১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ঠিক সাতটা। ‘রিপাবলিক বাংলা’-র সংবাদদাতা চেঁচাচ্ছেন “ইম্পর্টেন্ট গুরুত্ব দিয়ে… “। খটাক করে কানে বাজল কথাটা। মুহূর্তেই সামলে নিতে হল। কারণ, বিভিন্ন চ্যানেল, পোর্টালে এখন অহরহ ইংরেজির অবাস্তব আমদানি।
‘মর্যাদার লড়াই না লিখে ‘প্রেস্টিজ ফাইট’ লিখলে বুঝি প্রেস্টিজ বাড়ে। লজ্জা লাগে মেধা তালিকা, তৃতীয় শ্রেণী, শাখা দায়িত্বপ্রাপ্ত, আতঙ্ক, বিজ্ঞপ্তি, শিবির, সামাজিক মাধ্যমে, অর্থনীতি-বিষয়ক নীতি, বিদেশনীতি প্রভৃতি শব্দ ব্যবহারে। বদলে খুশি হই বাংলা বাক্যে মেরিট লিস্ট, গ্রুপ সি, ভেন্যু ইনচার্জ, প্যানিক, নোটিফিকেশন, ক্যাম্প, ইকনমিক পলিসি, ফরেন পলিসি প্রভৃতি শব্দ লিখতে। এভাবে প্রচলিত অসংখ্য বাংলা শব্দ না ব্যবহার করে কি আমাদের অজান্তেই গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করছি? আগের চেয়ে আরও বেশি মাত্রায় মুখের কথা আর লেখার ভাষায় ব্যবহার করছি ইংরেজি।
এক সময় মিশনারীদের পাশাপাশি বিজ্ঞান লেখার বেশ কয়েকজন বাঙালি কৃতিত্ব দেখান। প্রথমে অবশ্যই নাম করতে হয় অক্ষয়কুমার দত্তের (১৮২০-১৮৮৬)। মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি একটা বিজ্ঞানের বই লেখেন – ভূগোল। বাংলা ভাষায় বাঙালির হাতে রচিত এটাই প্রথম বিজ্ঞানের বই। ১৮৫৬ সালে তিনি পদার্থবিদ্যা নামেও একটা বই লেখেন। অক্ষয়কুমারের বই সে সময়ে বহু প্রতিষ্ঠানে পাঠ্য ছিল। ইংরেজি বহু শব্দ তিনি বাংলায় চালু করেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর লেখা বই পড়ে শিক্ষার পালা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথও সুন্দর কিছু বাংলা শব্দ উপহার দিয়েছিলেন আমাদের। আরও যাঁদের নাম করতে হয় তাঁরা হলেন কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় (১৮১৩-১৮৮৫) এবং রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২২-১৮৭১)।
২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাদিবসে সামাজিক মাধ্যম ছেয়ে যাবে বাংলা ভাষার কান্নায়। কিন্তু আমরা কতটুকু বাংলা ভাষাকে নিজের অন্তর থেকে গ্রহণ করি? কী বলছেন বিশিষ্টজনেরা?
“দিল্লীওয়ালারা ঘোষিত হিন্দী সম্প্রসারণবাদী“
ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাস
— শিক্ষাবিদ, প্রাক্তন উপাচার্য
বাংলা ভাষার মর্যাদা নেই। বাংলাদেশ আরবী-মিশ্রিত বাংলা চালাচ্ছে। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার অঙ্কে চলে যাচ্ছে। এ বাংলায় অকাদেমী আছে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ আছে। পরিকল্পনা নেই। সর্বজনমান্য বানান বিধি নেই, সংস্কৃত-জ্ঞান আর মাতৃভাষা চেতনা নেই। উপরন্তু এই বাংলায় আরবী- পন্থীদের ছদ্মবেশ ধারন আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি তো রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে উর্দুর পাশে রাখার দাবিতে আন্দোলন ছিল! একে ভুলভাল বুঝিয়ে মাতৃভাষা আন্দোলন বলে চালানো হচ্ছে! আমরা ১৯ মে ১৯৬১ মনে রাখি না। এগারোজন তরুণ তরুণীর রক্ত ও জীবন দান ভুলে থাকি। সরকার চালাচ্ছে অশিক্ষিতের দল। মাতৃভাষা তাদের কাছে না রাম না গঙ্গা। সমাজে ইতরায়ণ সম্পূর্ণ হয়েছে। মাতৃভাষা আম্মা বুলির কাছে হেরে যাচ্ছে। ইংরেজির দাপটও সর্বাঙ্গীন। দিল্লীওয়ালারা ঘোষিত হিন্দী সম্প্রসারণবাদী।
*
“এ রাজ্যে অন্য প্রদেশের আবাসিকদের সঙ্গে আমাদের বাঙলাতেই কথা বলা উচিত“
— রূপা মজুমদার
লেখক, প্রকাশক
হ্যাঁ দিচ্ছে। বাংলা আমাদের ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যম। ইংরেজি কাজের ভাষা। দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বিরোধ থাকার কথাও নয়। নিন্দুকেরা বলেন বাংলা ভাষার নাকি সংরক্ষণের প্রয়োজন। আমি এই সবের প্রয়োজন অনুভব করি না, এবং গর্ব সহকারে বলি বাংলা ভাষা সম্পর্কে আমরা যথেষ্ঠ যত্নবান। হ্যাঁ এটা ঠিক যে ভাষার বিবর্তন হচ্ছে, এবং সেটাকে ব্যাক্তিগত ভাবে আমি স্বাগত জানাই, কারণ যুগের বা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু যেরকম পরিবর্তন হচ্ছে, ভাষার সময়ের সঙ্গে বিবর্তন প্রয়োজন। অনেক বিদেশী বা অন্য প্রদেশের শব্দের অনুপ্রবেশ আমাদের কথ্য বাংলাতে হচ্ছে, এমনকি লেখার সময়তেও হচ্ছে, কিন্তু আমি এর মধ্যে কোনো ক্ষতি দেখি না।
প্রশাসনিক স্তরে দুটো বাংলা ভাষার গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেই কারণেই স্কুলে বাংলা আবশ্যিক করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, এবং ঘোষণাও করেছিলেন একদা। আমার মনে হয় এটা বলবৎ করা উচিত, কারণ একটি শিশু যখন এত গুলি বিষয় করায়ত্ত করতে পারছে, তখন আরেকটা সাহিত্যের ভাষা পড়লে এমন কিছু ভাড় চাপানো হয় না। তাছাড়া সব কিছু প্রশাসন বা সরকারের ওপর ছেড়ে বা দিলে হয় না, আমাদের নিজেদের কিছু কর্তব্য থাকে। আমার মনে হয়, অন্য প্রদেশের মানুষ যাঁরা বাংলায় এসে বসবাস এবং কাজকর্ম করছেন, তাঁদের সঙ্গে আমাদের অর্থাৎ বাংলা ভাষীদের হিন্দি বা ইংরেজীতে কথা না বলে বাঙলাতেই বলা উচিত। তাতে তাঁরাও বাংলাতে আরো সাবলীল হবেন।
(শুকতারা ও নবকল্লোল-এর সম্পাদক, দেব সাহিত্য কুটির-এর কর্ণধার)
*
“বাংলা ভাষার গুরুত্ব সত্যিই যে হারাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না”
সুস্বাগত বন্দ্যোপাধ্যায়
—গবেষক, প্রাবন্ধিক
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ভারতীয় জনতা পার্টির বিধায়কের বিরোধিতা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের বিধায়কের সমর্থনে প্রস্তাব পাশ হয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামের পরিবর্তন করে
ইংরেজি-তে বেঙ্গল এবং বাংলায় বাংলা নামকরণের। কিন্ত কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিকতার অজুহাতে এই প্রস্তাবে সম্মতি দেয় নি। বাংলা ভাষায় মা ডাকের বুলি নিয়ে যে নবজাতক কথা বলতে শেখে তাঁর মা ডাক-কে ধমকে দিয়ে ম্মামি বলতে শেখায় আত্মঘাতী রঙবেরঙের ধুতি পাঞ্জাবি, শাড়ি পরিহিত শিক্ষিত বঙ্গজরা। মেকলের কালো ইংরেজ-র সার্থক একুশের প্রজন্ম সকালে উঠে কারো সাথে কথা বলা শুরু করে গুড মর্নিং বলে, সুপ্রভাত নয়। অথচ বেংরেজি একুশের মিছিলে বাঙালি-ত্ত্ব জাহির করার জন্য নিজস্বী তুলে সামাজিক মাধ্যমে তুলেধরে। আ মরি বাংলা ভাষার গান করে। এই নাটুক-এ বাংলা প্রেম ভাষা সংস্কৃতির মর্যাদা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে ভুঁইফোর বুদ্ধি ব্যবসায়ীরা বলতে পারবে। বাংলা ভাষার গুরুত্ব সত্যিই যে হারাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ৮০% সরকার প্রোষিত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টারমশাইরা অর্থ লুঠে নিয়ে নিজেদের সন্তানদের ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে পড়ায়। আর বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের ভাষা এবং বিষয়গত শিক্ষায় নোট ও টিউশন নির্ভর করে তুলেছে। বাংলা ভাষার সাবলীলতার স্বার্থে শুধুমাত্র প্রশাসনিক কাজকর্ম যথেষ্ট নয়, বাংলা ভাষার সহজ সরল এবং মাধুর্যপূর্ণ শব্দের ব্যবহার। দেশি বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ, এবং পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে ইংরাজি শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার কম করা।
(সম্পাদক রামকৃষ্ণ সারদা আশ্রম রাজগীর, প্রাক্তন সম্পাদক ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন)
*
“অবাঞ্ছিত বিদেশি শব্দের আনাগোনা অত্যাধিক“
— ডঃ সুমন চন্দ্র দাস
গবেষক, জাতীয়তাবাদী ছাত্র সমাজের মাসিক মুখপত্র ‘বঙ্গ বিদ্যার্থী’-র সম্পাদক
বাঙ্গলা ভাষার মধ্যে অনুপ্রবেশকারী শব্দ বাঙ্গলা ভাষার শ্রুতি মধুরতা এবং যথার্থ অর্থবহ, মাধুর্যকে নষ্ট করছে। আজকাল আমরা বাঙ্গলা শব্দ ভান্ডারে সুমধুর শ্রুতি গ্রাহ্য শব্দ থাকা সত্ত্বেও একবিংশত শতকের বাঙ্গালী কেন জানি না বাঙ্গলা শব্দ ভান্ডারে শব্দ চয়নে ভাষার মাধুর্যকে অপ্রয়োজনীয় বাঙ্গলা নয় এমন শব্দের ব্যবহারে অবক্ষয়ের ক্রমাবনতি বৃদ্ধি করছে। কথ্য বাঙ্গলা এবং লিখিত বাঙ্গলার মধ্যে বিদেশী শব্দের ব্যবহার ক্রমে ক্রমে বাঙ্গলা ভাষার মূল সত্ত্বাকে নষ্ট করছে। সময় ও যুগের গতিপ্রকৃতিতে সাংস্কৃতিক রেণু সংযোজন হয় এককথা ঠিক কিন্তু তার মানে এটা নয় যে ভাষার নিজস্বতা হারিয়ে বৈদেশিক শব্দের অনুপ্রবেশে অধিগ্রহণ হবে। আজকাল তো প্রচুর আরবী আর উর্দু শব্দ বাঙ্গলা বর্ণে লিখে শব্দের বঙ্গীয় করণ চলছে। ‘ নূর’, ‘আলম’, ‘জাকির’, ‘জাকাত’ ইত্যাদি শব্দ কি বাঙ্গলা বর্ণে লেখা বাঙ্গালা শব্দ ভান্ডারের শব্দ? উত্তরে, না একটাও বাঙ্গালা শব্দ নয়। জোরপূর্বক এই শব্দ গুলো বর্তমানে বাংলা। বাঙ্গলা শব্দ ভান্ডারে সুমধুর, শ্রুতি গ্রাহ্য এবং মধুময় শব্দ থাকে তাকেই ব্যবহার করা উচিত।
পরীক্ষায় ‘পাশ করা’ থেকে ‘উত্তীর্ণ হওয়া’ কোনটা বাঙ্গলা শব্দের ব্যবহারে শ্রুতি মধুর? নিশ্চয়ই ‘উত্তীর্ণ হওয়া’। বিচারালয়ে অভিযুক্ত অপরাধীকে বিচারক দোষী চিহ্নিত না করলে ‘বেকসুর খালাস ‘ শব্দের পরিবর্তে ‘নির্দোষ মুক্ত’ কথাটা বেশী গ্রহণ যোগ্য। আবার রাস্তায় বিশেষ বাঁধাকে ইংরেজিতে ‘স্পীড বেকার’, ‘ঠোকরে’ থেকে ‘গতিনিরোধক’ শব্দের মাধুর্য অনেক বেশী। সেরকমই কোন ব্যক্তিকে সম্মান সূচক অর্থে বাঙ্গলাতে ‘আদরনীয়’ শব্দের বদলে ‘মাননীয়’ শব্দ ব্যবহার অনেক শ্রুতি গ্রাহ্য। চলার পথে ‘বাস স্টপ’-এর বদলে ‘যাত্রী প্রতীক্ষালয়’ ব্যবহার অনেক শ্রুতি মধুর। মোবাইলে ‘ম্যাসেজ’ এর বদলে ‘বার্তা’ শব্দ ব্যবহার হয় না বললেই চলে। অথচ এই শব্দ গুলি খুব সুন্দর ভাবে ভাবের যথার্থ তাৎপর্য নিয়ে অবস্থান করছে। কিন্তু কোথাও না কোথাও আমরা বাঙ্গলা ভাষার মধ্যে আমরা জেনে শুনে শব্দের সঠিক প্রয়োগ করছি না। আর করছি না বলেই হয়তো অবাঞ্ছিত বৈদেশিক শব্দের আনাগোনা অত্যাধিক। আগামীদিনে বাঙ্গালীর বাঙ্গলা ভাষার চর্চা বিশেষ করে কথ্য ও লেখার জগতকে নিয়ে শব্দ চয়নে ভাষার মাধুর্যের এবং যথার্থ তাৎপর্য নিয়ে ভাবতে হবে। সকল পরিবর্তনের মধ্যে কিছু সত্ত্বাকে ধরে রাখা একান্ত প্রয়োজন। আগামী প্রজন্মের কাছে এই অনুপ্রবেশ সম্পর্কে ভাবাতে হবে।
(‘স্টুডেন্ট ফর হোলিস্টিক ডেভলপমেন্ট অফ হিউম্যানিটি’-র জাতীয় সহ আহ্বায়ক)
*
”আমরা বাঙালিরা মাতৃভাষাকে সত্যি কি আপন করে নিতে পেরেছি?“
ডঃ সুচন্দ্রা ঘোষ
— ইতিহাসবিদ
বাংলার প্রচলন আগের চেয়ে অনেকটাই কমে গিয়েছে। বিষয়টা ভাবলে দুঃখ লাগে। এর একটা প্রধান কারণ, আমাদের পড়ার অভ্যাস। ছোটবেলায় অসমে থাকতাম। স্কুলে বাংলা ছিল। কিন্তু তাতে ঋদ্ধ হওয়ার অবকাশ ছিল না। মা ছিলেন শিক্ষিকা। লিখেছিলেন ছোটদের ইতিহাসের গল্প। ওঁর কাছেই আমার বাংলার পাঠ। কলকাতা থেকে বিমানে দুপুরে ডাক যেত। আমি পড়তাম ‘আনন্দমেলা’। আর মা ‘দেশ’। কে আগে সেই বই হাতে নেবে যেন মুখিয়ে থাকতাম। তারপর গোগ্রাসে গিলতাম। সেই আবেগ আর উদ্দীপনা এখন কতটা রয়েছে? বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসাটা শিশুদের মধ্যে আসতে হবে মা-বাবার কাছ থেকে। পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতাটাই এখানে বিবেচ্য। হায়দরাবাদে দেখি অনেক দোকান বা শপিং মলের নামফলকে তেলুগু শব্দ। তুলনায় পশ্চিমবাংলায় স্থানীয় ভাষার প্রচলন অনেক কম। এ ছাড়া বাংলা কথ্য এবং লেখার ভাষায় অত্যাধিক ইংরেজির ব্যবহার। এ সবে প্রশ্ন ওঠে, আমরা বাঙালিরা মাতৃভাষাকে সত্যি কি আপন করে নিতে পেরেছি?
(হাদরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক, বঙ্গীয় ইতিহাস সমিতি এবং সোসাইটি ফর আন্ডারস্ট্যান্ডিং কালচার অ্যান্ড হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ার সহ সভাপতি)
— অশোক সেনগুপ্ত