সম্প্রতি প্রত্যাশিত ভাবেই আমাদের সংবিধান থেকে ৩৭০ ও তার সঙ্গী ৩৫-(ক) নং অনুচ্ছেদকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ আমাদের দেশে একটা কাটা হয়েছিল এতকাল। কাশ্মীরকে ভারতের অঙ্গীভূক্ত রাখার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহর তার ভ্রান্তি, হঠকারিতা ও অদূরদর্শিতার কারণে এক অদ্ভুত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন— ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ তারই কদর্য পরিচায়ক।
স্বাধীনতার সময় ভারতে অবস্থিত ৫৬২টা দেশীয় রাজ্যকে অবশ্যই ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। হয়েছিল। তবে সুযোগ রাখা হয়েছিল আগের অবস্থায় থাকার জন্যও। ইন্ডিয়ান। ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট’-এ বলা হয়েছিল—ওই সব রাজ্যের রাজা/নবাব ওই ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেসন’-এ স্বাক্ষর দিয়ে ভারত বা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। বলা। বাহুল্য, ওই আইন কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাজ্যের অধিবাসীদের মত নেওয়ার কথা আদৌ বলেনি— সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাজা/নবাবের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই অনুসারেই অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ভারতে যোগ দিয়েছে, কেউ গেছে। পাকিস্তানে।
কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহ অবশ্য প্রথম দিকে কোনও ডোমিনিয়ানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ পাকিস্তানের উপজাতি ও সৈন্যরা কাশ্মীরে হানা দিয়ে দ্রুত গতিতে রাজধানী শ্রীনগরের দিকে এগিয়ে আসায় রাজা বিপন্ন অবস্থায় ভারতের সাহায্য চেয়েছেন এবং তার জন্য ইনস্ট্রমেন্টে ভারতের পক্ষে স্বাক্ষর দিয়েছেন। সুতরাং ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট অনুসারে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি একটা বৈধ ব্যাপার এবং ঐতিহাসিক সত্যি— (কে. বি. কেশওয়ানীর ভাষায়— ‘Thus, the state became an integral part of India’ (ইন্টারন্যাশনাল রিলেসান্স, পৃ. ৫৬৬)। এই ব্যাপারে পাকিস্তানের কিছু বলার নেই।
সুতরাং বলা চলে, অন্যান্য যেসব দেশীয় রাজ্য যেভাবে ভারতভুক্ত হয়েছে, সেই একই পদ্ধতিতে কাশ্মীরও হয়েছে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের একটা অঙ্গরাজ্য। কিন্তু পরিস্থিতিকে আরও অনুকূলে আনার জন্য আমাদের সংবিধানে ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ রাখা হয়েছে। তার সঙ্গে আনা হয়েছে ৩৫ (ক) ধারাকেও। এই কারণে জি.এন. যোশী মন্তব্য 26516991, ‘The state of Jammu and Kashmir has been treated in the constitution separately and differently from other states’– (দ্য কন্স্টিটিউশান অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৩৩৪)।
সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদ যদিও ভারতকে ‘Union of states’বলেছে, তবু স্বীকার করতেই হবে যে, ভারত যুক্তরাষ্ট্র। এখানে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করা হয়েছে লিখিত আকারে এবং সেই ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য রয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রয়েছে। ২৯ টা রাজ্য সরকার।
এক্ষেত্রে রাজ্যগুলোর একই স্তরেও একই রকম মর্যাদা নিয়ে থাকার কথা। কিন্তু ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ থাকার ফলে কাশ্মীর পেয়েছিল পৃথক ধরনের অস্তিত্ব ও মর্যাদা। কাশ্মীর অন্যান্য দেশীয় রাজ্যের মতো একই ভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও দুর্গাদাস বসুর মতে তৈরি করা হয়েছিল separate constitutional relationship’— (ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২৩০)। এর মূলে ছিল ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ। সঙ্গে ছিল ৩৫ (ক) ধারাও।
এটা লক্ষণীয় যে, একটা বিশেষ পরিস্থিতিতেই এই অনুচ্ছেদ যুক্ত হয়েছিল— এটা ছিল একটা সাময়িক ব্যবস্থা এবং অস্থায়ী ধারা। জি. এস. পাণ্ডে মন্তব্য করেছেন, ‘Art. 370 is a temporary provision. It is not intended to be permanent (কস্টিটিউশনাল ল অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৪৩৯)। সংবিধানে এটাকে ‘Temporary, Transitional and Special Provisions’S72T163 রাখা হয়েছে। দুর্গাদাস বসু মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, রাষ্ট্রপতি এটা সংশোধন বা বাতিল করতে পারেন— সেটা এই অনুচ্ছেদেই আছে— (কনস্টিটিউশনাল ল অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৪২৮)।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই অস্থায়ী বিধানই সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে সগৌরবে সংবিধানে রয়ে গেছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতা, বাস্তববোধ ও নিষ্ঠার সঙ্গে একটা ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে।
এই দুটো ধারা থাকার জন্য কতকগুলো অসুবিধা ছিল—
(১) প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া কেন্দ্র সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারত না।
(২) সংসদ রাজ্যের সম্মতি ছাড়া সেখানকার জন্য আইন পাশ করতে পারত না।
(৩) জরুরি অবস্থা জারি করা যেত না।
(৪) “ইন্ডিয়ান পেনাল কোড্’ কার্যকর হতো না।
(৫) কাশ্মীরের বাসিন্দাদের দ্বি-নাগরিকত্ব ছিল।
(৬) বিধানসভাই ঠিক করত স্থায়ী বাসিন্দা কারা।
(৭) অন্য রাজ্যের অধিবাসীরা সেখানে জমি কিনতে পারতেন না, এবং
(৮) সেখানকার মেয়েরা বাইরের কাউকে বিয়ে করলে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। তাদের উত্তরাধিকারীরাও সেটা দাবি করতে পারতেন না।
এবার কিন্তু সব বদলে গেল। বিশেষ করে, কাশ্মীর হয়ে গেল কেন্দ্রশাসিত রাজ্য। সেই সঙ্গে লাদাখকেও কেন্দ্রশাসিত করা হয়েছে (তবে কাশ্মীরে বিধানসভা থাকবে)।
এর ফলে একটা বিরাট পরিবর্তন আসতে পারে।
প্রথমত, এতদিন রাজ্য সরকার সন্ত্রাসবাদীদের মদত দিয়েছে রাজ্যটা হয়ে উঠেছিল অগ্নিগোলক। এবার কেন্দ্র সরকার সামরিক বাহিনীর সাহায্যে সরাসরি শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে।
দ্বিতীয়ত, অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে তার পার্থক্য দূর হয়ে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি কার্যকর হবে।
তৃতীয়ত, কেন্দ্র কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
চতুর্থত, এই ভূস্বর্গ অত্যন্ত মনোরম। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে পর্যটন শিল্পের উন্নতি ঘটবে, সমৃদ্ধ হবে কাশ্মীর। বাড়বে কর্ম সংস্থান। পাথর ছুঁড়ে অর্থ জোগাড় করতে হবে না।
পঞ্চমত, অন্য রাজ্যের অধিবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সৃষ্টি হবে নাগরিক সাম্য।
ষষ্ঠত, লাদাখ কেন্দ্রশাসিত হওয়ায় শাসনব্যবস্থাও সুষ্ঠু হতে পারে, দেখা দিতে পারে দক্ষ প্রশাসন।
সপ্তমত, রাজ্যে ৩৫৬নং অনুচ্ছেদ জারি করার সুযোগ থাকবে।
অষ্টমত, ঘরছাড়ারা ঘরে ফিরতে পারবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো— এর জন্য এত সময় লাগল কেন? নেহরুর ভ্রান্তি সংশোধন করা কি অন্য কোনও সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না? তোষণ নীতিই কি ছিল তাদের রাজনীতির একমাত্র হাতিয়ার?
‘দ্য স্টেটসম্যান’ মন্তব্য করেছে— এই নিয়ে বিতর্ক ও আইনি জটিলতা থাকতে পারে, কিন্তু ‘there can be no question on the boldness of the initiative l’ সম্পাদকীয় নিবন্ধের নামও দেওয়া হয়েছে ‘Bold Initiative (৬.৮.১৯)। সত্তর বছর ধরে ওই রাজ্যে অরাজকতা, উগ্রপন্থা, দেশদ্রোহিতা ও অস্ত্র-তাণ্ডব চলছে অবাধে। রাজ্য সরকারের মদতে রাজ্যটা হয়ে উঠেছে রক্ত্যজ্ঞের পীঠস্থান এবং পাকিস্তানের দোসর, অথচ আমাদের শাসকরা ক্ষুদ্র ও ক্লিন্ন স্বার্থে এতকাল কোনও দৃঢ় পদক্ষেপ নেননি। এবারেও কিন্তু কোনও কোনও রাজনৈতিক দল এই ব্যাপারে ব্যাপক আপত্তি তুলেছে।
কিন্তু আমাদের মনে হয়, কোটি কোটি ভারতবাসী এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারকে মুক্তকণ্ঠে সাধুবাদ জানাবেন। ড. সুভাষচন্দ্র কাশ্যপ, ড. অমলকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন বিচারপতি অশোককুমার গাঙ্গুলি, আইনজ্ঞ সাভে প্রমুখ গুণীজন কেন্দ্রীয় সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আমরা তাদের সঙ্গে আছি।
আসলে, আমাদের সামনে আছে দুটো বড়ো সমস্যা— জাতীয় সংহতি (National Integration) ও সন্ত্রাসবাদ। যে ভাবেই হোক, ওর মোকাবিলা করতেই হবে।
জাতীয় সংহতির ব্যাপারে বাধাগুলো হলো ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, আঞ্চলিকতা, ক্ষুদ্র স্বার্থ ইত্যাদি। এগুলো দেশের মানুষের মধ্যে। বিভেদ ও বৈষম্য এনে দিয়েছে। ২০০৫ টা রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বও সৃষ্টি করেছে। দ্বন্দ্ব-বিভেদ। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা এবং কাশ্মীরিদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধে সেই অন্যায্য বৈষম্যকে আরও কদর্য করে তুলেছিল। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় (Preamble) ‘unity and integrity of the nation’ অন্যতম লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছে। এস. এল. সিক্রি মনে করেন— কাশ্মীর , গোর্খাল্যান্ড, খালিস্তান ইত্যাদি দিয়ে ঐক্যবদ্ধ ও অখণ্ড ভারত গঠনের কাজটা ব্যাহত হয়েছে। (ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ২৫৬)। ঐক্যসাধনের কাজটা সাঙ্গ করতেই হবে।
আর সন্ত্রাসবাদ রাজ্যটাকে রক্তস্নাত করে ফেলেছে গত সত্তর বছর ধরে। পাকিস্তান ও কাশ্মীরের উগ্রপন্থীরা হত্যা করেছে হাজার হাজার সৈন্য ও সাধারণ মানুষকে পেছনে ছিল রাজ্য সরকারের মদত। পাকিস্তান এবারও হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। যুদ্ধের ইঙ্গিতও রয়েছে তাতে। প্রশ্ন তুলেছে। ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি নিয়ে। কিন্তু এটা ভারতের নিজস্ব ব্যাপার, কারণ আইনগত পদ্ধতিতেই ওই ধারা বিলোপ করা হয়েছে। তাছাড়া কাশ্মীরের গণপরিষদও সেটা মেনে নিয়েছিল। জি. এন. থাপ্পার ভাষায়—“The accession was later confirmed by the constituent Assembly of the stare’ (ফরেন পলিসি অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৭৬)। উপায়ন্তর না দেখে পাক্-উগ্রপন্থীরা সেখানে রক্ত ঝরিয়ে চলেছে। কেন্দ্রীয় শাসনই এই নারকীয়তা বন্ধ করার উপায়। সম্প্রতি অমরনাথ তীর্থযাত্রীদের ফিরিয়ে আনতে হয়েছে, ৩৫,০০০ সৈন্য নিয়োগ। করতে হয়েছে সেখানে। এই অবস্থায় একটা অকর্মণ্য রাজ্য সরকারকে দিয়ে কাজ চলতে পারে না— দরকার কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ। মোদী সরকার সেই ব্যবস্থা করে প্রায় সমস্ত দেশবাসীর আস্থা ও প্রশংসা অর্জন করেছেন।
এটা লক্ষণীয় যে, এই ব্যাপারে কয়েকটা রাজনৈতিক দল তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। ন্যাশনাল কনফারেন্স, পি.ডি. পি. কংগ্রেস, আর.জে.ডি., টি.এম.সি., ডি.এম.কে., সি.পি.আই.(এম.), প্রভৃতি দল, প্রতিবাদ জানিয়ে সভাকক্ষ ত্যাগ করেছে। কোনও কোনও দলে দেখা গিয়েছেমতভেদ। আবার এনডিএ-র শরিক জেডিইউ সরকারের বিপক্ষে গেছে। এক কথায় বলা চলে— কেউ না বুঝে, কেউ দলীয় স্বার্থে হৈ-চৈ বাধিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থ বা সুবিধে আদৌ বড়ো কথা নয়। সবার ওপরে রয়েছে। জাতীয় স্বার্থ। দেশের নিরাপত্তা ও ঐক্যের। জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত দরকার ছিল। সবচেয়ে বড়ো কথা— এই অনুচ্ছেদকে রাখা হয়েছিল সংবিধানের সাময়িক ও অস্থায়ী (Temporary, Transtional and Special Provisions) অধ্যায়ে। এ.জি. নুরানীর মতে, এটা এভাবে রাখা হয়েছিল ‘for good reasons It contemplates its own death at the most appropriate time'(ইন্ডিয়া’জ কস্টিটিউশান, পৃ. ৫৬০)।
সাত দশক কেটে যাওয়ার পর মোদী সরকারই তার কর্তব্য পালন করেছে। তবে এবার দেখতে হবে— তার দ্বারা অভীষ্টসিদ্ধ। হয় কিনা। এটা এখন তাদেরই দায়।
ড. নির্মলেন্দু বিকাশ রক্ষিত
2019-08-17