অন্ধজনেও দেখতে পায়। অন্তর্চক্ষু যাঁর উন্মীলিত, তাঁর আর অন্ধত্ব কিসে! আপন হৃদয়ে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা যিনি জ্বালাতে পেরেছেন, তাঁর কাছে এই সমগ্র জগৎসংসার আলোয় আলোময়। আনন্দময়। এই বিক্ষুব্ধ জীবন সমুদ্রে তাঁরা এক একটি জীবন্ত বাতিঘর।
ডঃ এপিজে আব্দুল কালাম এমনই এক মহামানব। এক প্রজ্বলিত আলোকবর্তিকা। মোমের বাতি নয়, সাক্ষাৎ এক আগ্নেয়গিরি।
অসহনীয় দারিদ্র্য, বারংবার ব্যর্থতা, অকৃতকার্যতা কিছুই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। অদম্য অধ্যবসায়, সাফল্য লাভের দুর্নিবার চেষ্টা, একাগ্রতা আর অপার সারল্যকে পুঁজি করে তিনি প্রকৃত অর্থে সাফল্যের শীর্ষ ছুঁতে পেরেছেন। ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর কৃতিত্ব শুধুমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত অর্জনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর সাফল্য দেশ, কাল, জাতির সীমা অতিক্রম করে গেছে। লক্ষ লক্ষ যুবক, যুবতী, তরুণ, তরুণী, কিশোর, কিশোরীর হৃদয়ে তিনি প্রকৃত জ্ঞান লাভের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
শিশুর মতো সরল ছিলেন তিনি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন ছিল আশ্চর্যজনক সহজ সাধাসিধে, বাহুল্যবর্জিত। আরাম, আয়েশ, বিলাস, ব্যসনে তাঁর ঘোরতর আপত্তি প্রাচীন ভারতীয় সাধুসন্তদের কথা স্মরণে আনে। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন নিজের কক্ষে একটিও আসবাব রাখতে দেননি। মেঝেয় শয়ন, পাশে প্রিয় রুদ্রবীণা আর অসংখ্য বই। বই ছিল তাঁর আত্মার আত্মীয়। নিজের লেখা, “দ্য ইগনাইটেড মাইন্ডস” বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর প্রিয় বইগুলির কথা- ডঃ আলেক্সিস ক্যারেলের লেখা “ম্যান, দ্য আননোন”, থিরুভাল্লুভারের লেখা তামিল ক্লাসিক “থিরুক্কুরাল”, লিলিয়ান ওয়াটসনের লেখা “লাইট ফ্রম মেনি ল্যাম্পস” এবং পবিত্র কুরান। পবিত্র গীতা এবং বাইবেলও নিয়মিত পাঠ করতেন তিনি।
কালাম তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন তাঁর শৈশবের দিনগুলির কথা। রামেশ্বরমে তাঁর বেড়ে ওঠার সেই দিনগুলি। বাবা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। তবে এই ইমামগিরিতে তাঁর আয় বিশেষ ছিল না। তাঁদের পারিবারিক জীবিকা ছিল নৌকোয় করে তীর্থযাত্রীদের রামেশ্বরমের মন্দিরে পৌঁছে দেওয়া। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পক্ষী লক্ষণ শাস্ত্রীগলের সাথে কথোপকথনের কথাও লিখে গেছেন কালাম সাহেব। লিখে গেছেন রামেশ্বরমের চার্চের ফাদার রেভারেন্ড বোদালের কথাও। পারিবারিক আয়ে নিজের তরফে কিছু যোগ করতে এসময় বালক কালাম খবরের কাগজ ফেরি করেছেন।
জীবনের মূল সুরটি এই ছোটবেলা থেকেই বেঁধে ফেলেন তিনি। কোনও কিছুই অন্ধভাবে অনুসরণ করেননি। সবকিছু ছেঁকে ছেনে কেবল সারাৎসার, শাঁসটুকু গ্রহণ করার বিরল ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। নিজের বাকি জীবনে সেটিই অনুসরণ করে গেছেন। নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য, নিজের গোষ্ঠীর উন্নতির মানসে তো সকল স্বার্থপরই বাঁচে, ডঃ আব্দুল কালামের মতো নিজের জীবনকে সমাজের সকলের জন্য কজনই বা উৎসর্গ করে যেতে পেরেছেন! নিজের জীবন, নিজের শেষ সঞ্চয়টুকু দেশ ও জাতির সেবায় দিয়ে গেছেন। এই মহৎ শিক্ষার বীজমন্ত্র সেই শৈশবেই নিজের অন্তরে বপন করেছিলেন তিনি।
মহাকাশ গবেষণা, পারমানবিক অস্ত্র নির্মাণে আজ ভারতের ঈর্ষণীয় সাফল্যে আমরা গর্বিত হই। এই কৃতিত্বের পেছনে ডঃ কালামের নিরলস প্রচেষ্টার কথা আজ প্রতিটি ভারতবাসীর স্মরণ করা উচিৎ। অতি সাধারণ এক ছাত্র কেবল নিজের অধ্যবসায় এবং একাগ্রতায় ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন- এ কি কম অনুপ্রেরণার কথা! শুধু বিজ্ঞানী নয়, তার চেয়েও বড় কথা, গর্বের কথা, তিনি ছিলেন এক মহৎ মানুষ। সমস্ত ধরণের ক্ষুদ্রতা, ভেদবুদ্ধি, কুসংস্কার বিবর্জিত এক আধুনিক মানুষ। চেষ্টা হয়েছে তাঁর গায়েও কালি ছেটানোর, নোংরা রাজনৈতিক পাঁকে তাঁকে টেনে নামানোর। সে সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। পরম হংসের মত তাঁর শ্বেত শুভ্র ভাবমূর্তিতে এতটুকু কাদার ছিটেও কেউ দিতে পারেনি। পারবেও না কোনওদিন।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন পবিত্র রমজান মাসে ইফতার পার্টির আয়োজনে নির্ধারিত সকল অর্থ তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন একটি অনাথ আশ্রমে। তাঁর নির্ধারিত পাঁচ বছরের সময়কালে একটিও ইফতার পার্টির আয়োজন হয়নি রাষ্ট্রপতি ভবনে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাপ্য পারিতোষিক, সাম্মানিক ইত্যাদি সকল অর্থই তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দান করে যান। বিদেশ সফরে পাওয়া সমস্ত উপহার রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালায় দান করে দেন। অবসরের সময় একটিও জিনিস সাথে করে নিয়ে যাননি। নিয়ে যাবেনইবা কোথায়! নিজে সংসারীও হননি, এই গোটা দেশটাই তো ছিল তাঁর সংসার! এর উন্নতিতেই জীবনপাত করেছেন। দেশের দুর্দশায় হয়েছেন বিমর্ষ।
এমন মানুষ হওয়া সহজ কথা নয়। তবুও চেষ্টা করতে দোষের কি আছে! তিনি যদিও কোথাও বলে যাননি, ‘আমার জীবনই আমার বাণী’ ইত্যাদি। তবুও একালে, এই বিক্ষুব্ধ সময়ে এমন নিস্পৃহ, নিরহংকারী, কর্মযোগীকেই তো আদর্শ করতে পারেন আমাদের প্রজন্ম, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ধর্ম নয়, জাতি নয়, অর্থ নয়, যশ নয়- কেবল কাজই যাঁর কাছে মুখ্য।
হে মহামানব, প্রয়াণ দিবসে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি আপনাকে। প্রণাম।
সুপ্রীতি সন্থাল মাইতি