একজন কিংবদন্তি চিকিৎসক, একজন কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ, একজন প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি মানুষ তিনি ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়

পাটনার এক গরীব পরিবার থেকে তাঁর উঠে আসা তাঁর। একসময় অর্থাভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি চালাতেন। মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তারি জীবন শুরু করার পর হারিয়েছিলেন নিজের প্রেমিকাকেও। কেবল ডাক্তারিতে তাঁর মাসিক আয় ৫ টাকা বলে। জীবনে আর বিয়ে করার সুযোগটাও পাননি।
.
একজন কিংবদন্তি চিকিৎসক, একজন কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ, একজন প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি মানুষ তিনি ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। বলতেন, ‘আমার কাছে সমস্ত রোগীরা সৃষ্টিকর্তার অসীম দান।’ আজো গোটা ভারতে তাঁর জন্ম ও প্রয়াণ দিবসে পালিত হয় জাতীয় চিকিৎসক দিবস।
.
তাঁর রোগীর তালিকায় কে ছিলেন না? ভিভিআইপি থেকে শুরু করে পথের ভিখারি‌ অব্দি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, মহাত্মা গান্ধী, মোতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, বল্লভ ভাই প্যাটেলের মতো কিংবদন্তিরা। আরো যোগ করি; মাদার তেরেসা, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলিও ছিলেন তাঁর রোগীর তালিকায়।
.
বিধানচন্দ্রের রায়ের জন্ম বিহারের পাটনার বাঁকিপুরে ১৮৮২ সালের পহেলা জুলাই। তিনি ছিলেন তাঁর বাবা প্রকাশচন্দ্র রায় ও মা অঘোরকামিনী দেবীর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। প্রকাশচন্দ্রের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে। সরকারি চাকুরিজীবী প্রকাশচন্দ্র একসময় ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। বিখ্যাত ব্রাহ্মনেতা ও ‘নববিধান’ ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেন বিধানচন্দ্রের নাম রেখেছিলেন ‘বিধান’।
.
ডাঃ বিধানচন্দ্রের লেখাপড়ার সূচনা হয়েছিলো এক গ্রাম্য পাঠশালায়। পরে পাটনার টি কে ঘোষ ইনস্টিটিউশন এবং তারপর পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা শেষে পাটনা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন ১৮৯৫ সালে। এর পরের বছরই মাকে হারান বিধানচন্দ্র রায়। ১৮৯৭ সালে পাটনা কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হলেন একই কলেজে গণিত বিভাগে বিএ তে।
.
একসময় অর্থাভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি চালাতেন বিধান চন্দ্র রায়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পুরুষ নার্স হিসেবেও কাজ করেছেন। এত কাজের মধ্যে বই খাতা উল্টে দেখার সময় পেয়ে উঠতেন না।অথচ ডাক্তারি পড়বার বাসনা ছিলোনা এই কিংবদন্তি চিকিৎসকের।
.
শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ফর্মের জন্য আবেদন করেছিলেন। ডাক্তারির ফর্মটা আগে আসায় ওইটাই আবেদন করলেন। পূরণ করে পাঠিয়ে দিলেন। পরে শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফর্ম আসায় আর আবেদন করলেন না। ভাগ্যের পরিহাস, পরবর্তী জীবনের এই কিংবদন্তি চিকিৎসক কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস পরীক্ষায় ফেলও করেছিলেন। ভেঙে পড়েননি, ডাক্তারি পড়ার বাসনাও ত্যাগ করেননি।
.
এমবিবিএস পাশ করার পরে ডাক্তারি পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। তাঁর তখন মাসিক আয় ছিলো ২ টাকা। দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করে আরও বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে মাত্র ১২০০ টাকা হাতে বিলেতে পাড়ি দিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। ডাক্তার হবেন, মানুষের সেবায় নিয়োজিত করবেন জীবন। অদম্য চেষ্টা তাঁকে ফিরিয়ে দেয়নি। বিলেত থেকে মাত্র দুবছরের মধ্যে কলকাতায় ফিরে আসেন এমআরসিপি আর এফআরসিএস ডিগ্রি নিয়ে।
.
কলকাতা ফিরেই মাত্র ৫ টাকা বেতনে ডাক্তারি পেশায় যুক্ত হলেন তিনি। তখন কলকাতার খ্যাতনামা এক ডাক্তারের বাড়িতে প্রায়ই যাতায়াত ছিল তাঁর। বয়সের স্বভাবে সেই ডাক্তারের মেয়ের প্রেমে পড়লেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। শোনা যায় মেয়েটির নাম ছিল কল্যাণী। কিন্তু সেখানেও একরাশ হতাশাই প্রাপ্য ছিল তাঁর জন্য। মেয়েটির বাবা তখন কলকাতার মস্ত বড় ডাক্তার। যুবক ডাক্তার বিধানচন্দ্রকে ডেকে তাঁর মাসিক আয় জিজ্ঞাসা করলেন। মাত্র ৫ টাকা আয় শুনে হেসে মেয়ের বাবা বললেন, তাঁর মেয়ের সারাদিনের হাত খরচও ৫ টাকা নয়।
.
শেষমেশ মেয়ের বাবার অনিচ্ছায় মনে মনে ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে স্বপ্নের বুননে ছেদ পড়লো তাঁর। সেদিন ফিরে এসেছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। অদম্য সংকল্প নিয়েছিলেন জীবনে অন্য কোন নারীকে বিয়ে করবেন না। সব ভুলে পা রেখেছিলেন রাজনীতিতে। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের কাছে রাজনৈতিক দীক্ষা লাভ করেছিলেন তিনি। এর কিছুদিনের মধ্যে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। মহাত্মা গান্ধির ডাকে কংগ্রেসেও যোগ দিলেন।
.
চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর দেশবন্ধুর একটা ছবি বিক্রি করে বিধানচন্দ্র কিছু টাকা তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। চিত্তরঞ্জনের একটা ছবি নিয়ে বিধানচন্দ্র রায় রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে বললেন ‘এর উপর একটা কবিতা লিখে দিন।’
রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ডাক্তার, এ তো প্রেসক্রিপশন করা নয়। কাগজ ধরলে আর চটপট করে লেখা হয়ে গেল!’
.
বিধানচন্দ্র রায় বললেন ‘বেশ অপেক্ষা করছি।’
কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ছবির উপর সেই অপূর্ব কবিতা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
‘এসেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’

.
শোনা যায়, দিল্লির এক পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়ে গভর্নর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন বিধানচন্দ্র রায় সম্বন্ধে এতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে যে তিনি জওহরলাল নেহেরুকে বলেছিলেন, লাট সাহেবের পদে না বসিয়ে একে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দিন।
.
প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের পর বিধানচন্দ্র এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন সুভাসচন্দ্র বসুর জন্মদিনে মানে ১৯৪৮ সালের ২৩শে জানুয়ারি। আর এর মাত্র সাতদিন পরেই নিহত হলেন মহাত্মা গান্ধী। যখন ডা. বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন তার আগের মাসে তাঁর ডাক্তারি থেকে আয় হয়েছিলো ৪২০০০ টাকা অথচ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নিজেই নিজের মাসিক বেতন ঠিক করলেন ১৪০০ টাকা। তখন তাঁর বয়স ৬৫। কাছের মানুষদের বলতেন, ‘দশটা বছর কম হলে ভাল হত।’ তার উপর তখন তাঁর চোখের সমস্যা, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করতেন এবং খুব লম্বা কিছু পোড়তে পারতেন না। এই জন্যই বোধ হয় নিন্দুকেরা প্রচার করেছিল, ডা. রায় বাংলার বিখ্যাত লেখকদের কোনও লেখাই পড়েন না!
.
অথচ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি খুবই খাতির করতেন। এবং স্বাভাবিক সৌজন্যে বলতেন, লেখার অভ্যাসটা যেন ছেড়ে দেবেন না। সত্যজিৎ রায়ের তখনকার অসমাপ্ত চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ তিনি দেখেছিলেন এবং সরকারি নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে এই চলচ্চিত্রের সরকারি প্রযোজনার ব্যবস্থা করেছিলেন। এর আগে বিভূতিভূষণ যে তখন মারা গেছেন তাও তিনি জানতেন না, বইটি পড়া তো দূরের কথা। একবার কলকাতার পুলিশ সদর দফতর লালবাজারের একটি বিশেষ বিভাগ পত্রপত্রিকা ও বাংলা বইয়ে আপত্তিকর অংশ সম্বন্ধে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলো।
.
বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধ সান্যাল পুলিশের নজরে পড়েছেন বলে গুজব রটলো। তাঁরা তখন ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে তারাশঙ্কর ও সজনীকান্ত দাসকে ধরলেন। এরপর লেখকরা দলবদ্ধ হয়ে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, ‘নামী সাহিত্যিকদের বই অশ্লীল বলে বাজেয়াপ্ত হবে এ কেমন কথা!’
.
বিধানচন্দ্র বললেন, ‘তাই নাকি, এটা তো বড় অন্যায় ব্যাপার। রুনুকে ডাকো।’ পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র সচিব রুনু গুপ্ত আসতেই ডা. বিধানচন্দ্র রায় বললেন, ‘এ কি সব তুঘলকি কাণ্ড। বিখ্যাত লেখকদের বই পুলিশ বাজেয়াপ্ত করছে, গ্রেফতারের ভয় দেখাচ্ছে।’
.
রুনু গুপ্ত বললেন, ‘আইনের ধারা অনুযায়ী পুলিশ কাজ করছে।’ বিধানচন্দ্র রায় তাঁকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘ওসব আইনটাইন কী আছে দেখে পাল্টাতে বলো। তাঁদের অসম্মান করে এবং চটিয়ে সরকার চালানো যায়?’ এরপর তারাশঙ্কর ও অন্যান্য লেখকদের বললেন, ‘আমি বলে দিচ্ছি, পুলিশ আপনাদের আর বিরক্ত করবে না।’ এরপর সচিবকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘তুমি পুলিশকে বলে দাও, তাঁদের বাদ দিয়ে সিনেমার পোস্টারে যে সব প্রায়-ল্যাংটো মেয়েদের ছবি ছাপে সেগুলো আটকাতে।’
.
১৯৪৮ থেকে বাংলার ইতিহাসের কঠিনতম সময়ে বিধানচন্দ্র রাইটার্সের লালবাড়িতে সাড়ে ১৪ বছর বছর বসেছিলেন। প্রথম দু’বছর তিনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছিলেন। জমি বিক্রি করলেন, শেয়ার বিক্রি করলেন, এমনকী শৈলশহর শিলং-এর প্রিয় বাড়িটাও বিক্রি করে দিলেন।
.
মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে বাড়িতে বিনা পয়সায় নিয়মিত রোগী দেখতেন সকাল সাতটায়। এবং তাঁর জন্য দু’জন ডাক্তারকে নিজের পয়সায় নিয়োগ ও করেছিলেন। ব্যক্তিগত সহকারীর মাইনে দিতেন নিজের পকেট থেকে।
.
কে পি টমাসের একটা লেখা পড়লে বোঝা যায়। তিনি লিখেছিলেন ‘একদিন দিল্লি-বোম্বাই পরিভ্রমণ করে বিমানে ফিরলেন দুপুর একটায়। সঙ্গে সঙ্গে রাইটার্সে চলে গেলেন, ফিরলেন সাড়ে ৭টায়। দু’একটা ছবির ক্যাপশনের জন্য লেখক টমাস তাঁর বাড়িতে বসেছিলেন। কিন্তু ডা. বিধানচন্দ্র রায় ফাইলের মধ্যে ডুবে আছেন। রাত সাড়ে ৯টা। তখনও বিধানচন্দ্র রায় পড়েই যাচ্ছেন। লজ্জিত টমাস বললেন, ‘এখন আপনার শোবার সময়।’ বিধানচন্দ্র রায়ের উত্তর, ‘তা হলে আমার কাজগুলো কে করবে?’
.
টমাস বললেন, কাজের একটা সীমা থাকা উচিত। আপনি বিয়ে করেননি। তাই চলছে। আপনার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা থাকলে তাঁরা আপনাকে বিশ্রামের কথা বলতেন। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের তাৎক্ষণিক উত্তর, ‘আপনি জানেন না, কাজের সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে!’
.
অথচ এতো বিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জীবন যাত্রা ছিলো অতি সাধারণ। ভোর পাঁচটায় উঠে গীতা ও ব্রহ্মস্তোত্র পড়ে, গোসল সেরে, সাড়ে ৬টায় সকালের খাবার খেয়ে, দু ঘণ্টা ধরে বিনামূল্যে ১৬ জন রোগী দেখে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আসতেন সবার আগে।
.
সকালের নাস্তায় থাকতো একটি টোস্ট, একটি ডিম, বেলের শরবত অথবা পেঁপে ও এক কাপ কফি। খুবই মিতব্যয়ী ছিলেন তিনি। সাধারণত বাইরে নিমন্ত্রণ খেতে যেতেন না। বলতেন, ‘হসপিটালিটি অনেক সময় হসটিলিটি না হয়ে যায়।’ রাইটার্সে সকাল ন’টা থেকে দশটা জরুরি ফাইল দেখতেন তিনি। তারপর সচিবদের সঙ্গে আলোচনা।
.
দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথাবার্তা চলত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা, তারপর তাঁর চেম্বারে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজন ও বিশ্রাম করতেন। পরবর্তী সময়ে অসুস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ি চলে এসে খাওয়াদাওয়া করে সামান্য বিশ্রামের পরে আবার রাইটার্স। এবং সেখানে রাত ৮টা পর্যন্ত। দিনে কয়েকবার গোসল করতেন দিনে। এবং সবাইকে বলতেন রাত ন’টার মধ্যে শুয়ে পড়া ভালো।
.
ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের প্রভাবে রাইটার্সের বড় বড় অফিসাররাও অভ্যাস পাল্টালেন। এর আগে তাঁরা ১১টার আগে হাজিরা দিতেন না। তখন ১১টায় এসে বড় বড় অফিসাররা ১টায় দুপুরের খাবার খেতে বেরোতেন, ফিরতেন ৩টায় এবং সাড়ে চারটে বাজলেই ছুটি হতো।
.
পুণের আগা খাঁ প্যালেসে তখন বন্দী মহাত্মা গান্ধী, সব রকম ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, মৃত্যুর খুব কাছে যেন চলে গেছেন। ইংরেজ জেলার তাঁর চিতার জন্য চন্দন কাঠও জোগাড় করে রেখেছেন। গান্ধীকে বিধানচন্দ্র রায় বললেন, ‘একটা ওষুধ তিনি গ্রহণ করেন।’ কিন্তু গান্ধী রাজি নন, কঠিন ভাবে বললেন, ‘কেন আমি তোমার কথা শুনব? তুমি কি এদেশের চল্লিশ কোটি মানুষকে আমার মতো বিনামূল্যে চিকিৎসা করো?’
বিধানচন্দ্র রায় বললেন ‘না গান্ধীজি, সবাইকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, কিন্তু মোহনদাস গান্ধীকে চিকিৎসা করার জন্য এখানে আসিনি, আমি এসেছি এমন একজনকে চিকিৎসা করতে যিনি আমার কাছে আমার দেশের চল্লিশ কোটি মানুষের প্রতিনিধি।’
.
গান্ধী উত্তরে বলেছিলেন: ‘মফস্বল আদালতের থার্ড ক্লাস উকিলের মতন তর্ক করছো কেন? ঠিক আছে, ওষুধ নিয়ে এসো, আমি খাবো।’
.
আর একবার ডা. বিধানচন্দ্র রায় বলেছিলেন, “উকিল হয়ে আমি হয়তো আরও অনেক বেশি রোজগার করতে পারতাম, কিন্তু তা হলে আমি তো মহামানব গান্ধীর চিকিৎসা করতে পারতাম না।’ একবার স্বয়ং গান্ধীর সামনে বিধানচন্দ্রের দেহ প্রশস্তি করে সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন, ‘বিধান, তুমি হাসলে এখনও গালে টোল পড়ে ব্যাপারটা কী?” ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় চটাচট দিয়েছিলেন, সেই টোলে কেন বয়োজ্যেষ্ঠর নজর পড়ে যায়।’
.
জওহরলাল নেহরু ও বিধানচন্দ্র রায়ের চিঠিগুলো খুঁটিয়ে পড়লে অনেক ঘটনা পাওয়া যায়, বহু কিছুর মধ্যেই তাঁর বন্ধুত্ব যে কি অনন্য তা তেড় পাওয়া যায়। চিঠিতে বহু কথার মধ্যে নেহেরু বিধানচন্দ্র রায়কে লিখেছেন,
.
‘কলকাতা থেকে গোটা বারো ডাব পাঠিয়ো। ইন্দিরার পেটের রোগ কমছে না।’ এক সময় গোটা ভারতের ধারণা ছিল, কলকাতার ডাবই পৃথিবীর সেরা। পরের দিন একজন বিড়লা দেখা করতে এলে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বললেন গোটা কয়েক ডাব আজকেই প্রাইভেট বিমানে দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য।
.
পরিবারের প্রিয় চিকিৎসক বিধানের ওপর এতই বিশ্বাস যে ইন্দিরার অস্ত্রোপচারের জন্য নেহরু তিনি কলকাতাকেই নির্বাচন করেছিলেন। আবার নানা বিষয়ে দু’জনের মধ্যে বাকি বিতান্ডাও হতো। সেই সব চিঠি এত দিন পরে পড়তে পড়তে কি যে ভালো লাগে!
.
মুখ্যমন্ত্রী হবার কিছুদিন পরেই একবার বিধানচন্দ্র রায়ের জ্বর হয়েছিলো। অর্থমন্ত্রী নলিনীরঞ্জন সরকার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার অসুখ হলে কে আপনার চিকিৎসা করে?’
ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ বিধান রায়। আয়নার দিকে তাকাই আর অমনি সেই প্রতিচ্ছবি বি সি রায় আমার চিকিৎসা করে।’
.
একবারের ঘটনা। হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে এক বীমা কোম্পানির বোর্ড মিটিং চলছে। সেখানেই তিনি বললেন, ‘এক রোগী একটা ছুরি গিলে ফেলেছেন। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ প্রথম ডোজ দিল, অমনি পেটের ছুরির ফলার ধারটা ভোঁতা হয়ে গেল। দ্বিতীয় ডোজে ছুরির ফলাটা কাঠের হাতলের ভাঁজে ঢুকে গেল। তৃতীয় ডোজের পরে ছুরিটি সর সর করে বেরিয়ে এল রোগীর কোনও ক্ষতি না করে!’
.
নিজের পেশার ডাক্তারদের নিয়েও তিনি ভীষণ মজা করতেন। হায়দরাবাদের এক সভায় তিনি ভাষণ শেষ করেছিলেন এই গল্পটি বলে, ‘লন্ডনের উপকণ্ঠে একদল গুন্ডা পিস্তল দেখিয়ে একটা বাস থামালো। তাদেরই একজন বাসে উঠে প্রত্যেক যাত্রীর টাকার ব্যাগটা হাতিয়ে নিচ্ছিল। সবার শেষে বাসের শেষ প্রান্তে এক বুড়োর কাছে দাঁড়াল। বুড়ো তার ব্যাগ খুলে দিতে দিতে একটু হেসে বলল, “দেখো ছোকরা তোমার বিনয় দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি ডাক্তার। আমরা ডাক্তাররা মানুষের টাকা আর জীবন দুই-ই নিয়ে থাকি।’
.
বিধানচন্দ্র রায় ছোটবেলা থেকেই অসুস্থ থাকতেন মাঝেমাঝে। তাঁর প্রথম হার্ট অ্যাটাক করেছিল ১৯৩০ সালে, তখন তিনি কংগ্রেসের কাজে আহমেদাবাদ থেকে দিল্লির পথে। এই হার্ট অ্যাটাক নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। তাঁর দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাক হয় যখন মুখ্যমন্ত্রী তিনি। এবারেও তাঁকে অমানুষিক পরিশ্রম থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে যেতে হয়নি। শুধু দৈনিক রুটিনের পরিবর্তন করে দুপুরে ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করতে আসতেন এবং বাড়িতেই ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করে আবার রাইটার্সে যেতেন।
.
কিন্তু রাইটার্সে সেদিনই ছিলো তাঁর শেষ দিন। নিমপীঠের এক সন্ন্যাসীকে বলেছিলেন, ‘শরীর যেমন ঠেকছে কাল নাও আসতে পারি।’ মাথায় তখন যন্ত্রণা।
পরের দিন তাঁর বাড়িতে ডাক্তার শৈলেন সেন ও যোগেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডাকা হলো। তাঁদের সিদ্ধান্ত হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ৩০শে জুন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় তাঁর প্রিয় বন্ধু ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বললেন, ‘‘আমি তিরিশ বছর হৃদরোগের চিকিৎসা করে আসছি, আমার কতটা কী হয়েছে আমি তা ভাল করেই বুঝতে পারছি। কোনও ওষুধই আমাকে ভাল করতে পারবে না।’
.
ওই দিন তাঁর আত্মীয়স্বজনরা এলেন। গৃহকর্মী কৃত্তিবাসের হাত থেকে এক গ্লাস মালটার রস খেলেন। বন্ধু সার্জন ললিতমোহনকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, ‘ললিত আমার গুরুও বটে, ওর কাছ থেকে কত কিছু শিখেছি।’
.
তারপর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে বললেন, ‘আমি দীর্ঘ জীবন বেঁচেছি। জীবনের সব কাজ আমি সমাধান করেছি। আমার আর কিছু করার নেই।’ এরপরেই চিরতরে ঘুমিয়ে গেলেন তিনি।
.
বিধানচন্দ্র রায় বলতেন, ‘তোমার সাধ্যমতো চেষ্টা করো, এবং বাকিটা ভগবানের উপর ছেড়ে দাও।’ কখনোবা কলকাতা মেডিকেল কলেজে তাঁর প্রিয় শিক্ষক কর্নেল লুকিের একটা উক্তির কথা উল্লেখ করে বলতেন, ‘হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে চেষ্টা করে হেরে যাওয়া ভাল।’ মা বাবার কাছ থেকে তিনটি জিনিস শিখেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। বলতেন, মা বাবার কাছে আমি শিখেছিলাম তিনটি জিনিস। ‘স্বার্থহীন সেবা, সাম্যের ভাব এবং কখনও পরাজয় না মেনে নেওয়া।’
.
আজ কিংবদন্তি চিকিৎসক, আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের রূপকার বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম ও প্রয়াণ দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধা নতচিত্তে স্মরণ করি এই কিংবদন্তি চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদকে। 🙏💕
.

আহমেদ ইশতিয়াক

সূত্র – কর্মযোগী বিধানচন্দ্র/ নন্দলাল ভট্টাচার্য
বিধানচন্দ্র রায় জীবন ও সময়কাল/ নীতিশ সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.