বিদেশি প্রত্নতাত্ত্বিকরা ডাহা ফেল্। শেষে কিনা কপিলাবস্তু আবিষ্কার করে ফেললেন এক ভেতো বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক। নাম তাঁর—পূর্ণচন্দ্র মুখার্জি। সে কথায় আসার আসে বলি কপিলাবস্তু খুঁজতে গিয়ে সাহেবদের দৌড়-ঝাঁপের কথা।
গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তু। ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আর এই কপিলাবস্তু খুঁজতে বিভ্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। প্রথমে তো গোরক্ষপুরের ১৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমে বুলিয়া তাল হ্রদের লাগোয়া অংশের কিছু ধ্বংসাবশেষকে প্রাচীন কপিলাবস্তু নগরী বলে মনে করেছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক আর্চিবল্ড কার্লাইল। সেটা ১৮৭০ মাঝামাঝি সময়ের কথা। পরে আরেক প্রত্নতাত্ত্বিক জেনারেল কানিংহাম বুলিয়া তালে আসেন এবং তিনিও কার্লাইলের মতকেই সমর্থন করেন।
তবুও এই অঞ্চল যে কপিলাবস্তু নয়, তা প্রথম প্রকাশ্যে বললেন প্রত্নতাত্ত্বিক ড: আন্টন ফ্যুরর। অতএব ফের শুরু হলো কপিলাবস্তু অনুসন্ধান পর্ব।
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ কিন্তু বার বার বলে আসছিলেন, কপিলাবস্তু রয়েছে নেপালে। তবুও সে কথা বিশেষ কেউ কানে তোলেনি। ইতিমধ্যে ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের ড: লরেন্স অস্টিন ওয়াডেল দার্জিলিংয়ে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে এক তিব্বতি পর্যটকের রচনা হাতে পেয়ে বেশ কিছুদিন উজানি অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ঘুরে বেড়ালেন। কিন্তু নীটফল জিরো।
এরপর ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক ড: ফ্যুরর নেপালের তরাই অঞ্চলে শাক্যদের এলাকার খোঁজ পেলেন। পরের বছর তাঁকে চাকরিতে ইস্তফা দিতে হয়। তারপর ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বেছে নিলেন বাঙালি বাবু প্রত্নতাত্ত্বিক পূর্ণচন্দ্র মুখার্জিকে। ভিনসেন্ট স্মিথের কাছে দায়িত্ব বুঝে নিয়ে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে জানুয়ারি বাঙালি বাবু রওনা দিলেন নেপালে।
অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নেপালের তৌলিহাওয়ায় পৌঁছলেন পূর্ণচন্দ্র মুখার্জি। সেখানে থারু উপজাতি শ্রমিকদের নেপালি বাহিনীর এক সর্দার অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর সাহায্যেই তিন মাইল উত্তরে তিলৌরা কোটে অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে দিলেন পূর্ণ চন্দ্র মুখার্জি।
পূর্ণচন্দ্র মুখার্জির পিছনে লাগলেন আরেক প্রত্নতাত্ত্বিক ড: লরেন্স অস্টিন ওয়াডেল। সে জট ছাড়িয়ে তিলৌরাকোটে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ শুরু করে দিলেন পূর্ণচন্দ্র। সে সময় ড: ওয়াডেল সেখানে ছিলেন না। ওয়াডেল তখন তাঁর আরেক শত্রু ড: ফ্যুরের বিরুদ্ধে অস্ত্রে শান দিতে ব্যস্ত। এই ফাঁকেই অসাধ্য সাধন করে বসলেন বাঙালি বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখার্জি। তিনি ততদিনে আবিষ্কার করে ফেলেছেন গৌতম বুদ্ধের পিতা শুদ্ধোধনের রাজধানী কপিলাবস্তু নগরীর ধ্বংসাবশেষ। ড: ওয়াডেল দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
কলকাতায় ফিরে গিয়ে ভারত সরকারের তৎকালীন রাজস্ব ও কৃষি বিভাগের সেক্রেটারির কাছে চিঠি লিখে কপিলাবস্তু আবিষ্কারের দাবি করে বসলেন ড: লরেন্স অস্টিন ওয়াডেল। কিন্তু তাতে কোনো কিছুই হলো না। এমনকি, মামলা করার হুমকিও দিলেন তিনি। তবে মামলাটা শেষ পর্যন্ত করলেন না। কারণ, তাঁর হাতে তথ্য-প্রমাণ ছিল না।
এদিকে ততদিনে বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক পূর্ণচন্দ্র মুখার্জির কপিলাবস্তু আবিষ্কারের কথা দুনিয়া জেনে গেছে।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের “থিয়োজফিস্ট” পত্রিকার মে মাসের সংখ্যায় পূর্ণ চন্দ্র লেখেন, —
দু’বছর আগে কপিলাবস্তু আবিষ্কারের খবর ঘোষণা হবার পর থেকে ড: ফ্যুরর ও ড: ওয়াডেল এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব দাবি করতে শুরু করেন। শেষের জনকে এ বছরেও বেঙ্গল গভর্ণমেন্টের তরফে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু অসফল। শেষ পর্যন্ত নর্থ ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স অ্যাণ্ড আওধের সরকারের তরফে কপিলাবস্তু খুঁজে পাই আমিই।
এরপর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলো পূর্ণচন্দ্র মুখার্জির লেখা ” এ রিপোর্ট অন্ এ ট্যুর অব্ এক্সপ্লোরেশন অব্ দ্য এন্টিকুইটিজ অব্ কপিলাবস্তু টেরাই অব্ নেপাল, ডিউরিং ফেব্রুয়ারি অ্যাণ্ড মার্চ অব্ ১৮৯৯।”
সাহেবদের হারিয়ে কপিলাবস্তু আবিষ্কারক হিসেবে থেকে গেল বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক পূর্ণ চন্দ্র মুখার্জির নাম।