন— সর্বত্র ছিল তাঁর অপ্রতিহত গতি, অবাধ বিচরণ। যা একবিংশ শতাব্দীর মানুষের মধ্যেও গভীর বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছে। তাই আদি শঙ্করাচার্যকে সনাতন হিন্দু সমাজ স্বীকার করে নিয়েছে ভগবান শঙ্করের অবতার রূপে।
বিশ্ববরেণ্য এই অবতার পুরুষের আবির্ভাব ঘটে কেরলের কালাডি গ্রামে। পিতা শিবগুরু ও মাতা আর্যাম্বা। মাত্র আট বছরে সমস্ত শাস্ত্রে তিনি অসামান্য পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তাঁর অপরূপ শাস্ত্র ব্যাখ্যায় মুগ্ধ হতেন সমগ্র গ্রামবাসী। একদিন নদীতে স্নানকালে বালক শঙ্কর কুমিরের মুখে পড়েন। কুমিরটি তার পা কামড়ে ধরে। তাঁর আর্ত চিৎকারে গ্রামবাসীরা নদীতীরে চলে আসে এবং অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে কুমির কবলিত শঙ্করের দিকে। কিন্তু অকুতোভয় শঙ্কর ক্রন্দনরতা মাকে বলেন, “মা তুমি আমায় সন্ন্যাসের অনুমতি দিলে কুমির আমায় মুক্তি দেবে, নয়তো মৃত্যু অনিবার্য। উপায় বিহীনা আর্যাম্বা শঙ্করকে অনুমতি দিলেন সন্ন্যাসের। কিন্তু সে সময় কোনও ধর্মগুরু, পণ্ডিত বা সাধক শঙ্করকে আনুষ্ঠানিক সন্ন্যাস ও দীক্ষা দিতে রাজি হলেন না। উপরন্তু শুরু করলেন তাঁর ব্যাপক সমালোচনা। অনিবার্যভাবে শঙ্কর গ্রাম ত্যাগ করলেন এবং বহু পথ অতিক্রম করে নর্মদার তীর ধরে এগিয়ে চললেন। নর্মদার তীরে ওঙ্কারেশ্বরে এক গিরিগুহায় তিনি দর্শন পেলেন তাঁর আদিষ্ট গুরু মহাযোগী গোবিন্দপাদের।
তীব্র সাধনায় তিনি হন আপ্তকাম। শুরু হয় তাঁর কর্মযজ্ঞ। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সমগ্র ভারতবর্ষ তিনি পদব্রজে ভ্রমণ করেন এবং অদ্বৈতবাদের ব্যাখ্যা ও প্রচার করেন। অত্যন্ত দক্ষতা ও ঐশী প্রতিভার সাহায্যে হিন্দু ধর্মের উপর সমস্ত আক্রমণ ও অপপ্রচারের মোকাবিলা করেন। শঙ্করই সুপ্রাচীন ‘স্বামী’ নামক সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে পুনর্গঠিত করে দেশের চারপ্রান্তে চারটি বিখ্যাত মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে মঠ স্থাপনের পশ্চাতে ছিল এক ঐক্যবদ্ধ ও অখণ্ড ভারতের রূপকল্পনা। নানা ধারণা মত ও গোষ্ঠী এবং নানা সম্প্রদায়ের বসবাস হলেও আমরা একই পরিবারভুক্ত, সমগোত্রীয়। আমাদের সকলের ভাগ্য এক এবং তা অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি নিছক এক ধর্মপ্রবক্তা নন। সর্বধর্মের মধ্যে যে এক ও অন্তনিহিত সত্য আছে, তাকেই তিনি প্রচারের প্রতিপাদ্য বিষয় করেছেন। তাঁর আবেদন ছিল, বিশ্বজনীন। প্রায় ১২০০ বছর আগে তিনি যে মঠ স্থাপন করেছিলেন, তা আজও সমানভাবে সক্রিয়। এই মঠগুলির অধ্যক্ষবৃন্দ ভাববাদী পরম্পরায় ‘জগদগুরু শঙ্করাচার্য’ উপাধি ধারণ করে থাকেন। চার মঠ ছাড়া আরও একটি মঠ আছে তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরমে, যা কাঞ্চিমঠ নামে প্রসিদ্ধ। কথিত আছে, আদি শঙ্কর তাঁর বাসস্থানের জন্য এই মঠের পত্তন করেছিলেন। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে।
মঠগুলির মধ্যে আদি শঙ্করের জীবনে কাঞ্চিমঠের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। কারণ কাঞ্চিপুরমস্থ কাঞ্চিমঠের আরাধ্য দেবী হলেন ভগবতী রাজ রাজেশ্বরী ত্রিপুরাসুন্দরী মাতা। ত্রিপুরাসুন্দরী আদতে ছিলেন শঙ্করের ইষ্টদেবী। যদিও দশ মহাবিদ্যায় দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর স্থান তৃতীয়, তবুও ত্রি অর্থাৎ তিন, পর অর্থে পুরাতন, সুন্দরী। অর্থাৎ কালী, তারা ও ত্রিপুরা এই তিন সুন্দরীর মধ্যে তিনি প্রাচীন। মতান্তরে ইনি হলেন মহালক্ষ্মী, নামান্তরে কোথাও কামাক্ষী, মীনাক্ষী, কন্যাকুমারী, মধুরাকালী, হংসেশ্বরী ইত্যাদি। মাতা ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্ত্রের নাম হলো ‘শ্রী-যন্ত্র’। সাধক কুলের কাছে এই মন্ত্রের সাধনা হলো শ্রেষ্ঠ বৈদান্তিক সাধনা। শ্রীযন্ত্রের সাধনার ফলে সাধকের লাভ হয় ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ এই চতুর্বর্গ।
শঙ্কর কাঞ্চিপুরমে কামাক্ষী দেবী মন্দিরে তাঁর এই ইষ্টদেবীর দর্শন লাভ করেন এবং মায়ের আদেশে শ্রীযন্ত্রের পূজা প্রচলন করেন। মায়ের দর্শন লাভে মোহিত হয়ে তিনি আবৃত্তি করেন জগদ্বিখ্যাত সৌন্দর্যলহরী স্তোত্র। কথিত যে এই স্তোত্র স্বয়ং দেবাদিদেব মহেশ্বর কৈলাসে শঙ্করকে দিয়েছিলেন।
শঙ্কর পরিক্রমাকালে কোনও দেবতার মন্দিরে উপস্থিত হলে প্রণাম করতেন না বিগ্রহকে। কেবল হস্তধৃত দণ্ড দ্বারা দেবতার ফলককে স্পর্শ করতেন। কিন্তু দেবী মন্দিরে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সাষ্টাঙ্গে দেবীকে প্রণাম করে ‘শ্রী-যন্ত্র’ স্থাপন করে নব আবরণের পূজা করতেন। যুক্তি ছিল তাঁর, শক্তি ব্যতীত শিব অচল। শিব শব্দ থেকে ‘ই’কে যদি সরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে শবে পরিণত হয় তা। ‘ই’ শক্তির প্রতীক। তাই সমস্ত দেশ ও জাতির কথা চিন্তা করে তিনি পঞ্চায়তন পূজার নির্দেশ দিলেন। কোনও কোনও মতে ষষ্ঠায়তন পূজা। শক্তম (শক্তি), শৈবম (শিব), বৈষ্ণব (বিষ্ণু), সূর্যনারায়ণ (সৌর), গাণপত্য (গণপতি) প্রভৃতি পঞ্চ উপাসনা পদ্ধতিকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেন। ষষ্ঠ আরাধনা হলো সুব্রহ্মণ্য বা কুমার কার্তিকের আরাধনা।
আজীবন মাতৃভক্ত শঙ্কর বিশ্বাস করতেন লৌকিক পিতা-মাতার ভক্তি ও সেবা থেকেই সমস্ত সেবার সূত্রপাত এবং অচলা গুরু সমর্পণে তার সমাপ্তি। সুতরাং মাতা-পিতাকে ব্যতীত কোনও ভক্তি, সেবা বা অর্চনা দেবতার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। সনাতন হিন্দু ধর্মের সংস্কারে তিনি যে অসাধারণ মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তা অতুলনীয়। ধর্মের অপ্রয়োজনীয়, অবাস্তব, স্থূল খোলসকে ভেঙে ধর্মের সারবস্তুকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। ফলে তাঁর দর্শনে একটা সুস্পষ্ট, সম্পূর্ণতা গড়ে উঠেছে। যা আজও রয়েছে অবিকৃত, অম্লান তাঁর প্রয়াণের বারশো বছর পরেও।
(আদি শঙ্করাচার্যের জন্মতিথি উপলক্ষে প্রকাশিত)
ডাঃ সমীর কুমার চট্টোপাধ্যায়