বহুবিধি চিত্র বনায়কে হরি রচিন ক্রীড়া রাস ।
ঝুলত ঝুলত বহু কল্পবীতে মনহি নহি ছাড়ৈ আস ।
কবহুঁক উচে কবহুঁকে নীচে সুখ দুখ লে জায় |
কহৈঁ কবীর সরসী বিনতী শরণ হরি তুব আয় ।
ঝুলত গণ গংধর্ব মুনিবর ঝুলত সূরজ চংদ ।
আপ নিৰ্গুণ সৰ্গুণ হোকে ঝুলিয়া আপ গোবিন্দ ।
শশী সুর রৈনী শারদী তহাঁ তত্ত্ব পরলৈ নাহি ।
সাধু সংগতি খোজি দেখহু তহঁ সংত বিরলে জাহি।
সাধকের সকল নিবেদন কেবলমাত্র যদি আমিত্বের জন্য হয় তবে তাঁর হৃদয়ে তা বেদনার মন্ত্রের মতো স্পন্দিত হয়। এক পরিপূর্ণকে ঘিরে অপূর্ণের ওই রাসলীলা, পূর্ণচন্দ্রের বুকে আলো ছায়ার ঝুলন। মহামায়ার সংসারে অবিদ্যারূপী মায়া অপূর্ণতা এবং বিদ্যারূপী মায়ার পূর্ণতা লীলা , এতেই দোল খাচ্ছে সমগ্র বিশ্ব। যখনই অবিদ্যা মায়ার জাল থেকে বাইরে বেরিয়ে বিদ্যার মায়ার উন্নীত হয় জীবাত্মা , তখনই পরিপূর্ণতাতে মিলিত হয়, পূর্ণিমা চন্দ্রের ন্যায় , তখনই ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা যায় , লীলাময়ী অন্তরালে স্নিগ্ধ জোৎস্না হয়ে হাসেন। পূর্ণ , অপূর্ণের লীলা চলল , তরঙ্গ উঠল, ফাঁকে ফাঁকে মিলন পথের বাঁকে বাঁকে। মালার সব ফুল একের সঙ্গে আরেকের ব্যবধান ঘুচিয়ে নিরেট হয়ে গেল। সাত সুর, সাত রঙ এক হয়ে গেল। বিচিত্রকে নিয়েই তো রাস, দুইকে নিয়েই তো ঝুলন, রাগ – রাগিনী – ফুল- রঙ নিয়েই দোল , খণ্ড অখণ্ডের পূর্ণিমা।
ঝুলহি জীব জহান জঁহ লগকতহুঁ না দেখো থিত বীর।
যতদূর পর্যন্ত ঝুলনায় ঝুলিতেছে জীব এবং জগৎ ততদূর পর্যন্ত কোথায়ও দেখিতেছি না স্থিতি ও ঠাঁই।
সাঁই কেয়া , বহুতগুণ ঔগুণ কোই নাহি ,
জো দিল খোঁজ জোঁ আপনা সব ঔগুণ মুঝমাহিঁ।।
পূর্ণচন্দ্র সে নিজের আলো ধরে দেখিয়ে চলে- বলে, আমি নিখুঁত নই, কিন্তু তবু আমি নিষ্কলুষ, নিষকলঙ্ক। আমি ক্ষয়িত হয়েও অক্ষয়। নিখুঁত কিছু নেই, অসুন্দরের মাঝে সুন্দরের কামনা। অজানা যুদ্ধ ক্ষেত্রে যোদ্ধা স্বামী যুদ্ধে যায় , প্রিয়া কোন সুদূরে বসে তাঁর মঙ্গল কামনা করেন। কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্থীর ক্ষয়িত চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে উপবাসী স্ত্রী কামনা করেন ক্ষয়ে হোক বা অক্ষয়ে তাঁর স্বামী যেন চাঁদের মতো জীবিত থাকেন , আহত হলেও অন্তঃত যেন যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে জীবিত ফিরে আসেন গৃহকোণে। পূর্ববঙ্গের কোথাও কোনো নাম না জানা গ্রামে মাঘী পূর্ণিমার দিন কোনো মা শীতল রাত্রে পূর্ণ চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে সন্তানের মঙ্গল কামনায় চন্দ্রার্ঘ্য প্রদান করেন। আষাঢ় মাসের শুক্ল দ্বিতীয়ার দিন জগন্নাথ দেবের গুন্ডিচা মার্জন হয়। সেই দিন বঙ্গের বহু স্থানে মনোরথ দ্বিতীয়া ব্রত পালিত হয়।শাস্ত্রমতে ভগবান বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের আরাধনায় এক এক গ্রহের শুভফল লাভ হয়। কৃষ্ণ অবতারের আরাধনায় চন্দ্রের শুভফল মেলে। মনোরথ দ্বিতীয়া ব্রতের দিন কৃষ্ণকে পূজা করে চন্দ্রদেবের শুভফল লাভ হয়।
ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া, আছয়ে যে জন,
কেহ না দেখয়ে তারে।
প্রেমের পিরীতি, যে জন জানয়ে,
সেই সে পাইতে পারে।।
পিরীতি পিরীতি, তিনটী আখর,
জানিবে ভজন সার।
রাগ মার্গে যেই, ভজন করয়ে,
প্রাপ্তি হইবে তার।।
আলোচ্য প্রবন্ধের প্রথম তিন পর্বে আমি পূর্ববঙ্গে পৌষ পূর্ণিমায় ধান্যপূর্ণিমার ব্রতকথা বা চন্দ্রপূজার কথা আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমি ধানাই পূর্নিমার ব্রত নিয়ে আলোচনা করব। এই বঙ্গেও এই ব্রত প্রায় লুপ্ত। তবুও একবার শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করি। এই ব্রতকথা পূর্ব আলোচিত ব্রতের থেকে কিছু পৃথক। ওই যে বলেছিলাম স্থান কাল পাত্রভেদে ব্রতের নিয়ম, ধরণ, ধারণ, আচার , বিচার, কথা, ছড়া সবই পরিবর্তন হয় , কিন্তু মূল বিষয় একই থাকে।
পৌষ মাসের পূর্ণিমার দিন উপবাস করে সন্ধ্যার সময় পূর্ণিমা গোঁসাইয়ের পূজা করতে হয়। অবশ্য শাস্ত্রে পূর্ণিমা গোঁসাই বলে কোনো দেবতার নাম নেই। পুরোহিতগণ ব্রতনী দিয়ে নারায়ণের পূজা করে থাকেন। উঠানে একটি কঞ্চি রোপন করে ধানের ছড়া সাজাতে হয়। কঞ্চির মূলে একটি বেদিকা প্রস্তুত করে একটি পুকুর কাটতে হয়। তাকে দুগ্ধ পূর্ণ করে দিতে হয়। দুগ্ধের পরিমান অনুসারে পুকুর ছোট বড় করা যায়। পূজান্তে ব্রতী বা ব্রতনীকে এক – পাক – হব্যিষান্ন ভোজন করতে হয়। তবে ভোজন কালে শৃগাল ডাকলে আর খেতে নেই।
এক যে ছিল ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী – তারা ছিল বড় দুঃখী। এমন দুঃখ ছিল যে , দিনান্তে দুটি শাক ভাত জুটত। কোনোদিন জল খেয়ে কাটত।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়- হাঃ হতষ্মী …দুঃখ যায় না।
একদিন ব্রাহ্মণ গিয়েছেন ভিক্ষায় – আর আসে না।পূর্বের সূর্য্য পশ্চিমে ঢলে পড়ল। এমন সময় অপর এক দ্বিজ এসে ব্রাহ্মণীকে জিগ্যেস করলেন – মা তুমি এমন দুয়ারে বসে কার জন্য কাঁদ? ব্রাহ্মণী এতে ক শুনে নিজের দুঃখ দারিদ্র্যের কথা বলে ডুকরিয়ে কেঁদে উঠলেন। তারপর বললেন – বামুন গিয়েছে ভিক্ষায়, বুড়া মানুষ, তায় বেলা ভাঁটি পড়ে এল ,তাই ভাবচি – উপোস করে , রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে কোথা না জানি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েচে।
এমন শুনে দ্বিজবর বললেন – আঃ, বড় দুঃখ তোমার মা গো। এক কাজ করো – তোমার বামুন আসলে তাকে পূর্ণিমা গোঁসাইয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিও। তিনি তোমাদের দুঃখ দূর করবেন। আর পথের খবর !সে পথিক দেবে….
এই বলে সেই দ্বিজবর চলে গেলেন। এদিকে হয়েছে এক কাণ্ড! সেইদিন দুঃখী ব্রাহ্মণ এত ভিক্ষা পেলেন যে , ভিক্ষার ঝুলির ভার স্কন্ধে বহন করে আনতে পারছিলেন না। যে গৃহস্থ দিত এক মুঠ , সে সেদিন দিয়েছে দশ মুঠ, যে মুখের উপর কপাট দিত – সেও কিছু দিল।
ভগবান সদয় হয়েছেন। ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ খুশি হয়ে গৃহে এলেন। ব্রাহ্মণী ব্রাহ্মণ আসতেই সব কথা বললেন। শুনে ব্রাহ্মণ বললেন – তুমি বড় বোকা। যিনি এসেছিলেন তিনিই পূর্ণিমা গোঁসাই। তুমি তাঁকে চিনতে পার নি।
ব্রাহ্মণী নিজের কপাল কুটে তখন ব্রাহ্মণকে পূর্ণিমা গোঁসাইয়ের বাড়ি পাঠালেন।
পথে দেখলেন এক মস্ত দীঘি-কিন্তু জলে দুই যুবতী একটি কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রাহ্মণ তাঁদের নিকট জিজ্ঞাসা করলেন- পূর্ণিমা গোঁসাইয়ের বাড়ি কোনদিকে, কত দূর? উত্তরে তাঁরা ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করলেন – কেন আপনি সেখানে যাচ্ছেন ঠাকুর ? ব্রাহ্মণ বললেন – দিন, মাস , বছর যায় ; আমার পোড়া কপাল দুঃখ যায় না। তাই আমি পূর্ণিমা গোঁসাইয়ের বাড়ি যাচ্ছি, দুঃখের কারণ ও কিনারা করবার জন্য। যুবতীরা ভিজে কাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল – ও ঠাকুর তুমি আমাদের কথা বলো তাঁকে। আমাদের এমন দুঃখ দূর হবে কিসে ? ব্রাহ্মণ আচ্ছা বলে পথ চলতে শুরু করলেন।
পথ চলতে লাগলেন ভিখারী ব্রাহ্মণ। পথে দেখলেন একটি কুমির, একটি শিয়াল , কলাবাগান, ধানক্ষেত , গাভী ও একটি আম গাছ তারা সকলে পথ দেখিয়ে দিয়ে তাদের দুঃখ কেন হয়েছে আর কেমনই বা সেই দুঃখ দূর হতে পারে তা জিজ্ঞাসা করতে বললে।
ব্রাহ্মণ পূর্ণিমা গোঁসাইয়ের গৃহে গিয়ে নিজের কথা যেমন বললেন, তেমন পথিকদের কথা বলতে ভুললেন না ….
পূর্ণিমা গোঁসাইয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে আবার একে একে সকল পথিক ব্রাহ্মণকে ধরে বসলো দুঃখের কারণ জিজ্ঞাসা করে। পূর্ণিমা গোঁসাই যেমন বলে দিয়েছেন, তেমন ব্রাহ্মণ বলতে বলতে বাড়ি ফিরতে লাগলেন।
প্রথমেই আম গাছ জিজ্ঞাসা করল তার দুঃখের কথা! তাতে ব্রাহ্মণ বললেন – তোমার গোড়ায় শিকড়ে এক ভান্ড সোনা আছে, তুমি উপুড় হয়ে যদি কোনো ব্রতী বা ব্রতনীকে দান করতে পারো তবেই তোমার ফল পাখি খাবে, পূজায় লাগবে, তোমার বৃক্ষ জন্ম সার্থক হবে । আমগাছ বলল , – আর কোথায় কাকে পাই ঠাকুর ? আমি ভেঙে পড়ি তুমি সোনার ভান্ড নিয়ে যাও।
এরপর গাভীর সঙ্গে দেখা হল। গাভীকে ব্রাহ্মণ বললেন – তোমার দুঃখ যে, ১২ বছর ধরে কেউ তোমাকে দুইতে পারে না এবং কোন বাছুরেও দুধ খায় না, কোন লোকের সেবায় লাগেনা…। তুমি দুধের ভারে দুঃখ পাচ্ছ তার কারণকোন এক সময় তোমার গৃহস্থ গোঁসাই ঠাকুরের ব্রতনীকে দুধ দিতে চাও নি। একসের দুধের পাঁচ সের দাম চেয়েছিলে। সে যাহোক, এখন তুমি কোনো ব্রতী বা ব্রতনীকে একসের দুধ দিলে তোমার দুধ আবার সেবায় লাগবে। এতেক শুনে গাভী ব্রাহ্মণকে অনুরোধ করলে, তার দুধ দোহন করতে। ব্রাহ্মণ তার দুধ দোহন করে তাকে শাপ মুক্ত করলেন।
এইরূপে ধান খেত কলাবাগান ব্রাহ্মণকে এক কাঁদি কলা ও পাঁচ একুশ ছড় ধান দিয়ে অভিশাপ হতে মুক্ত হল।
তারপরে শিয়াল আর কুমিরের সঙ্গে দেখা। শিয়ালকে বললেন, ” তুমি বড় অন্যায় করেছিল….পূর্ণিমা গোঁসাইয়ের পূজার দিন ব্রতী ব্রতনীরা উপবাস করে পূজার শেষ করে আহারে বসেছিলেন , তুমি হুক্কাহুয়া করে ডেকে ভয় দেখিয়েছিলে, তাতে তাঁদের খাওয়া নষ্ট হয়েছিল। কাজেই ১২ বৎসর ধরে তুমি খাইতে পারো নি- তোমার কন্ঠ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এরূপ আর করো না তবে ভালো হবে।
আর কুমিরকে বললেন , “তুমিও বড় অন্যায় করেছিলে…..ব্রতী ব্রতনীরা জল তুলতে এসে তোমার ভয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। তারই পাপে তুমি খালের এপার-ওপার সাঁকো হয়ে আছ । এমন আর করো না ,তবে জলের কুমির জলে যেতে পারবে।
সকলের শেষে যুবতীদের সঙ্গে দেখা হলো ব্রাহ্মণের। তারা জিজ্ঞেস করল , “ঠাকুর তুমি কি আমাদের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলে?” ব্রাহ্মণ উত্তরে বললেন , “হ্যাঁ তা বলেছিলাম । গোঁসাই ঠাকুর বললেন, যখন ঘাটে বসে সন্ধ্যা পাড়ছিল, তখন তোমরা সাঁতার কেটে গিয়ে তাদের গায়ে জল ছিটিয়ে পূজা পণ্ড করেছিলে। তাতেই তোমরা গোঁসাইয়ের অভিশপ্ত হয়েছ। যদি তোমরা ব্রতী বা ব্রতনীর সঙ্গে তার গৃহে গিয়ে সকল নিয়ম মেনে পূজা করো তবেই শাপ ঘুচবে। ” এতেক শুনে সেই দুই যুবতী ব্রাহ্মণের গৃহে গিয়ে ব্রত করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে।
গৃহে ফিরে ব্রাহ্মণ যা কিছু জীবনের চলার জন্য প্রয়োজন , খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান সকলই পেলেন। ব্রাহ্মণ , ব্রাহ্মণী এবং দুটি যুবতী মিলে পূর্ণিমা গোঁসাইয়ের ব্রত পূজা করতে লাগলেন। পৃথিবীর বুকে আড়াই অক্ষর লিখে দিলেন -এই ব্রত যে করবে তার সকল দুঃখ দূর হবে।
দুঃখ যেন জাল পেতেছে চারদিকে;
চেয়ে দেখি যার দিকে
সবাই যেন দুর্গ্রহদের মন্ত্রণায়
গুমরে কাঁদে যন্ত্রণায়।
লাগছে মনে এই জীবনের মূল্য নেই,
আজকে দিনের চিত্তদাহের তুল্য নেই।
যেন এ দুখ অন্তহীন,
ঘরছাড়া মন ঘুরবে কেবল পন্থহীন।
এমন সময় অকস্মাৎ
মনের মধ্যে হানল চমক তড়িদ্ঘাত,
এক নিমেষেই ভাঙল আমার বন্ধ দ্বার,
ঘুচল হঠাৎ অন্ধকার।
সেই যে প্রথম পর্বে বলে ছিলাম, পূর্ণিমা ব্রতের অন্য এক গল্প। সেই গল্পের সাথে এই গল্পের কেমন মিল দেখ….সবাই দুঃখের অন্ত খোঁজে। কিন্তু দুঃখের কি অন্ত হয়? জগৎসংসারের বিধান সম্বন্ধে যখনই আমরা ভেবে দেখতে যাই তখনই, এ বিশ্বরাজ্যে দুঃখ কেন আছে, এই প্রশ্নই সকলের চেয়ে আমাদেরকে সংশয়ে আন্দোলিত করে তোলে। আমরা তাকে জন্মান্তরের কর্মফল বলে জানি–কিন্তু তাতে দুঃখ তো দুঃখই থেকে যায়।
না থেকে যে জো নাই। দুঃখের তত্ত্ব আর সৃষ্টির তত্ত্ব যে একেবারে একসঙ্গে বাঁধা। কারণ, অপূর্ণতাই তো দুঃখ এবং সৃষ্টিই যে অপূর্ণ।
সেই অপূর্ণতাই বা কেন? এটা একেবারে গোড়ার কথা। সৃষ্টি অপূর্ণ হবে না, দেশে কালে বিভক্ত হবে না, কার্যকারণে আবদ্ধ হবে না, এমন সৃষ্টিছাড়া আশা আমরা মনেও আনিতে পারি না।
অপূর্ণের মধ্য দিয়ে নইলে পূর্ণের প্রকাশ হবে কেমন করে?
উপনিষৎ বলছেন, যা কিছু প্রকাশ পাচ্ছে তা তাঁরই অমৃত আনন্দরূপ। তাঁর মৃত্যুহীন ইচ্ছাই এই সমস্ত রূপে ব্যক্ত হইতেছে।
ঈশ্বরের এই যে প্রকাশ, উপনিষৎ ইহাকে তিন ভাগ করে দেখছেন। একটি প্রকাশ জগতে, আর-একটি প্রকাশ মানবসমাজে, আর একটি প্রকাশ মানবাত্মায়। একটি শান্তং, একটি শিবং, একটি অদ্বৈতং।
শান্তম্ আপনাতেই আপনি স্তব্ধ থাকলে তো প্রকাশ পেতেই পারেন না;–এই যে চঞ্চল বিশ্বজগৎ কেবলই ঘুরছে, ইহার প্রচণ্ড গতির মধ্যেই তিনি অচঞ্চল নিয়মস্বরূপে আপন শান্তরূপকে ব্যক্ত করছেন। শান্ত এই সমস্ত চাঞ্চল্যকে বিধৃত করে আছেন বলেই তিনি শান্ত, নহিলে তাঁর প্রকাশ কোথায়।
শিবম্ কেবল আপনাতেই আপনি স্থির থাকলে তাঁহাকে শিবই বলতে পারি না। সংসারে চেষ্টা ও দুঃখের সীমা নাই, সেই কর্মক্লেশের মধ্যেই অমোঘ মঙ্গলের দ্বারা তিনি আপনার শিবস্বরূপ প্রকাশ করছেন। মঙ্গল সংসারের সমস্ত দুঃখ তাপকে অতিক্রম করে আছেন বলে তিনি মঙ্গল, তিনি ধর্ম, নইলে তাঁর প্রকাশ কোথায়?
অদ্বৈত যদি আপনাতে আপনি এক হয়ে থাকতেন তবে সেই ঐক্যের প্রকাশ হত কী করে? আমাদের চিত্ত সংসারে আপনপরের ভেদবৈচিত্র্যের দ্বারা কেবলই আহত প্রতিহত হচ্ছে; সেই ভেদের মধ্যেই প্রেমের দ্বারা তিনি আপনার অদ্বৈতরূপ প্রকাশ করছেন। প্রেম যদি সমস্ত ভেদের মধ্যেই সম্বন্ধ স্থাপন না করত তবে অদ্বৈত কাকে অবলম্বন করে আপনাকে প্রকাশ করতেন?
জগৎ অপূর্ণ বলে তা চঞ্চল, মানবসমাজ অপূর্ণ বলিয়াই তা সচেষ্ট, এবং আমাদের আত্মবোধ অপূর্ণ বলেই আমরা আত্মাকে এবং অন্য সমস্তকে বিভিন্ন ক জানি। কিন্তু সেই চাঞ্চল্যের মধ্যেই শান্তি, দুঃখচেষ্টার মধ্যেই সফলতা এবং বিভেদের মধ্যেই প্রেম।
অতএব এ-কথা মনে রাখিতে হইবে পূর্ণতার বিপরীত শূন্যতা; কিন্তু অপূর্ণতা পূর্ণতার বিপরীত নহে, বিরুদ্ধে নহে, তা পূর্ণতারই বিকাশ। গান যখন চলছে যখন তাহা সমে এসে শেষ হয় নাই তখন তা সম্পূর্ণ গান নহে বটে কিন্তু তা গানের বিপরীতও নহে, তার অংশে অংশে সেই সম্পূর্ণ গানেরই আনন্দ তরঙ্গিত হচ্ছে।
পূর্ণ চন্দ্র আলো ধরে দেখিয়ে দিয়ে চলে আমি নিখুঁত নই, গোল আয়নায় সে পালিসে চোখ ধাঁধিয়ে প্রমাণ করতে চায় আমি নিষ্কলঙ্ক চাঁদ। এই সত্য এবং এই মিথ্যা দুটি পথ হল সব মানুষের সামনে ধরা, নিজের অপরিপূর্ণতার সত্যকে জানা এবং সেটাকে না জানা এই নিয়ে ভেদ হলে রসিকে – বেরসিকে, পন্ডিতে- অপন্ডিতে, সত্য – সত্যের ভাণে -পূর্ণ সুন্দর অখণ্ড সুন্দর অতুলনীয় অনুপম অপরিমেয়, তার পরিপূর্ণ স্বাদ লাভ করলে যখন যে জীবন তখনই সে আপনার অপূর্ণতা খন্ডতা তুচ্ছতা অনুভব করলে! এই অনুভূতি পদে পদে শঙ্কা জাগায় কিন্তু পরিপূর্ণতার দিকে চলার পথে আগল হয়ে থাকে না -দীপশিখা এই শঙ্কা অনুভব করেই সারারাত কাঁপতে থাকে, জ্বলে পুড়ে মরে পরিপূর্ণ আলোর বিরহে এবং সকালে সে মিলিয়ে দেয় বৃহত্তর আলোর আপনাকে। যখন অন্ধকার আলোর মাঝ দিয়ে অভিসার আলোর দিকে, অফুটন্তের অভিসার ফুটন্তের দিকে , তখন পদ্মের মৃনালটি এই শঙ্কা অনুভব করে চলে, – দীপশিখার মতোই কাঁপতে কাঁপতে তার অভিসার – ভয়ে ভয়ে শিউরে ওঠে সে , রয়ে রয়ে সকল গায়ে তার কাঁটা দেয়, সে সোজা চলে না, একটু একটু হেসে চলে লীলাভরে, চলে কিন্তু অভিসারে – আপনার এক লহমার শ্রীসৌন্দর্য শোভা সৌরভ সমস্তই ফুটিয়ে ধরতে চলে সে …..তার মনে যে অনুপম রয়েছে তারদিকে –
গগন সঘন মহী পঙ্কা-
বিঘিনি বিথারিথ উপজয়ে শঙ্কা
দশ দিশ ঘন আন্ধিয়ারা-
চলইতে খলই লখই নাহি পারা!
সূর্যের তেজ অনেকখানি এই ভাবের তেজ কিন্তু দুর্নিরীক্ষ্য সে তেজ , পূর্ণচন্দ্রের আলো স্নিগ্ধ মনোহর – তেজ হিসাবে সে পূর্ণ নয় বলেই। ঘরের দীপ শিখা সেও সুন্দর …কিন্তু অন্ধকার অন্তত শূন্য, – এখানে ফুলশয্যা কোথায় পাতব? রে বিরহিনী সেইখানে শয়ান বিছাও, যেখানে তোমার আপন মন্দিরে রবিশশী দীপ্যমান।
পরকীয়া ধন, সকল প্রধান,
যতন কইয়া লই।
নৈষ্ঠিক হইয়া, ভজন করিলে,
পদ্ধতি সাধক হই।।
পদ্ধতি হইয়া, রস আস্বাদিয়া,
নৈষ্ঠিকে প্রবৃত্ত হয়।
তাহার চরণ, হৃদয়ে ধরিয়া,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।।
আমার অনুপম, আমার অতুলন – সে আর কারো নয়, আমার পূর্ণিমা আমার, সে আর কারো নয় – এই তো প্রাণের কথা , জপ মন্ত্র এবং এরি সাধনা পূর্ণিমা ব্রতসাধনা। আমার সঙ্গে আমার যা তার পূর্ণমিলন! অন্যের ঘরে গেলে সে তো আর আমার থাকে না, সবার হয়ে যায়, সেই জন্যই সে কারোই নয়।
সই, কেমনে ধরিব হিয়া?
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া!
সে বঁধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া,
এমতি করিল কে?
আমার অন্তর যেমন করিছে
তেমনি হউক সে!
যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু,
লোকে অপযশ কয়,
সেই গুণনিধি ছাড়িয়া পিরীতি
আর জানি কার হয়!
যুবতী হইয়া শ্যাম ভাঙ্গাইয়া
এমতি করিল কে?
আমার পরাণ যেমতি করিছে
সেমতি হউক সে!
এ অভিসার শেষ হয়ে যেত , যদি সবার যা তাকে, পরিপূর্ণ যা তাকে পেয়ে যেত কোনদিন সবাই। যে নিমেষে প্রলয় সেই নিমেষে সৃষ্টি কেঁদে জানিয়ে দেয়, এ কি করলে , কেন এ রূপ এলে পরিপূর্ণ করে সব, আমার সেই খণ্ড পরিপূর্ণতা , – কলঙ্কী চাঁদ কোথায় হারিয়ে গেলো !
অপরিণত শিশুকে দোল দিচ্ছে মা – তা এক রকমের পরিপূর্ণ সুন্দর, পরিপূর্ণ দিনের আলোয় কলি ফুটেছে , এ একরকমের সৌন্দর্যের চরম। আবার সন্ধ্যার আঁধারে ফুলে ফুলে পরিপূর্ণ , ডাল পাতায় পরিপূর্ণ গাছ, এতোটুকু চাঁদের আলোকে দুলিয়ে গাইছে…” ও আমার চাঁদের আলো এই ফাল্গুনে সন্ধ্যাকালে ধরা দিয়েছো রে, আমার পাতায় পাতায় ডালে ডালে ..” একরকমের পরিপূর্ণ রসের স্বাদ! সেই স্বাদই ব্রতের মূল ফল, সেই স্বাদই অকৃত্রিম , সেই স্বাদই জাগতিক বা অজাগতিক যে কোনো সুখ …।
সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ চন্দ্র পূজার এক লৌকিক কাহিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম্ বাংলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত)