ওদের গায়ে বারুদের গন্ধ…
~ জান মা, বা কউথিলে আজি লুয়া কপড়া আনতে জিবে। উঁইছুন বাহরি পড়মি?
(জানো মা, বাবা বলেছিলেন আজকে নতুন কাপড় আনতে যাবেন। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়বো?)
~ মু কই পারমি নি। তোর বার মন মেজাজ ভালা নাই দুইপর নু।
(আমি বলতে পারবো না। তোর বাবার মেজাজ ভালো নেই দুপুর থেকে।)
রাজীব মান্ডি রাস্তার পাশে মাঠের ধরে একটা বাঁশের বেঞ্চে বসে বিঁড়ি টানছিল। মেদিনীপুরের সদ্য বন্যায় চাষাবাদ গেছে নষ্ট হয়ে। তবে আশার আলো ছিল কালীপূজা। কিন্তু আজকেই টিভিতে যা খবর দেখলো…
কয়েক পুরুষ ধরে বাজি বানায় তারা। ওর যখন মরদ বয়স, বাজি বানানোর সময় বামুনপাড়া থেকে কত বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো দেখতে আসতো তার কাজ। গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার রঞ্জিত ভট্টাচার্যমশাই একবার কালীপূজায় ওর হাতের কাজ দেখে আশীর্বাদ করে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এত অভাবেও সেই টাকা সে খরচ করেনি। এই শিল্পের কদর কজন বোঝে? হতে পারে সে গরীব। কিন্তু দিনের শেষে সে একজন শিল্পী। বড় বড় পুজোয় যখন তার হাতের কাজ আকাশের অন্ধকার ভেদ করে আলো ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে, গর্বে একটু হলেও বুকটা ফুলে ওঠে তার।
কিন্তু, আজকে যে শুনলো সে সবকিছুই ব্যান করে দিয়েছে নাকি! এত টাকার ক্ষতি আর সামলাতে পারবে না সে। চাষ গেছে, এবার কি এটাও… না না। আর ভাবতে পারছিল না সে। মেয়েটাকে কথা দিয়েছিল নতুন কাপড় এনে দেবে।
আজ অনেক ধকল গেছে কোর্টে। একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মামলা ছিল। পরিবেশ সচেতন হিসেবে নানা মহলে চন্দ্রবাবুর বেশ নাম আছে। বছরে দুই তিনবার প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে বৃক্ষরোপনও করতে যান তিনি। তাই বাজি ব্যানের পক্ষে রায় দিতে একবারও অন্যকিছু মাথায় আসেনি তাঁর।
এসির দ্বারা টেম্পারেচারটা একটু কমিয়ে দিয়ে চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বসলেন ফ্রিজ থেকে একগ্লাস পানীয় নিয়ে। দায়িত্ববান পরিবেশপ্রেমী নাগরিক তিনি।
বিঃদ্রঃ ঘটনার স্থান কাল পাত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত ও মৃত কারোর সঙ্গে মিল থাকলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয়।
প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষ রোজগারের আশায় তাকিয়ে থাকে দীপাবলির দিকে, কালীপূজার দিকে। এই টাকায় হয়তো বছরের প্রথমবার ওদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের গায়ে উঠবে নতুন জামা, দুটো ভালো খাবার মুখে দেবে বাচ্চাগুলো। কিন্তু, মহামান্য কোর্ট এবং ‘রোশনী আলী’দের মতো ধনীদের কৃপায় তা হয়তো আর হবে না। অন্ধকারেই দিন কাটবে ওদের।
কিন্তু মাত্র তিরিশ লক্ষ গরীব বাজি ব্যবসায়ীদের জীবনের কতটুকু মূল্য আছে বলুন? সব মিলিয়ে কোর্টের বিচারপতির বাড়ির এসিগুলোর মূল্যের সমান হবে? না বোধহয়। রোশনী আলীদের বাড়ির দামী ফ্রিজটার দাম, পার্সোনাল কারের দাম কি ওই তিরিশ লক্ষ বাজি ব্যবসায়ীদের জীবনের দামের চেয়ে কম? মোটেও নয়।
এই দেশের আইন ধনীদের হাতের মোয়া। এলিটদের পোষা প্রাণী। এই দেশে ‘রোশনী আলী’রা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক।
বারুদের গন্ধ মাখা কালো কালো দেখতে ছেঁড়া পোশাক পরা বাজি ব্যবসায়ী তিরিশ লক্ষ রাম মন্ডল, রতন হাঁসদাদের জন্য আইন আদপেই বামনের চাঁদ। 😊
কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের পর বাজি ব্যবসায়ীদের মনেও অনিশ্চয়তার তৈরি হয়েছিল। তবে আজ সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, বাজি ফাটানো পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। পরিবেশবান্ধব বাজি ফাটানো যাবে। শীর্ষ আদালতের এই রায়ের পর খুশি দক্ষিণ ২৪ পরগনার নুঙ্গীর বাজি ব্যবসায়ীরা। চলছে মিষ্টিমুখের পালা।
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, তাঁরা যে টাকা দিয়ে পরিবেশবান্ধব বাজি কিনেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাঁদের ব্যবসাটা বেঁচে গেল। সেই আনন্দেই নুঙ্গী বাজি বাজারে আজ চলছে মিষ্টি খাওয়ানোর পর্ব। একইসঙ্গে পথচলতি সাধারণ মানুষদের কাছেও তাঁদের অনুরোধ, শুধুমাত্র পরিবেশবান্ধব বাজিই যেন তাঁরা ফাটান। বাজি ব্যবয়াসীদের অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকেও স্পষ্ট বলা হয়েছে, নুঙ্গী বাজি বাজারে পরিবেশবান্ধব বাজি ছাড়া আর অন্য কোনও বাজি বিক্রি করা হবে না।
নুঙ্গী বাজি বাজারের এক ব্যবসায়ী পীয়ূশ মৈত্র জানিয়েছেন, আমরা এতদিন ধরে ভয়ে ভয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম, বাজিগুলো নিয়ে এবার হয়ত জলের মধ্যে ফেলে দিতে হবে। আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম, আমরা ভেবেছিলাম, আর বাজি বিক্রি করতে পারব না। তাহলে সব শেষ হয়ে যেত। এমনিতেই আমরা কিছু না কিছু বন্ধক দিয়ে চালাচ্ছি। আজ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আমরা সত্যিই খুব খুশি। সুপ্রিম কোর্টকে আমরা ভগবানের চোখে দেখছি। পরিবেশের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, এমন বাজি তৈরির দিকে আমরা আরও জোর দেব।” তাঁদের আশা, আজকের মতো আগামী দিনেও আইন এবং রাজ্য সরকার তাঁদের পাশে দাঁড়াবে।
আতসবাজি ব্যবসায়ী সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা সুখদেব নস্কর জানিয়েছেন, ছোট ব্যবসায়ী যাঁরা আছেন, তাঁরা এখন পরিবেশবান্ধব বাজি তৈরি করেছেন। বেরিয়ামকে বাদ দিয়ে বাজি তৈরি করায় জোর দেওয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, আতসবাজি নিয়ে হাইকোর্টের রায় আজ খারিজ হয়ে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্টের দাবি, পরিবেশ বান্ধব বাজি বিক্রি করা হোক। পরিবেশ বান্ধব বাজিই বিক্রি হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে। তবে সব বাজি নিষিদ্ধ, এমনটা হতে পারে না বলেই মত শীর্ষ আদালতের। কালী পুজো ও দীপাবলীতে কোনও ধরনের বাজিই ফাটানো যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। হাইকোর্টের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিল আতসবাজি উন্নয়ন সমিতি। বিচারপতি এনএম খানউইলকর ও বিচারপতি অজয় রাস্তোগীর বেঞ্চে আজ ছিল সেই মামলার শুনানি।
সুপ্রিম কোর্ট আগেই জানিয়েছিল, পরিবেশের পরিস্থিনি অনুকূল থাকলে পরিবেশ বান্ধব বাজির ক্ষেত্রে কোনও বাধা থাকবে না। সেই নির্দেশ সব রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য বলে জানিয়েছে শীর্ষ আদালত। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও সেই নিয়ম মানতে হবে বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাজি নিয়ে হাইকোর্টের আলাদা রায়ে অখুশি সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট এ দিন বলে দিয়েছে, রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের আদেশ না মানলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুপ্রিম কোর্ট আগেই বাজি সম্পূর্ণ বন্ধ করার নির্দেশের বিরোধিতা করেছিল, আজ আবার সে কথাই মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
লেখক : অর্নব কুমার দাস