ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পুনরবলোকন



আজ ভারত ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্তির উৎসব উদযাপন করছে। এই উত্সবের ধারাবাহিক উদযাপনের মধ্যে– যখন স্বাধীন ভারতের ৭৫ বছরের যাত্রার মূল্যায়ন করা হবে– ঠিক সেই সময় এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চার শতাব্দীর অধিক সময় ধরে চলতে থাকা নিরন্তর সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের কথা পুনঃস্মরণ করাও স্বাভাবিক ঘটনা।
ভারতে ঔপনিবেশিক দাসত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রিয় আন্দোলন একটি “স্ব”-এর চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এই স্ব-এর প্রকাশ স্বধর্ম, স্বরাজ এবং স্বদেশ রূপ ত্রয়ীর মাধ্যমে সমগ্র দেশকে মথিত করেছিল। সন্ত এবং মনীষীদের সান্নিধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা ফল্গুধারায় আন্দোলনে নিরন্তর প্রবাহিত হয়েছিল।
যুগ যুগ ধরে ভারতের আত্মায় নিহিত এই “স্ব”-এর ভাব, তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে প্রকাশিত করেছিল এবং বিদেশী শক্তিদেরকে প্রতি পদক্ষেপে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এই বৈদেশিক শক্তিগুলি ভারতের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শৈক্ষিক ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে, গ্রামের স্বনির্ভরতা ধ্বংস করেছে। ভারত সর্বতো ভাবে এই সমস্ত বৈদেশিক শক্তির সর্বগ্রাসী আক্রমণের প্রতিকার করেছে।
ইউরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রতিরোধ বিশ্ব ইতিহাসে একটি অনন্য উদাহরণ। একদিকে বিদেশী আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম অন্যদিকে সমাজকে শক্তিশালী করা এবং সমাজের বিকৃতিগুলিকে দূর করে সামাজিক পুনর্গঠনের কাজের একটি বহুমুখী প্রচেষ্টা এই সংগ্রাম।
বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের রাজারা সর্বশক্তি দিয়ে ব্রিটিশদের প্রতিহত করছিল, অন্যদিকে নিজেদের সহজ সরল জীবনের ইংরেজদের হস্তক্ষেপ ও তাদের মূল্যবোধের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে জায়গায় জায়গায় জনজাতীয় সমাজ রুখে দাঁড়িয়েছিল। নিজেদের মূল্যবোধ রক্ষার জন্য রুখে দাঁড়ানো এই মানুষদেরকে ইংরেজরা নৃশংসতার সঙ্গে হত্যা করেছিল, কিন্তু তারা সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে যায়নি। এই পিছে না হঠা মানসিকতারই পরিচয় ১৮৫৭ খৃ. দেশব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রাম যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিল।
ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার অপপ্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করার জন্য কাশী (বারাণসী) হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন, গুজরাট বিদ্যাপীঠ, এম.ডি.টি. হিন্দু কলেজ তিরুনেলভেল্লী, কার্ভে শিক্ষা সংস্থান, ডেকান এডুকেশন সোসাইটি এবং গুরুকুল কাংড়ির মতো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে এবং ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে দেশপ্রেমের জোয়ার আসতে শুরু করে। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো বিজ্ঞানীরা ভারতের উন্নতির জন্য তাদের প্রতিভা উৎসর্গ করেছিলেন তেমনই নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দাদাসাহেব ফালকের মতো শিল্পীরা এবং মাখনলাল চতুর্বেদী সহ প্রায় সকল জাতীয় নেতা সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনজাগরণের কাজে লিপ্ত ছিলেন। তারা তাদের প্রতিভার মাধ্যমে দেশকে জাগানোর কাজ করছিলেন। মহর্ষি দয়ানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ এবং মহর্ষি অরবিন্দর মতো অনেক ঋষির আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা তাদের সকলের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছিল।
বাংলায় রাজনারায়ণ বসু কর্তৃক হিন্দু মেলার আয়োজন, লোকমান্য তিলক কর্তৃক গণেশোত্সব এবং শিবাজী উৎসব প্রভৃতি সার্বজনীন উত্সবগুলি ভারতের সাংস্কৃতিক শিকড়কে সিঞ্চিত করছিল, জ্যোতিবা ফুলে এবং সাবিত্রীবাই ফুলের মতো সমাজসংস্কারকরা নারীশিক্ষা ও সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে সশক্ত করার গঠনমূলক অভিযানে লিপ্ত ছিলেন। ড. আম্বেদকর সমাজকে সংগঠিত করার এবং সামাজিক সমতা অর্জনের জন্য সংগ্রামের পথ দেখিয়েছিলেন।
ভারতীয় সমাজ জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র ছিল না যেটি মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। শ্যামজি কৃষ্ণ বর্মা, লালা হরদয়াল এবং ম্যাডাম কামার মতো প্রবাসী ভারতীয়দের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের তীক্ষ্ণতা বাড়ানোর কাজ চলছিল। লণ্ডনের ইণ্ডিয়া হাউস ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত গতিবিধির কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। বিপ্লবী বীর সাভারকারের লেখা ১৮৫৭ সালের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ভারতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। স্বয়ং ভগৎ সিং এটি প্রকাশ করে হাজার হাজার প্রতিলিপি বিতরণ করেছিলেন।
দেশজুড়ে চারশ-র বেশি গুপ্ত সংগঠনের সাথে জড়িত বিপ্লবীরা নিজেদের জীবন হাতে করে ভারতমাতাকে মুক্ত করার অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলার বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপে সক্রিয় ড. হেডগেওয়ার লোকমান্য তিলকের অনুপ্রেরণায় কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং কংগ্রেসের সেণ্ট্রাল প্রভিন্সের সচিব নির্বাচিত হন। তিনি ১৯২০ সালে নাগপুরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনের আয়োজক সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন। এই অধিবেশনে, তিনি তার সহকর্মীদের সাথে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব পাস করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। শেষ পর্যন্ত আট বছর পর লাহোরে এই প্রস্তাব পাস হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে শুধু স্বাধীন ভারতের প্রথম সরকারই গঠিত হয়নি, আজাদ হিন্দ ফৌজ উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অংশ স্বাধীন করতেও সফল হয়েছিল। লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্মকর্তাদের বিচার গোটা দেশে জনরোষ নির্মাণ করে। একই সঙ্গে ব্রিটিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে নৌবাহিনীর বিদ্রোহ ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করে।
স্বাধীনতার সূর্য উঠেছিল, কিন্তু দেশভাগের গ্রহণের ছায়া তার উপর পড়েছিল। কঠিন পরিস্থিতিতেও এগিয়ে যাওয়ার সাহস জাগ্রত ছিল– এই কৃতিত্ব প্রত্যেক ভারতীয়ের, যারা শতসহস্র বছরের রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে নিজেদের ঘাম রক্ত ঝরিয়েছে।
মহর্ষি অরবিন্দ বলেছিলেন– ভারতকে জেগে উঠতে হবে, নিজের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য, মানবতার জন্য। তাঁর এই উদ্ঘোষ সত্য প্রমাণিত হয় যখন ভারতের স্বাধীনতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। একের পর এক, সমস্ত উপনিবেশ স্বাধীন হয়ে গেল এবং ব্রিটেনের কখনও অস্ত না হওয়া সূর্য চিরতরে অস্ত গেল।
পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি এবং সবশেষে ব্রিটিশরা ভারতে এসেছিল। প্রত্যেকেই বাণিজ্যের পাশাপাশি ভারতীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস ও ধর্মান্তরিত করার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালায়। ১৪৯৮ সালে প্রথম ইউরোপীয় অভিযাত্রী ভাস্কো-দা-গামা যেদিন ভারতের মাটিতে পা রাখেন সেই দিন থেকেই ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ত্রিবাঙ্কুরের (Travancore) মহারাজা মার্তন্ড বর্মার হাতে পরাজিত হয়ে ওলন্দাজরা ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। পর্তুগিজরা গোয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। আধিপত্যের সংগ্রামে ব্রিটিশরা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয় এবং তারা তাদের চক্রান্তমূলক নীতির শক্তিতে ভারতের অর্ধেকেরও বেশি অংশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। ভারতবর্ষের অবশিষ্ট অঞ্চল ভারতীয় শাসকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং তাদের সাথে ব্রিটিশরা চুক্তি করেছিল। স্বাধীনতার পর এই রাজ্যগুলির একটি সংঘ হিসাবে আবির্ভূত হয় গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের।
ভারত গণতন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। আজ বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সফল গণতন্ত্র ভারত। যারা ভারতের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রক্ষায় স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রেখেছিলেন, তারা ভারতের জন্য সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। এই কারণেই সংবিধানের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থে ছবির মাধ্যমে রামরাজ্যের কল্পনা করা হয়েছিল এবং ব্যাস, বুদ্ধ এবং মহাবীরের মতো ভারতীয়তার ব্যাখ্যাকারীদের প্রদর্শনের মাধ্যমে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রবাহকে অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
“স্বাধীনতার অমৃত উৎসব” উপলক্ষ্যে সেই সমস্ত হুতাত্মা দেশপ্রেমিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতার জ্ঞাপনের সময় এসেছে, যাদের ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের ফলে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বে আমাদের ন্যায্য স্থান প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সেই সব অজ্ঞাতনামা বীর, এই আলোচনার বাইরে থাকা সমস্ত ঘটনা, প্রতিষ্ঠান ও স্থান, যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং মাইলফলক হিসেবে প্রমাণিত, তাদের পুনরবলোকন, মূল্যায়ন এবং তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকস্মৃতির সঙ্কলন করে তাদের মূলধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে যাতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারে যে আজকের প্রজন্মের সহজলভ্য স্বাধীনতার পিছনে, বহু প্রজন্মের সাধনা, রাষ্ট্রদেবতার আরাধনার জন্য বহু শতাব্দী যাবৎ প্রবাহিত অশ্রু, ঘাম এবং শোণিত প্রবাহ রয়েছে।
(লেখক বর্তমানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সরকার্যবাহ)

মাননীয় শ্রী দত্তাত্রেয় হোসবলে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.