কলকাতার থেকে আড়াই ঘন্টার দূরত্বে, বাংলাদেশ সীমান্তের শেষ গ্রাম জাদুডাঙা থেকে এই গ্রামটি এক ঘন্টার দূরত্বে। চাষবাসই এখানকার প্রধান জীবিকা, জনসংখ্যার একটা অংশ জমির মালিক, অন্য অংশ ভাগচাষী অথবা রোজ খাটা জনমজুরের দল। এদের বড় অংশেরই কোনও অস্তিত্ব নেই রাজ্যের জনসংখ্যার হিসেবে, বেশির ভাগই সীমান্তপারের অনুপ্রবেশকারী শ্রমিক। গ্রামের বাসিন্দারা বেশির ভাগই ১৯৭১এর যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ থেকে আসা উদবাস্তুদের দল।
ছোট্ট গ্রামের নাম সুটিয়া। উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাত জেলার গাইঘাটা থানার অন্তর্গত এই গ্রাম। একে ঘিরে আছে কুটিপাড়া, গজনা, বিষ্ণুপুর, পাঁচপোতা, গোবরডাঙা, ঠাকুরনগর, গাইঘাটা, এবং বলদেঘাটা গ্রাম। গোবরডাঙা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন, শিয়ালদা থেকে দু ঘন্টার রাস্তা।
১৯৯১ সাল। বাংলার মসনদে প্রগতিশীল, মানবতাবাদী সরকার।
এই সময় থেকেই এখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে সুশান্ত চৌধুরি আর বীরেশ্বর ঢাল নামে দুই বহিরাগত গুণ্ডা। এরা এসেছিল নাগপুর আর বলদেঘাটা গ্রাম থেকে। সেই থেকেই এরা এখানে তোলাবাজি, মুক্তিপণ আদায়, বাংলাদেশে চোরাচালানের মাল থেকে মুনাফা ইত্যাদি নানাবিধ দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত।
১৯৯৮ সাল থেকে সুশান্ত চৌধুরির ক্ষমতা বাড়ে, তার দলে আরও কিছু দুষ্কৃতীদের দল যুক্ত হয়। দুই গুণ্ডা মিলেই তাদের তোলাবাজির কারবার জমিয়ে তোলে, স্থানীয় ব্যবসায়ী, দোকানদার এবং বাসিন্দা এদের কাছ থেকে এরা নিয়মিত তোলা আদায় করত এদের স্থানীয়ভাবে ব্যবসা করতে দেবার বিনিময়ে। দুজনেই বাইরের লোক হলেও অবিলম্বে এরা সুটিয়ায় জমিয়ে বসে, এবং নিজেদের দলে স্থানীয় হতাশ, কাজ-না-পাওয়া ছেলেপুলেদের ভেড়াতে শুরু করে। এই স্থানীয় ছেলেদের বেশির ভাগই এই সব দলের “ইনফর্মার” হিসেবে কাজ করত।
দেখতে দেখতে ছোটখাটো তোলাবাজির ঘটনা বাড়তে বাড়তে ২০০০ সাল নাগাদ এই সব বড় আকার ধারণ করে, এবং এর সাথে যুক্ত হয় গণধর্ষণের মত ঘটনাবলী। এর মূলে ছিল এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চালুন্দি নদীর বন্যায় সুটিয়া এবং আশপাশের গ্রামের বহু মানুষ সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়েন। বেশ কয়েকটি গ্রাম হতশ্রী হয়ে পড়ে। এই সময়ে সরকারি এবং বেসরকারি ত্রাণসাহায্য এসে পৌঁছয় এবং সেইসব বিলিব্যবস্থার কাজে লাগে স্থানীয় ছেলেরা।
এর পরে যা হয়, ধীরে ধীরে তারা নিজেরাই সেই সব রিলিফের মাল সরাতে থাকে, এবং সুশান্ত আর বীরেশ্বরের সহায়তায় তাদের গুণ্ডাবাহিনি এই সব গ্রামে তাদের দৌরাত্ম্য শুরু করে। গুন্ডাবাহিনি রিলিফের দখল নেয় এবং তারাই স্থানীয় স্কুল পালানো, কর্মহীন, হতাশ কমবয়েসী ছেলেদের নিজেদের দলে নিয়োগ করতে শুরু করে, ক্রমে সুটিয়া এবং আশপাশের সমস্ত গ্রামের রিলিফ সেন্টারের দখল তারা নিয়ে নেয়, এবং তাদের সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয় পুরো এলাকায়।
কেউ রা কাড়লেই ঘরের সব মেয়ে (দিদিমা থেকে খুকি) গণধর্ষিতা হবে, কিম্বা বডি পড়বে ইছামতীর ধারে। পুলিশের হিসেবে ৩৩টা ধর্ষণ আর ১২টা খুন, আসল হিসেব আজো কেউ জানেনা।
নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে তারা তোলাবাজি আর অত্যাচার চালাত, লোকাল ইনফর্মারদের সাহায্যে তারা স্থানীয় পরিবারগুলো সম্বন্ধে খবর জোগাড় করত, তারপরে বাইকবাহিনী নিয়ে চড়াও হত সেই পরিবারের ওপর, মহিলাদের অত্যাচার এবং ধর্ষণ করত, তারপরে টাকা দাবি করত। কখনও দাবির কম টাকা নিয়েই তারা খুশি হয়ে যেত, কখনও কখনও তারা বাধ্য করত পরিবারটিকে নিজেদের আংশিক জমিজিরেত বেচে টাকা তুলে দেবার জন্য।
পুলিশে খবর দিলে মেরে ফেলার হুমকি দিত তারা। কখনও তারা লাগাতার কয়েক দিন ধরে কোনও একটি বাড়িকে ঘিরে থাকত, কাউকে বেরোতে দিত না যতক্ষণ না তাদের দাবি মানা হত। সবাই জানত, স্থানীয় পুলিশের সাথে তাদের যথেষ্ট বোঝাপড়া ছিল এবং দুই গুণ্ডাবাহিনির নেতাই বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় পুষ্ট ছিল, তাদের ধরা সোজা ছিল না। মেয়েদের তারা ধরে নিয়ে যেত নাগবাড়ি এলাকায় একটা ছোট পরিত্যক্ত ঘরে, তারপরে সেখানে তার ওপর অত্যাচার চালাত।
২০০১ সালে সেখানে পরপর ঘটে যায় অনেকগুলো পৈশাচিক ঘটনা। কিছু মহিলা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভকে ধর্ষণ করা হয় (সংখ্যা পাওয়া যায় নি)। তাঁরা যখন সুটিয়া এসেছিলেন, তাঁদের টেনে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের মাঠে, সেখানে ধর্ষণ করা হয় তাঁদের। কোনও এফআইআর হয় নি এ ব্যাপারে।
সেই একই বছরে তেরো-চোদ্দ বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। সে থাকত তার মা আর ভাইয়ের সাথে, পুঁতির গয়নার কাজ করে দৈনিক মজুরিতে তাদের দিন চলত, দারিদ্র্যসীমার নিচের বাসিন্দা। গুন্ডাদের দল জোর করে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যায় এক নির্জন জায়গায় কোনও এক ধানক্ষেতের মাঝে, জোর করে তাকে মদ খাওয়ানো হয় যতক্ষণ না সে বেহুঁশ হয়ে পড়ে, তারপরে চারজন মিলে তাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে।
২০০১ সাল। আফগানিস্তানে তালিবান শাসন ভেঙে পড়েছে। রিলিজ হয়েছে Human Genome Sequence .. চীন প্রবেশ করেছে WTO তে। সেই সময়ের বাংলার একটা খন্ডচিত্র।
সেই বছরেই সুটিয়াতে গণধর্ষণের পরে সবার সামনে এক মহিলাকে নগ্ন করে ঘোরানো হয়, নরপশুরা তাঁর যোনিতে আইসকিউব ঢুকিয়ে উল্লাস অনুভব করতে থাকে। আরেক মহিলা স্বামীর সঙ্গে রিক্সায় চেপে মছলন্দপুর থেকে তাঁর বাপের বাড়ি সুটিয়ায় আসছিলেন, পথে ভাড়া নিয়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে রিক্সাওলার কিছু বচসা হয়। সেই সময়ে গুন্ডা দলের এক ইনফর্মার ওখান দিয়ে যাচ্ছিল, সে গিয়ে দলটিকে খবর দেওয়া মাত্র গুন্ডারা এসে এই দম্পতিকে ঘিরে ধরে, এবং দাবি করতে থাকে এরা নাকি আসলে সত্যিকারের স্বামী-স্ত্রী নয়, অতএব এদের একসঙ্গে থাকা “অনৈতিক”। জোর করে তাদের রিক্সা থেকে নামিয়ে ছেলেটিকে বেদম পেটানো হয়, এবং প্রকাশ্য রাস্তায় ফেলে মেয়েটিকে নগ্ন করে এবং তারপরে ধর্ষণ করে এবং তারও পরে যোনিতে আইসকিউব ঢুকিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে।
২০০২ সালে আরও এক মহিলার গণধর্ষণ হয়, স্বামীকে বেঁধে রেখে পেটানো হয়। সুটিয়ার কাছে বিষ্ণুপুরের ঘটনা। মহিলাটি প্রাথমিকভাবে বিধবা ছিলেন এবং সম্প্রতি এক বিপত্নীক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন। গুণ্ডাদের দল একদিন তাদের বাড়িতে চড়াও হয় এবং অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ আনে, স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রী-র ওপর গণধর্ষণ চালায়। তার পরে তারা পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করে দম্পতিটির কাছ থেকে। তাদের কাছে অত টাকা ছিল না। গুণ্ডারা তখন নজর দেয় তাদের সামান্য একটু জমির ওপর। সেই জমি বিক্রি করে তাঁরা পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হন।
একটু ফিরে যাওয়া যাক ২০০০ সালে।
জুলাই মাস, ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। সুটিয়ার বাজারে গ্রামের লোকজন জড়ো হল প্রতিবাদ করতে। এদিকে ভয়ে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। তখনি বিশ্বাসদের ছোট ছেলে এগিয়ে এল। জোরগলায় প্রতিবাদ জানাল, একপ্রস্থ হাতাহাতিও হয়ে গেল। এর ফল – বরুণ গঠন করল ‘সুটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ’, ছোট করে, স্রেফ ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’..
সেই শুরু। ধর্ষিতা মেয়েদের মনোবল ফিরিয়ে আনা, কখনো তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা, বাচ্চাদের পড়ানো, লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলা যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সুশান্তকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবার সময় তার হাতে একটা রামকৃষ্ণ কথামৃত গুঁজে দিয়েছিল বরুণ, বলেছিল ‘জেলে বসে পড়িস’..
বইটা পড়েনি সুশান্ত। যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাবার পর শ্রীঘরের ভেতর থেকেই প্ল্যান কষে শত্রুকে খতম করল সে। ৫ই জুলাই, ২০১২। রোজকার মত সন্ধে ৭:২০’র লোকাল ধরে গোবরডাঙ্গা স্টেশনে নামল বরুণ। এগিয়ে গেল স্ট্যান্ডে রাখা বাইকটার দিকে। আর তখনি বুলেটগুলো ওকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিল।
খুনীদের কয়েকজন ওর গ্রামের ছাত্র। তিন বছর কেটে গেছে। দোষীরা সকলে এখনো ধরা পড়েনি।
ইতিমধ্যে রাজ চক্রবর্তী সিনেমা বানিয়ে ফেললেন। প্রিমিয়ারে ছবি উঠল। লোকে অবাক হয়ে দেখল চোখের জল মুছে বুড়োবুড়ি এখনো চোয়াল শক্ত করছেন। এঁদের মেয়ে আবার কামদুনির প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটে এসেছে।
তবে এসব তো ক’দিনের মামলা। তারপরেই নতুন হেডলাইন, নতুন অপরাধ, নতুন চচ্চড়ি। পরমব্রত নতুন ছবিতে অন্য হিরো। সবাই ভুলে যাবে কাকে নিয়ে ‘প্রলয়’ সিনেমাটা হয়েছিল।
কি বেশ যেন নাম ছেলেটার … বয়েস চল্লিশ বছরও পার হয়নি … বিয়ে-থা করেনি … গ্রামের দিকে কোথায় একটা মার্ডার কেস …
বরুণ বিশ্বাস। কে ?
(ঋণ : রিনিতা মজুমদারের ‘সুটিয়ার কথা’)
Joydeep Sen এর।সৌজন্যে