সনাতনী শব্দটি তো দূরের কথা, হিন্দু শব্দটি শুনলেই যাদের ভ্রু কুঁচকে উঠে, অন্তঃসারশূন্য সেকুলারিজম মাথাচাড়া দিয়ে আমাকে আপনাকে সাম্প্রদায়িকতার দোষে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে উদ্যত হয়, নিজের সুপ্রাচীন ঋদ্ধ ঐতিহ্য বিমুখ সেইসব মানুষেরা “হিন্দু রসায়নী বিদ্যার” লেখক কে কি আখ্যায় ভূষিত করবেন?
শিক্ষায় সামান্যরূপে পাশ্চাত্য যোগ থাকলেই যেখানে অনেকেই তথাকথিত সেকুলারিজমের নামে হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে আত্মপ্রসাদ লাভের সস্তা ও মেকি প্রচেষ্টায় নিজেকে নিমগ্ন করে তোলেন, সেখানে রসায়নে তাঁর কৃতিত্বের জন্য নাইট উপাধি ও মাস্টার অফ নাইট্রাইট উপাধিতে ভূষিত, পাশ্চাত্য থেকে ডিএসসি প্রাপ্ত, মারকিউরাস নাইট্রাইটের আবিষ্কর্তা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সনাতনী সভ্যতার সুপ্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য কে তুলে ধরলেন A History of Hindu Chemistry এর প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড রচনার মাধ্যমে। ধাতু সঙ্কর তৈরিতে প্রাচীন ভারত যে অগ্রণী ছিল; চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতায় উল্লেখিত অস্ত্রোপচারের সূক্ষ্মাগ্র যন্ত্র যেমন স্ক্যালপোল বা ল্যানসেট ছিল তার প্রমাণ।প্রকৃত ইতিহাস বিমুখ আত্মবিস্মৃত জাতির আপন সুপ্ত গরিমা পুনরুত্থানের এই মহতি প্রচেষ্টা চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
মানব জীবনের অপরিহার্য আধ্যাত্মিক প্রবণতা কে ক্ষেত্রবিশেষে (শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে) নিজেদের তোষণমূলক রাজনীতির স্বার্থে অস্বীকার করে চলা বামাতি জেহাদিদের উদ্দেশ্যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জীবনের একটি ছোট্ট ঘটনা উল্লেখ করবো। আচার্য আমন্ত্রিত হয়ে, প্রাচীন কালের হিন্দু রসায়ন চর্চার উপর লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সেই হলে একজন বিলেত থেকে সদ্য আসা ইংরেজ অধ্যাপকও ছিলেন। প্রাচীন যুগে মাটির ভান্ড ব্যবহার করে কিভাবে বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে পাতন ইত্যাদি প্রক্রিয়া দ্বারা রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করা হত, আচার্য রায় বোর্ডে সে-সব যন্ত্রপাতির ছবি এঁকে বর্ণনা করছিলেন। সেই সময় ঐ ইংরেজ অধ্যাপক তাচ্ছিল্যভাব দেখিয়ে হাসাহাসি করছিলেন, এবং এই ঘটনা আচার্যের নজর এড়ায়নি। তিনি বক্তৃতার ঐ অংশটি শেষ করে, কিছুটা মকরধ্বজ হাতে নিয়ে ঐ অর্বাচীন ইংরেজ অধ্যাপকের কাছে গিয়ে মকরধ্বজের গুনগান করলেন। দুহাজার বছর পূর্বে তা কিভাবে প্রস্তুত করা হত এবং কিভাবে সেই একই পদ্ধতিতে তা আজও প্রস্তুত করা হয় এবং কেন অনেক ইউরোপীয় চিকিৎসকই তা ব্যবহার করে থাকেন, তার সবিস্তার ব্যাখ্যা দিয়ে আচার্য বললেন,”বন্ধুগণ, আজ হতে দু’হাজার বৎসর পূর্বে সেকেলে যন্ত্রপাতির সাহায্যে ভারতবাসীরা এই অপূর্ব ঔষধ প্রস্তুত করে মানবের কল্যাণার্থে ব্যবহার করেছেন, রোগে শান্তি দিয়েছেন– এখনকার উন্নততর যন্ত্রপাতির সাহায্যেও এর চেয়ে বিশুদ্ধ resublimed mercuric sulphide তৈরি হয়নি। হিন্দুরা সামান্য মাটির ভান্ডে এরূপ বিশুদ্ধ রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি করেছিলেন কোন সময়ে- হাজার বছরেরও বেশি পূর্বে, যখন আমার ঐ বন্ধুটির (ইংরেজ অধ্যাপককে দেখিয়ে) পূর্বপুরুষেরা পশুচর্মে লজ্জা নিবারণ করতেন এবং বন্য ফল খেয়ে জীবন ধারণ করতেন।” আচার্য রায়ের এই কথা শোনার পর হলের শ্রোতারা করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানালে, ইংরেজ অধ্যাপকটি লজ্জায় হল ছেড়ে পালিয়ে যান।
কর্মবীর, রসায়নবিদ, বিজ্ঞান শিক্ষক, দার্শনিক, কবি, প্রখর জাতীয়তাবাদী — এই বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী আচার্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন স্বাবলম্বন অর্জনের পথে মূল অন্তরায় টি কে। মধ্যযুগীয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের ব্যাপক প্রভাবে প্রাচীন যুগের উন্নত চিন্তাভাবনার দ্বার ক্রমেই রুদ্ধ হয়েছে। দু’টাকার কেরানিগিরিতেই মেকি বিপ্লবী চক্র শুরু ও শেষ হওয়া অলস কর্মবিমুখ বাঙালী কে কলম পেষার চেয়ে ব্যবসা করে উন্নতির শিখরে পৌছানোর রাস্তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। স্বদেশ ভাবনা, আত্মবিশ্বাস আর মাত্র আটশো টাকা মূলধন নিয়ে ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস্। বাঙালীকে আত্মনির্ভর হওয়ার পথ দেখালেন। আচার্য বললেন–“পরাধীন জাতির বিদেশী দ্রব্য ব্যবহারে বাবুগিরি করিতে লজ্জা পাওয়া উচিত।” আজ সমাজ বিদেশী পণ্যের প্রতি উদগ্র চাহিদায় নিমগ্ন, বিকৃত বস্তুবাদী চার্বাকদর্শন সনাতনী ঐতিহ্যকে প্রতিনিয়ত হেয় করতে উদ্যত। ঠিক এই প্রেক্ষিতেই প্রায় একশো বছর পরেও আচার্যের আত্মত্যাগময় অত্যন্ত সরল জীবনযাপন, উচ্চ চিন্তার ভাবাদর্শ ও নিরলস কর্মশক্তি আজও যুগোপযোগী এবং একশো শতাংশ প্রাসঙ্গিক। সনাতনী ঐতিহ্যের তত্ত্বগত পথ, মিনিমালিজম্ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের জীবন দর্শন হউক আমাদের পাথেয়। আগামী ২রা আগস্ট আচার্যের পূন্য জন্মতিথিতে, তাঁর জীবনালোকে দূরীভূত হউক আমাদের আত্মবিস্মৃতির আঁধার।
ডঃ তরুণ মজুমদার (Dr. Tarun Majumdar)