আজকের মতো সেদিনটাও ছিল #১৩ই_ডিসেম্বর, ঠিক বিশ বছর আগে ২০০১ সালের এক শীতল দিন। স্থান নয়াদিল্লী……
আর পাঁচটা দিনের মতো সেদিনও সংসদ ভবনের গেটে অতন্দ্র পাহারায় CRPF এর জওয়ানরা, ব্যাতিক্রম একটাই, এক নম্বর গেটে পাহারায় ছিল এক মহিলা কনস্টেবল । এই গেটটি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও সাংসদদের জন্য নির্দিষ্ট । সেসময় মহিলা পুলিশদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেবার নিয়ম না থাকায় উনি সেদিন শুধু একটা ওয়াকি টকি নিয়ে ডিউটিতে ছিলেন ।

ঘড়িতে তখন বেলা তিনটে । কিছুক্ষণ আগেই অধিবেশন শেষ হয়েছে। বেরিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী ও বিরোধী দলনেত্রী সোনিয়া গান্ধী। তবে বেশিরভাগ মন্ত্রী ও সাংসদ তখনো ভেতরে। ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হারিন পাঠক। একটা সাদা ambassador গাড়ি এসে দাঁড়ালো এক নম্বর গেটের সামনে । লালবাতি আর সামনের কাচে Home Ministry স্টিকার দেখে সান্ত্রীরা খুলে দিল গেট । প্রবেশ করেই গাড়িটা দ্রুত বাড়িয়ে দিল গতি আর তখনই ঐ মহিলা কনস্টেবলের চোখে পড়ল গাড়ীর পাঁচ আরোহীর হাতে ধরা রয়েছে কারবাইন ! বুঝলেন কি সাংঘাতিক বিপদ ঘটতে চলেছে ।

এক মুহূর্ত দেরী না করে আলার্ম বাজিয়ে দিলেন উনি, তারপর ছুটলেন মূল ভবনের কাছে এগারো নম্বর গেটের দিকে। সেখানে সেদিন পাহারায় ছিল সুখবিন্দর সিংহ । হাতে ধরা ওয়াকি টকিতে সতর্ক না করে ছুটতে ছুটতেই চীৎকার করতে লাগলেন তিনি….. একবারের জন্য ভাবেননি নিজের নিরাপত্তার কথা । মুহূর্তের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গী আক্রমণ হয়েছে ভারতীয় সংসদ ভবনে। সমস্ত বিল্ডিং-এর গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।

সুখবিন্দর সহ অন্য সান্ত্রীরাও চীৎকার শুনতে পেয়ে পোস্ট থেকে বেরিয়ে এসে পজিশন নিলো, কিন্ত সেই চীৎকার কানে গেছিলো গাড়ীর আরোহীদেরও ! নিমেষে গতি কমলো গাড়ির আর তারপর তারা ধাক্কা মারে উপরাষ্ট্রপতি কৃষাণ কান্তের গাড়িতে। নেমে এসে তারা এবার মহিলাকে লক্ষ্য করে শুরু করলো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিবর্ষণ ।
শরীরে এগারোটা বুলেট নিয়ে সংসদ চত্বরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো বত্রিশ বছরের কমলেশ কুমারী যাদব ! হাতে ধরা ওয়াকি টকি থেকে তখনও ভেসে আসছে অন্য পোস্ট থেকে সান্ত্রীদের সতর্ক বাণী, “পিছে হট কমলেশ…….. পিছে হট!”
এই বীরাঙ্গনা যে পিছে হঠতে শেখেনি ! ‌????

তিনঘন্টার লড়াইয়ের শেষে জঙ্গীদের দমন করে ভারতীয় সেনা। গুলি চালিয়ে সেখানেই মেরে ফেলা হয় পাঁচ জঙ্গীকে। সেই সাথে প্রাণ হারান ৬ জন পুলিশ অফিসার সহ দু’জন নিরাপত্তাকর্মী। আহত হন প্রায় ১৮ জন। হামলার কড়া নিন্দা করে বিবৃতি দেয় বিশ্বের বহু দেশই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আদবানি লোকসভায় বলেছিলেন, ‘এটা এখন স্পষ্ট যে সংসদ ভবনে সন্ত্রাসী হামলা পাকিস্তান সমর্থিত সন্ত্রাসী সংগঠন, লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জইশ-এ-মোহাম্মদ যৌথভাবে চালিয়েছিল৷ জঙ্গীরা সবাই ছিল পাকিস্তানি।’

কমলেশের এই আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি । শুধুমাত্র তার সময়োচিত সতর্কবার্তার জন্যই সেদিন বেঁচে গেছিল দেশের একঝাঁক রাজনীতিকের জীবন । ২০০২ সালে রাষ্ট্রপতি তাঁর স্বামী ও দুই কন্যার হাতে তুলে দিলেন মরণোত্তর #অশোকচক্র “, বীরত্বের সর্বোচ্চ সম্মান । দেশের প্রথম মহিলা হিসেবে এই পুরস্কার পেলেন CRPF এর মহিলা কনস্টেবল #কমলেশকুমারী। ‌????

তবে এই হামলার ষড়যন্ত্রকারীদের সাজা রদ করতে শিল্পী অভিনেতা ও বুদ্ধিজীবিরা যে অগাধ মেহনত করেছিলেন তার এক শতাংশও যদি এই বীরাঙ্গনার স্মরণে করতেন, হয়তো তাঁর বিদেহী আত্মা একটু শান্তি পেতো ।‌????????

জঙ্গী নিকেশ তো হল। কিন্তু পেছনে কারা? পুলিশ এফআইআর দায়ের করে। প্রথমে জঙ্গী সংগঠনগুলো এই ঘটনার দায় নিতে অস্বীকার করে, শুরু হয় তদন্ত। কয়েক দিনের মধ্যে, দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল চার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। এদের ব্যবহৃত গাড়ি এবং মোবাইল রেকর্ড ট্র্যাক করা হয়েছিল। তাতে জঙ্গী কার্যাকলাপের সঙ্গে যোগসূত্রের প্রমাণ মেলে। এই চারজন হলো মোহাম্মদ আফজল গুরু, প্রাক্তন এক JKLF জঙ্গী, তার চাচাতো ভাই শওকত হোসেন গুরু, শওকতের স্ত্রী আফসান গুরু এবং এসএআর গিলানি, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবির শিক্ষক।

আর চক্রের মাথা রাষ্ট্রসংঘ যাকে “আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী” ঘোষণা করেছে সেই কুখ্যাত জঙ্গী, যার হাতে লেগে রয়েছে কমলেশ কুমারীর রক্ত! রাহুল গান্ধীর মাসুদজী ওরফে পাকিস্তানের রত্ন মওলানা মাসুদ আজাহার ! আফশোষ, এই বীরাঙ্গনারা বারে বারে জন্ম নিয়েছেন দুর্ভাগা এই দেশে! ‌প্রয়াণ দিবসে আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন ????
কলমে ✍????© স্বপন সেন ????

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.