প্রথমেই বলে রাখা ভালো, জম্মু ও কাশ্মীরের দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের পক্ষ থেকে একটা ভুল তথ্য প্রচার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে যে, ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা এবং আজকের ভারতীয় জনতা পার্টির আদিপুর ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জম্মু ও কাশ্মীরে বিশেষ সাংবিধানিক আইনবলে সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ ধারা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে অন্যতম উদ্যোগী পুরুষ ছিলেন। এমন কথাও প্রচার করা হচ্ছে যে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীন সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রিসভার শিল্প ও সরবরাহ দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে ড. মুখোপাধ্যায় ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরে ‘স্পেশাল স্ট্যাটাস’ বলবৎ করার ক্ষেত্রে অন্যতম অগ্রণী এবং বল্লভভাই প্যাটেল, শেখ মহম্মদ আবদুল্লা, আফজল বেগ, মতিরাম বেগদার মতো তৎকালীন সময়ের আলোচক এবং সহিকারকদের অন্যতম। কিন্তু ন্যাশানাল কনফারেন্সের এই বিবৃতি পুরোপুরি সঠিক নয় এবং সত্য যা তা হলো জম্মু ও কাশ্মীরে বিশেষ সাংবিধানিক আইন প্রয়োগের ব্যাপারে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই ছিলেন সবচেয়ে কট্টর সমালোচক এবং তিনিই প্রথম বলেছিলেন, একই রাষ্ট্রের অধীনে দুটি রাষ্ট্র এবং দুটি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারেন না। তিনি একথাও বলেছিলেন, হিন্দু অথবা মুসলমান—সবাই ভারতবর্ষের নাগরিক সুতরাং সেক্ষেত্রেও বিশেষ আইনবলে একটি প্রদেশের একাংশকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়াটা শুধু বেআইনি নয়, অনুচিতও। ইতিহাসকে ভুলে গেলে চলবে না যে কাশ্মীর ছাড়া অন্যান্য প্রদেশের নাগরিকদের কাশ্মীরে প্রবেশের আগে বিশেষ অনুমতি নেওয়ার জন্য জওহরলাল নেহরু যে আইন প্রবর্তন করেছিলেন, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই প্রথম তার বিরোধিতা করেন এবং অনুমতি ছাড়াই কাশ্মীরে প্রবেশ করে গ্রেপ্তার হন। সেখানেই লোকচক্ষুর অন্তরালে পাহাড়ি জঙ্গলে একটি কুটিরে তাকে আটকে রাখা হয় এবং কাশ্মীরেই রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় তাঁর।
একথা পরিষ্কার হওয়া দরকার — জম্মু-কাশ্মীরের জন্য বিশেষ আইনে সম্মতিপ্রদানকারীদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্মতি দিয়েছিলেন তখনই যখন আইনটিকে সাময়িকভাবে বলবৎযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। সংবিধানের ২১ ভাগে ‘অস্থায়ী, অন্তর্বর্তীকালীন ও বিশেষ বিধানসমূহ’শীর্ষক পরিচ্ছেদে স্পষ্টতই উল্লেখ করো হয়েছে। যে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করে আইনটি সাময়িকভাবে ও অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এমনকী সে সময় স্বয়ং জওহরলাল নেহরুও সরকারিভাবে বিবৃতি দিয়েছিলেন যে, জম্মু ও কাশ্মীরের ‘স্পেশাল স্ট্যাটাস সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে (Special status of Jammu & Kashmir would fade away with time)।
এখন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ৭৩ বছর পরেও কংগ্রেস এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স কাশ্মীর নামক রাজনৈতিক ইস্যুটিকে জিইয়ে রাখার তাগিদে এবং মুসলমান ভোটব্যাঙ্ককে নিজেদের পক্ষে অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ ধারা দুটিকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করছে। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন আদ্যোপান্ত একজন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক নেতা। তিনি মনে করতেন হিন্দু অথবা মুসলমান, জৈন অথবা খ্রিস্টান সকলেই ভারতীয়। সুতরাং সকলকে জাতীয়তাবোধ এবং জাতীয়তাবাদকে মূল্য দিতে হবে। আগে দেশ, পরে ধর্ম। তাঁর সেই তত্ত্বভাবনা থেকেই আজ যখন ভারতীয় জনতা পার্টি—‘এক দেশ এক জাতিতত্ত্বের প্রয়োগে পদক্ষেপ নিতে চলেছে, তখনই শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক শোরগোল। এমনকী সম্পৰ্ণভাবে সংকীর্ণ সংখ্যালঘু তত্ত্বে বিশ্বাসী পিভিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি আরও এককাঠি এগিয়ে উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছেন যে— “Any tampering of Artical 370 and 35A will render treaty of accession null and void— অর্থাৎ সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধার দুটিকে বাতিল করা মানে কাশ্মীরের ভারতে অন্তভুক্তিকরণকেই অস্বীকার করা। অর্থাৎ পরিষ্কার ভাবে তিনি যা করতে চাইছেন তা হলো— ভারত থেকে কাশ্মীরের বিচ্ছেদকরণ। কারণ তার বক্তব্য— স্বাধীনতার সময় জম্মু এবং কাশ্মীরই ছিল একমাত্র মুসলমান-প্রধান রাজ্য যেটি পাকিস্তানের বিরোধিতা করে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু তিনি একবারও স্বীকার করছেন না— সে সময় কাশ্মীর ছিল হিন্দুরাজের অধীনস্থ রাজ্য।
এখন প্রশ্ন হলো—বিজেপি ঠিক কি চাইছে!বিজেপির প্রাথমিক উদ্দেশ্য— দেশজুড়ে ‘জাতীয়তাবাদ’ অবিচ্ছেদ্য রাখা। ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ ধারা কখনই জাতীয়তাবাদের পরিচায়ক নয়। বিজেপি চাইছে। কাশ্মীর ভারতবর্ষের অন্যতম রাজ্য হিসেবে গোটা দেশের এক আইনের ধারায় এসে ভারতবর্ষের মূলস্রোতের অঙ্গীভূত হয়ে উঠুক। শুধু তাই নয়— এই দুটি আইনের জন্য কাশ্মীরের সার্বিক উন্নয়নের গতি অনেক সময়েই রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ একটি আইনে যখন একটি রাজ্যকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় তখন দেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রকল্পের অনেক কিছুই ওইসব রাজ্যে প্রয়োগ করা সম্ভবপর হয় না। দ্বিতীয়ত, ৩৫এ ধারা অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীরে অন্য কোনো রাজ্যের নাগরিকরা ভূসম্পত্তির অধিকারী হতে পারেন না। এমনকী ভিন রাজ্যের কোনও মেয়ে কাশ্মীরের কোনো যুবককে বিয়ে করে সংসার পাতলেও তিনি শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির অধিকারী হতে পারেন না। তিনি নিজ অর্থে নতুন সম্পত্তি কিনতেও পারেন না। বাইরের কোনো শিল্পপতি কাশ্মীরে শিল্প স্থাপনও করতে পারেন না— আইনটির পরিধি এতটাই বিস্তৃত। আরও বড়ো প্রশ্ন হলো— কাশ্মীরে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারগুলিকে তাদের দেশে বাস করার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে হাজার হাজার কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মুসলমান আগ্রাসন ও অত্যাচারের শিকার হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। আজও তারা ভারতবর্ষে আশ্রিত হিসেবেই বসবাস করছেন। তাঁদের নিজ বাসভূমি পুনঃস্থাপন করাই হলো বিজেপির অন্যতম উদ্দেশ্য। তার ফলে কাশ্মীরকেও অদূর ভবিষ্যতে মুসলমান রাজ্যের তকমা বহন করতে হবে না। এক দেশ এক জাতি একতার সূত্রে বাঁধা পড়বে গোটা ভারতবর্ষ। এর চেয়ে বড়ো স্বাধীনতা আর কি হতে পারে? সুতরাং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বিতর্ক ছেড়ে কাশ্মীরের রাজনৈতিক দল ও আপামর নাগরিকদের উচিত নতুন কেন্দ্রীয় সরকারের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিলে গৃহীত উদ্যোগকে স্বাগত জানানো। যেদিন বিনা রক্তপাতে এ কার্য সমাধা সম্ভব হবে— সেদিনই ভারতবর্ষের প্রকৃত স্বাধীনতা প্রাপ্তি ঘটবে। ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষ পাবে পূর্ণ স্বাধীনতা।
সুজিত রায়
2019-07-12