রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দীর্ঘদিনের কর্মফল আমরা দেখতে পাচ্ছি।’করোনা ভাইরাস‘ (Corona virus) যখন ভারতবর্ষসহ গোটা পৃথিবী কে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই সেবা কাজের মাধ্যমে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। সমাজবাদের ছদ্মবেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন গোটা পৃথিবীকে পদানত করতে চাইছে, তখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ভারতবর্ষে স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদ এর উন্মেষে কটিবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার বুঝেছিলেন কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সভ্যতার পীঠস্থান ভারতবর্ষের দীর্ঘ পরাধীনতার কারণ বৈদেশিক , বর্বর শক্তির পরাক্রম নয়। পরাধীনতার মূল কারণ হলো ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য ‘ভারতীয় সমাজের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতা‘ , ‘দেশের জন্য আত্মত্যাগ না করা‘।
ডাক্তারজী বুঝেছিলেন যেন-তেন প্রকারেণ শুধুমাত্র স্বাধীনতা পেলেই হবে না, তাকে টিকিয়ে রাখতে ও ভারতবর্ষকে বৈভবশালী করতে রাষ্ট্রের হিতকারী কাজে সর্বস্ব দেওয়ার মতো নাগরিক সমাজ প্রয়োজন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পথ ও পাথেয়‘(রাজাপ্রজা) প্রবন্ধে লিখেছেন…….
“অনেককেই আহ্বান করিলাম, অনেককেই সমবেত করিলাম, জনতার বিস্তার দেখিয়া আনন্দিত হইলাম, কিন্তু এমন করিয়া কোনো কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করিলাম না যাহাতে উদ্বোধিত শক্তিকে সকলে সার্থক করিতে পারে। কেবল উৎসাহই দিতে লাগিলাম, কাজ দিলাম না। মানুষের মনের পক্ষে এমন অস্বাস্থ্যকর ব্যাপার আর কিছুই নাই। মনে করিলাম উৎসাহে মানুষকে নির্ভীক করে এবং নির্ভীক হইলে মানুষ কর্মের বাধাবিপত্তিকে লঙ্ঘন করিতে কুণ্ঠিত হয় না। কিন্তু এইরূপ লঙ্ঘন করিবার উত্তেজনাই তো কর্মসাধনের সর্বপ্রধান অঙ্গ নহে– স্থিরবুদ্ধি লইয়া বিচারের শক্তি, সংযত হইয়া গড়িয়া তুলিবার শক্তি যে তাহার চেয়ে বড়ো। এইজন্যই মাতাল হইয়া মানুষ খুন করিতে পারে, কিন্তু মাতাল হইয়া কেহ যুদ্ধ করিতে পারে না। যুদ্ধের মধ্যে কিছু পরিমাণ মত্ততা নাই তাহা নহে; কিন্তু অপ্রমত্ততাই প্রভু হইয়া তাহাকে চালিত করে। * সেই স্থিরবুদ্ধি দূরদর্শী কর্মোৎসাহী প্রভুকে * বর্তমান উত্তেজনার দিনে দেশ খুঁজিয়াছে, আহ্বান করিয়াছে; ভাগ্যহীন দেশের দৈন্যবশত তাঁহার তো সাড়া পাওয়া যায় না।”
ডাক্তারজী যেন রবীন্দ্র-ভাবনার সেই ‘স্থিরবুদ্ধি দূরদর্শী প্রভু’র মূর্ত রূপ যার ‘সাড়া’ স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতবর্ষের সমস্যা সমাধানেও অগ্ৰণী ভূমিকা পালন করে চলেছে।
১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, চৌরিচৌরার উত্তেজিত জনতার হিংস্রতা ,অসহযোগ আন্দোলনের সমাপ্তি টেনে আনে।সমাজ কে সুসংগঠিত না করে কোনো জন আন্দোলন যে সাফল্য লাভ করতে পারে না তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধে বুঝিয়েছেন এই ভাবে…….
“ক্রোধের আবেগ তপস্যাকে বিশ্বাসই করে না। তাহাকে নিশ্চেষ্টতা বলিয়া মনে করে, তাহাকে নিজের আশু উদ্দেশ্যসিদ্ধির প্রধান অন্তরায় বলিয়া ঘৃণা করে; উৎপাতের দ্বারা সেই তপঃসাধনাকে চঞ্চল সুতরাং নিষ্ফল করিবার জন্য উঠিয়া- পড়িয়া প্রবৃত্ত হয়। ফলকে পাকিতে দেওয়াকেই সে ঔদাসীন্য বলিয়া জ্ঞান করে, টান দিয়া ফলকে ছিঁড়িয়া লওয়াকেই সে একমাত্র পৌরুষ বলিয়া জানে; সে মনে করে, যে মালী প্রতিদিন গাছের তলায় জল সেচন করিতেছে গাছের ডালে উঠিবার সাহস নাই বলিয়াই তাহার এই দীনতা। এ অবস্থায় মালীর উপর তাহার রাগ হয়, জল দেওয়াকে সে ছোটো কাজ মনে করে। উত্তেজিত অবস্থায় মানুষ উত্তেজনাকেই জগতের মধ্যে সকলের চেয়ে বড়ো সত্য বলিয়া জানে; যেখানে তাহার অভাব দেখে, সেখানে সে কোনো সার্থকতাই দেখিতে পায় না।
কিন্তু স্ফুলিঙ্গের সঙ্গে শিখার যে প্রভেদ উত্তেজনার সঙ্গে শক্তির সেই প্রভেদ। চকমকি ঠুকিয়া যে স্ফুলিঙ্গ বাহির হইতে থাকে তাহাতে ঘরের অন্ধকার দূর হয় না। তাহার আয়োজন স্বল্প, তেমনি তাহার প্রয়োজনও সামান্য। প্রদীপের আয়োজন অনেক; তাহার আধার গড়িতে হয়, সলিতা পাকাইতে হয়, তাহার তেল জোগাইতে হয়। যখন যথাযথ মূল্য দিয়া সমস্ত কেনা হইয়াছে এবং পরিশ্রম করিয়া সমস্ত প্রস্তুত হইয়াছে তখনই প্রয়োজন হইলে স্ফুলিঙ্গ প্রদীপের মুখে আপনাকে স্থায়ী শিখায় পরিণত করিয়া ঘরকে আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে।”
কবিগুরু ঐ একই প্রবন্ধে লিখেছেন…..
“মানুষ বিস্তীর্ণ মঙ্গলকে সৃষ্টি করে তপস্যা দ্বারা। ক্রোধে বা কামে সেই তপস্যা ভঙ্গ করে, এবং তপস্যার ফলকে একমুহূর্তে নষ্ট করিয়া দেয়। নিশ্চয়ই আমাদের দেশও কল্যাণময় চেষ্টা নিভৃতে তপস্যা করিতেছে; দ্রুত ফললাভের লোভ তাহার নাই, সাময়িক আশাভঙ্গের ক্রোধকে সে সংযত করিয়াছে…..”
ডাক্তারজীও বুঝেছিলেন দ্রুত ফললাভের চেষ্টা ভারতবর্ষকে বিপথে চালিত করবে।দ্রুত ক্ষমতালাভের বাসনা ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেশভাগের মাধ্যমে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো।
ডঃহেডগেওয়ার (Dr. Hedgewar) অসহযোগ আন্দোলনের আবহে নির্জন কারাবাসে, ভারতবর্ষের মঙ্গলসাধনের উদ্দ্যেশ্য নিজের মন কে সেই তপস্যার ‘তপোবন’ প্রস্তুতের জন্যই চিন্তামগ্ন রেখেছিলেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ অনুভব, উপলব্ধি, সেই সঙ্গে পরিস্থিতির গূঢ় বিশ্লেষণ করে ডাক্তারজী বুঝেছিলেন একমাত্র সংঘবদ্ধ সমাজই ভারতবর্ষ কে এক অজেয় পরমবৈভবশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে।
ডাক্তারজী সেই সংঘবদ্ধসমাজ তৈরির উদ্দেশ্যেই ১৯২৫ সালে বিজয়াদশমীর শুভলগ্নে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শুভ প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে পৃথিবীর সবথেকে বড় সামাজিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
ডাক্তারজী সুবক্তা ছিলেন এবং খুব গভীর বিষয় অতি সহজ ভাবে বোঝাতে পারতেন। তিনি বুঝেছিলেন হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার কারণেই তাদের এই দুর্দশা।
প্রসঙ্গতঃ শ্রী ভাইয়াজী সহস্রবুদ্ধের লেখা পথের দিশারী ডাঃ হেডগেওয়ার বই এর একটি গল্প উপস্থাপন করছি…….
আমি একলা
ডাক্তারজি তখন ২৪ ঘন্টায় সংঘ কার্যে মগ্ন থাকেন।চারিদিকে যেসব ঘটনা ঘটতো সেগুলো তিনি মন দিয়ে বুঝতে এবং তার সঠিক অর্থ বোঝাবার চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন সামাজিক তথা রাজনৈতিক পথ প্রদর্শন করতেন এবং প্রয়োজনে পরোক্ষ সাহায্য করতেন।
একবার ডাক্তার জি সংঘের কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে নাগপুরে একটা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সভা। বক্তারাও ছিলেন বাঘা বাঘা। সভাতে হাজার লোক জমায়েত হয়েছিল। প্রথম বক্তার বক্তৃতা সমাপ্ত হলে দ্বিতীয়জন শুরু করলেন।
কিছু বদমাশ লোক সভা টাকে ভেঙে দেবার জন্য সেখানে উপস্থিত হয়। তারা মাঝে বসে ছিল। তাদের মধ্যে একজন সবার মাঝখানে একটা ব্যাঙ ছুড়ে ফেললো।
কেউ কেউ বলে উঠলো–সাপ,সাপ। তখন ৫/১০ জন সাপ,সাপ বলে পালাতে শুরু করলো।
সঠিক কি হয়েছে তা না জেনেই সকলে পালাতে শুরু করলো। একজনকে দেখে অন্যজনও পালাতে লাগল। অনেকে পড়ে গেল। অনেকে পায়ের তলায় চাপা পড়লো। কেউ হারালো ছড়ি, কেউ হারালো জুতো, আবার কেউ হারালো মাথার টুপি, কারো কারো জামাও ওখানে পড়ে থাকতে দেখা গেল। এমন দৌড়ঝাঁপ সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। হাজার লোকের সভা ১৫ মিনিটে খতম হয়ে গেল।
তিনদিন পর ডাক্তারজি যখন নাগপুরে ফিরে এলেন তখন সভার খবর সব জানতে পারলেন।শুনে খুব দুঃখ পেলেন ।সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন অনেক ভদ্রলোকদের বাড়িতে গিয়ে, তাদের সাথে ডাক্তারজি দেখা করেন। তখনকার বার্তালাপ নিম্ন প্রকারের হলো—-
ডাক্তারজী: “এদিনের সভায় আপনিতো উপস্থিত ছিলেন?“
ভদ্রলোক : “হাঁ, আমিতো পরিচালকদের মধ্যে একজন।”
ডাক্তারজী “তাহলে সভা ভেঙে গেল কি করে?“
ভদ্রলোক”কি আর বলবো, কয়েকজন গুন্ডার পূর্ব নিয়োজিত কাজ। আমিতো ভাবছিলাম ওদেরকে একটা দি, কিন্তু আমি একলা কী করতে পারি?ডাক্তার জি অনেক পরিচিত ব্যক্তিদের সাথেও দেখা করেন। অনেককেই তিনি এ কথা জিজ্ঞেস করেন। উত্তর এর সারাংশ ছিল, “আমার খুবই ইচ্ছা ছিল কিন্তু কি করবো, আমি যে একলা ছিলাম।”
ডাক্তারজী অবস্থা বুঝলেন ও সর্বশেষে বললেন, ‘আমি একা’ , এটাই হচ্ছে হিন্দু সমাজের প্রধান রোগ। ওটাকে শেষ করতে হবে। যেকোনো ভালো কাজে না ডাকলেও সেখানে যাওয়া দরকার। খারাপ লোকের সংখ্যা থাকে খুবই কম। চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই এর মতো ঝট্ করে একত্রিত হয়ে যায়। আর যারা ভদ্রলোক, তারা দূরে দূরে থাকে। ভালো কাজ করতেও তারা ভয় পায়। উপরন্তু বলে”আমি একলা কি করবো?“এই পরিস্থিতিকে বদলাতে হবে। প্রত্যেকটা হিন্দুর যেন মনে হয় যে আমি একা নই, পুরোসমাজ আমার পিছনে আছে। এই বিশাল হিন্দু রাষ্ট্রের আমি একজন।তাহলে পুরো হিন্দু রাষ্ট্রের শক্তি আমাতে দেখা যাবে। এ কাজটা অত্যন্ত শুভ কাজ, পরমেশ্বর আমাদের সহায়।প্রতিটি বিন্দুর মধ্যে এই ভাবটা যদি জাগাতে পারা যায় তবেই আমাদের দেশ দুনিয়াতে অগ্রগণ্য বলে প্রমাণিত হবে। সংঘকে এই কাজটাই করতে হবে।
এ ধরনের পথনির্দেশ ডাক্তারজী স্বয়ংসেবকদের নিত্য প্রতিদিন করতেন।প্রত্যেকটি স্বয়ংসেবক এর শারীরিক ,মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটুক এবং একজন ভালো নাগরিক হোক এটাই ডাক্তারজীর রাত দিনের চিন্তা ছিল। এরই ফলস্বরূপ নাগপুরে খুব শীঘ্রই আরো কয়েকটা শাখা শুরু হল।
পরিবেশনায় : পিন্টু সান্যাল (Pintu Sanyal) ; সহশিক্ষক( পদার্থবিদ্যা)