বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট
গতকাল সারাদেশের বেশ কয়েকটি পত্রিকায় গান্ধীজির লাহোরে ভারতের জাতীয় পতাকা সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘টাইমস’ এটি নিয়ে একটি বিশেষ সংবাদ রয়েছে, যেখানে দিল্লির ‘হিন্দুস্তান’ পত্রিকাতেও এটি প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। এই সংবাদটি কলকাতার ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকাতেও রয়েছে, পাশাপাশি মাদ্রাজের ‘দ্য হিন্দু’ও এটি প্রকাশিত করেছে।
“যদি ভারতের জাতীয় পতাকায় চরখা না থাকে, তবে আমি সেই পতাকাটিতে মাথা নত করব না” ক্ষোভের মাথায় এই বক্তব্য গান্ধীজির ব্যক্তিত্ব এবং ছবির সাথে মেলে না। এই খবরটি এখনও ভারতের অনেক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি, সেই কারণে তাদের কাছে এই খবর পৌঁছোয়নি। তবে পাঞ্জাবের পাঞ্জাবি, হিন্দি এবং উর্দু সংবাদপত্রগুলি এই বক্তব্যটি উড়িয়ে দিয়েছে। সকাল থেকেই গোটা দেশজুড়ে এই বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা চলছে।
লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘মিলাপ’ পত্রিকা সকালে সকলের হাতে আসে। ওখানকার হিন্দুদের এটি মুখ্য সংবাদপত্র। হিন্দু মহাসভার মুখপাত্র ‘ভারতমাতা’ অধিকাংশ হিন্দুদের ঘরে আসত, কিছুদিন আগে গান্ধীজি সম্বন্ধে ভুল এবং অপমানজনক খবর প্রকাশ করায়, পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মিলাপ, বন্ধেমাতরম, পারস, প্রতাপের মত হিন্দি পত্রিকায় সিন্ধ প্রান্তের হায়দ্রাবাদে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিশাল জনসভার খাসা বর্ণনা প্রকাশিত হয়। সরসঙ্ঘচালক গুরুজীর ভাসন সংক্ষেপে ছাপা হয়। ডন নামক ইংরাজি পত্রিকাতেও ছাপানো হয়।
আজ, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকালে রাওয়ালপিন্ডির একটি বাড়িতে ‘পাকিস্তানি হিন্দু মহাসভার’ নেতাদের একটি সংক্ষিপ্ত সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
দেশভাগ এখন নিশ্চিত এবং বেশিরভাগ পাঞ্জাব এবং হিন্দি সহ পুরো সিন্ধ প্রদেশ পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, এটা স্পষ্ট। পাকিস্তানের মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের দ্বারা হিন্দুদের এবং তাদের সম্পত্তির উপর ক্রমাগত আক্রমণ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে বেঁচে থাকা হিন্দুদের জন্য কিছু করতে হবে। সে কারণেই ‘পাকিস্তান হিন্দু মহাসভার’ নেতারা সমস্ত পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি বিবৃতি জারি করেছেন। এই বিবৃতিতে তিনি পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দুদের ‘মুসলিম লীগের পতাকার সম্মান ও শ্রদ্ধা’ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এর সাথে, পাকিস্তান হিন্দু মহাসভা, পশ্চিম পাঞ্জাবের মুসলিম লীগের নেতা নির্বাচিত হওয়ার উপলক্ষে ইফতেখার হুসেন খান মেমনকে অভিনন্দন জানায় এবং একইভাবে খাজা নিজামুদ্দিন পূর্ববাংলা মুসলিমলীগ বিধানসভা দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ায়, তাকেও অভিনন্দন জানায়।
পাকিস্তান তো হবেই, বরং এটা ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে … এই বিষয়টি সেখানকার হিন্দুরা ভাল করেই বুঝতে পেরে গেছে…।
__ __ __ __
হায়দরাবাদ …. সিন্ধ
রাতে হালকা বৃষ্টি হয়েছিল, ফলে আবহাওয়া কিছুটা শীতল হয়েছে। গুরুজী তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে উঠেছেন। প্রভাত শাখায় যেখানে গুরুজী কে নিয়ে আসা হয়েছে, সেখানে স্বেচ্ছাসেবীদের প্রচুর উপস্থিতি রয়েছে। একটি বিশাল বড় মাঠে শাখা চলছে এটিতে ছয়টি দলে খেলা চলছে। আজ গুরুজী সেই শাখায় স্বয়ংসেবকদের সঙ্গে আছেন। ওনাকে পেয়ে স্বয়ংসেবকা খুব আনন্দিত। তবে একই সাথে হতাশা রয়েছে যে খুব শীঘ্রই পূর্বপুরুষদের এই পবিত্র ভূমিটি আমাদের কাছে পর হতে চলেছে। এই স্থান ছেড়ে প্রত্যেককেই কোনও না কোনও হিন্দুস্তানের অজানা স্থানে যেতে হবে।
শাখাটি সমাপ্ত হওয়ার পরে একটি সংক্ষিপ্ত ঘরোয়া সভা অনুষ্ঠিত হয়। সকল স্বেচ্ছাসেবীর জন্য স্বল্পাহারের ব্যবস্থা রয়েছে। গুরুজী, এই বিষণ্ণ পরিবেশকে হালকা করার চেষ্টা করছেন। স্বয়ংসেবকদের মধ্যে সচেতনতা বারাবার চেষ্টা তাঁর।
হায়দরাবাদ ও সিন্ধু প্রদেশের আশেপাশের অঞ্চলগুলি থেকে কীভাবে হিন্দুদের নিরাপদে ভারতে নিয়ে যাওয়া যায় সে সম্পর্কে পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, ভারত সরকারের তরফ থেকে এই ব্যাপারে বিন্দু মাত্র সহযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। ভিটে মাটি ছাড়া এই হিন্দুদের যেখানে ভারতে রাখা হবে, যেখানে তাদের বসতি স্থাপন করা হবে, সে ক্ষেত্রে ভারতের বর্তমান ও আসন্ন সরকারের কোনও নির্দেশিকা নেই। কারণ জনসংখ্যার বিনিময়ের ধারণাটি মূলত কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করেছে।
গান্ধীজি পূর্ব পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশের হিন্দুদের সেখানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। সেখানে বসবাসকারী হিন্দুদের কাছে গান্ধীজির পরামর্শ হ’ল মুসলিম গুন্ডাদের আক্রমণ করার সময় তাদের নির্ভীকভাবে কোরবানি দেওয়া উচিত …! এখন, কংগ্রেস এবং ভারত সরকার যে পরিস্থিতিতে আছে, হিন্দুদের রক্ষা এবং তাদের নিরাপদে ভারতে ফিরিয়ে আনা অনেক। ধৈর্য, সাহস এবং বিপদের কাজ। তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে ।
সকালের স্বল্পাহারের পর প্রায় সকাল ৯ টার সময় গুরুজী আবার করাচি ফিরে যাচ্ছেন। গুরুজীকে বিদায়ের সময়, হায়দরাবাদ এবং আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে আসা স্বয়ংসেবকদের চোখে জল ভরে এসেছে। গুরুজীর সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে তা কেউ জানে না। গুরুজীও জানেন যে এটিই তাঁর সিন্ধ প্রদেশের শেষ ভ্রমণ। মনে হচ্ছে যেন সময় থেমে গেছে। পুরো পরিবেশটি থমথমে, তবে ফেরাও জরুরি। গুরুজীর সামনে আরও অনেক কাজ রয়েছে। গুরুজী-র এই কাফেলা আবাজি থত্ত, রাজপাল জিৎ ইত্যাদি সহ আস্তে আস্তে করাচির দিকে অগ্রসর হয়।
মস্কো।
প্রায় একই সময়, অর্থাৎ রাশিয়ার মস্কোয় ভোর ছয়টা বাজে … তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে নিযুক্ত স্বতন্ত্র ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত মিসেস বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের বিমানটি মস্কোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিল। আগস্ট মাস মস্কোর বাসিন্দাদের জন্য গ্রীষ্ম হতে পারে তবে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত বায়ুমণ্ডলে শীত অনুভব করছিলেন। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে, স্বাধীন ভারত হওয়ার জন্য অশোক চক্র যুক্ত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। সম্ভবত ভারতের বাইরে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের এটি প্রথম ঘটনা। এই ধারণা মাথায় আসার সাথে সাথে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত হালকা হাসলেন।
সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বোন, পঁয়তাল্লিশ বছরের বিজয়লক্ষ্মীর, এই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি নিজেও বহুবার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন এবং কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তিনি নিজেও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী ও দক্ষ। যেহেতু বিজয়লক্ষ্মী জওহরলাল নেহেরুর চেয়ে প্রায় এগার বছরের ছোট ছিলেন, তাই নেহরু কে খুব একটা পাশে তিনি পাননি। একুশ বছর বয়সে, তিনি কাঠিয়াওয়ার রাজপরিবারের সুপরিচিত আইনজীবি রণজিৎ পণ্ডিতকে বিয়ে করেছিলেন।
সুতরাং, স্বাধীন ভারতের পক্ষে তাঁকে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ করার সময়, ‘জওহরলাল নেহেরুর বোন’ হিসবেই তাঁর এক মাত্র পরিচয় ছিল না, বরং তাঁর নিজের অনেক দায়িত্বও ছিল। রুশ কর্মকর্তারা এই ভারতীয় রাষ্ট্রদূত, অর্থাৎ জওহরলাল নেহেরুর বোনকে আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানিয়েছিলেন। রাশিয়ায় তাঁর কার্য কলাপ প্রথম থেকেই খুব সুন্দর ছিল …
__ __ __ __
দুপুর ১ নাগাদ দিল্লী থেকে কায়দা-আজম জিন্নাহকে নিয়ে ভাইসরয়ের বিশেষ ডাকোটা বিমানটি করাচির মরিপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করে। জিন্নাহ, তাঁর বোন ফাতিমা এবং তাদের তিন সহযোগী বিমান থেকে অবতরণ করেন। পাকিস্তানের স্রষ্টা হিসাবে, তার স্বপ্নের দেশ পাকিস্তানে প্রথম পদার্পণটা খুব একটা সুখের ছিলনা, মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে কোনও বিশেষ কৌতূহল ছিল না। এই জন্যই জিন্নাহকে স্বাগত জানাতে খুব কম মানুষ বিমানবন্দরে এসেছিল। এরা অবশ্য পাকিস্তান এবং জিন্নাহ জিন্দাবাদের মতো কিছু স্লোগান তুলেছিল, কিন্তু তাদের কণ্ঠে উৎসাহ প্রায় ছিলনা বললেই চলে।
__ __ __ __
মুম্বই ….
আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি হওয়ার ফলে পরিবেশটি বেশ সুন্দর। বোরিবন্দরস্থ মুম্বই মহানগরপলিকা ভবনের সামনে একটি ছোট্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, ঐ ভবনের সামনে দুটি বেস্ট(BEST) বাস দাঁড়িয়ে আছে এবং একটি ছোট প্যান্ডেল তৈরী করা হয়েছে।
‘বোম্বাই বৈদ্যুতিক সরবরাহ ও পরিবহন নামে, ১৮৭৪ সাল থেকে মুম্বাইবাসীর সেবায় নিযুক্ত সংস্থাটি ভারতের মুম্বাই মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের অধীনে হতে চলছে, ভারতের স্বাধীনতার এক সপ্তাহ আগে। এই অনুষ্ঠানটি এই প্রসঙ্গে। ‘বেস্ট’-এর 275 টি বাস রয়েছে এবং এখন এই সমস্ত বাসগুলি ৭ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে মুম্বাই পৌর কর্পোরেশনের দখলে হস্তান্তরিত হবে। মুম্বাইয়ের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে…।
__ __ __ __
ওয়ারঙ্গল ….
কাকতিয়া রাজবংশের রাজধানী। এক হাজার স্তম্ভ যুক্ত মন্দিরের জন্য বিখ্যাত স্থান। একটি নিজামশাহী রাজত্বের শহর। সকাল এগারোটা, আগস্ট মাসেও সূর্য থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে। দূর-দূরান্তে মেঘের চিহ্ন নেই। বাতাসও বইছে না। গাছপালার পাতা নিরব, নির্জীবের মত নিষ্প্রাণ, ওয়ারঙ্গল শহরটির মূখ্য চৌরাস্তার মোড় প্রায় নিস্তব্দ রয়েছে। এরকম পরিবেশে হঠাৎই শ’খানেক কর্মকর্তা মোড় পেরিয়ে এই চৌরাস্তার দিকে কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে, “নিজামশাহীকে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন রাজ্যে একীভূত করুন” … উচ্চস্বরে এই স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসে। কংগ্রেস কর্মীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ওয়ারঙ্গল জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি কলিপাকা কিশন রাও গারু।
__ __ __ _
হায়দরাবাদ রাজ্য কংগ্রেস কমিটির আদেশ অনুসারে এই কর্মীরা এই অংশটিকে ভারতে মিলিত করার জন্য নিজামের বিরুদ্ধে একটি সত্যগ্রহ শুরু করেছে। হায়দরাবাদ রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি স্বামী রামতির্থ জনগণকে সত্যগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তিনি নিজেও কাচিগুড়া এলাকার কয়েকশ কংগ্রেস কর্মীর সাথে স্লোগান বিক্ষোভ করছেন।
সম্পূর্ণ ভারতে স্বাধীনতার কথা শোনা যাচ্ছে। আর নিজামের শাসনের এই বিশাল ভূমি এখনও দাসপ্রথার অন্ধকারে রয়েছে। প্রতিবাদকারীদের উপর অমানবিক অত্যাচার চালাচ্ছে …!
__ __ __ __
কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘দৈনিক বসুমতী’, ‘স্টেটসম্যান’ এর মতো সমস্ত দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় আজকের শিরোনামটি হল চক্রবর্তী রাজাগোপালচারী অর্থাৎ রাজাজি বাংলার রাজ্যপাল হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন। রাজাজী এই বিভক্ত বাংলার প্রথম রাজ্যপাল হতে চলেছেন, অর্থাৎ ‘পশ্চিমবঙ্গে’ রাজাজী হলেন কংগ্রেস পার্টির দুর্দান্ত ব্যক্তিত্ব। যিনি নিজেই পুরো মাদ্রাজ প্রদেশ পরিচালনা করেছন। তবে সদ্য সমাপ্ত প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখোমুখি হন। এ ছাড়াও ‘বিভাজনের ধারণাটিকে অতি সক্রিয় ভাবে অগ্রসর করার একজন পথপ্রদর্শক হিসেবেও তিনি পরিছিত ছিলেন। এই কারণে বাংলার মানুষ তাঁর সিদ্ধান্তকে অপছন্দ করেন।
স্যার অচিনলেকের সামনে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ চিঠি রাখা হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে, এই নোটশিটটি হল রাজনৈতিক প্রকৃতির সমস্ত ভারতীয় বন্দীদের মুক্তি সম্পর্কে। ‘অল ইন্ডিয়ানস’ এই চিঠিতে এই শব্দটি স্যার অচিনলেক উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির লড়াই করা সৈন্যরাও … হ্যাঁ, নোটশিট অনুসারে, এটিই অর্থবোধ হয়। অচিনলেকের মাথা ব্যাথা শুরু হয়। সুভাষ চন্দ্র বসুর সহকর্মীদেরও ছেড়ে দেব ..? যারা ব্রিটিশদের কাছে আসল চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করেছিলো, সেই আজাদ হিন্দ যোদ্ধাদের মুক্তি দেব? না … মোটেও নয়। কমপক্ষে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কেবল ব্রিটিশ শাসন রয়েছে, তাই আমি তাদের কোনমতেই ছেড়ে দেব না।
তারপরে তিনি তাঁর স্টেনোকে ডাকলেন এবং একটি ধীর, ত বে অভদ্র স্বরে লিখতে শুরু করলেন যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্য সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু সুভাষ চন্দ্র বোসের নেতৃত্বে ‘ইন্ডিয়ান নাসানাল আর্মি’র সৈন্যদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে আমাদের তীব্র আপতি রয়েছে।
সুতরাং, সুভাষ বাবুর সমস্ত সহযোগী, যিনি ভারতকে মুক্ত করার জন্য নিজের জীবন দিয়েছিলেন, আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনীর সাহসী সৈন্যরা কমপক্ষে ১৫ ই আগস্ট পর্যন্ত মুক্তি পাবে না, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এদিকে, মাদ্রাজ সরকার বিকেলে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে, যার মতে ঘোষণা করা হয় যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া মাদ্রাজ প্রদেশের সমস্ত মানুষকে পাঁচ একর করে জমি বিনামূল্যে দেওয়া হবে। ১৫ ও ১৬ আগস্ট সরকারী ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছিল।
স্বাধীনতার সূর্য উদয় হতে আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি আছে…।
__ __ __ __
বিকেল চারটায়। মাদ্রাজে স্থানীয় সিনেমাগুলি তে ম্যানেজাররা একটি সভা করছে। এই সভাটি স্বাধীনতা উপলক্ষেই আয়োজন করা হয়েছে। কেসিআর রেড্ডি সর্বাধিক সিনিয়র থিয়েটারের মালিক। তিনি সভায় প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ১৫ ই আগস্ট থেকে সমস্ত প্রেক্ষাগৃহে ব্রিটিশ সরকারে জাতীয় সংগীত বাজানো হবে না। যে কোনও ভারতীয় জাতীয় গান তার জায়গায় বাজানো হবে। সকলেই প্রশংসা ও করতালি দিয়ে এই প্রস্তাব মেনে নেন।
এদিকে, করাচির একটি বড় মঞ্চে, মিসেস সুচেতা কৃপালানী প্রায় ১০০-১২৫ জন সিন্ধি মহিলাদের সঙ্গে সভা করছেন। এই সমস্ত সিন্ধি মহিলারা নিরাপত্তাহীন থাকা সত্ত্বেও এই বাংলোয় জড়ো হয়েছে। সুচেতা কৃপালানির স্বামী আচার্য জেবি কৃপালানী কংগ্রেসের জাতীয় সভাপতি। কংগ্রেসের দেশ ভাগ মেনে নেয়ার ফলে, সীমান্ত অঞ্চলের জনগন খুব ক্ষুব্ধ। সুতরাং, স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের প্রচেষ্টা এই পরিবেশকে শান্ত করার, যা তাদের নিজ প্রদেশে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আগুন জ্বলছে। সমস্ত সিন্ধি নারী, সুচেতা কৃপলানীর কাছে অভিযোগ করছে যে তারা নিরাপত্তাহীন। সিন্ধি নারীরা মুসলমানদের বর্বর অত্যাচারের কথা বলেন। তবে সুচেতা কৃপালানী এই মহিলাদের বক্তব্যের সাথে একমত নন। তিনি জোর গলায় বলেন “আমি পাঞ্জাব এবং নোয়াখালীর সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমার দিকে কোনও মুসলিম গুন্ডাও আড় চোখে দেখার সাহস করে না। কারণ আমি গাঢ় আকর্ষিত মেকআপ করি না ও লিপস্টিক ব্যবহার করি না। আপনারা বড় গলার ব্লাউজ, পাতলা নজরকারা শাড়ি পরেন। এ কারণেই মুসলিম গুন্ডাদের দৃষ্টি আপনারা আকর্ষণ করেন এবং ধরুন যদিও কোন মুসলিম গুন্ডা আপনাদের উপর আক্রমন করে আপনাদের রাজপুত বোনদের আদর্শ মনে রেখে,’ জওহর’ করা উচিত …!
(ইন্ডিয়ান ডেইলি মেল – 7. ই আগস্টের খবর) প্রথম পাতা) _
এই বড় মহলে বসে নিজেদের প্রাণের বাজি রেখে, কোন প্রকারে এক একদিন কাটানোর, এই ভীত সিন্ধি নারীদের সুচেতা কৃপালানীর এই বক্তব্যে কী বলবে তাঁরা বুঝতে পারছেন না। তারা হতবম্ব হয়ে গিয়েছিল ‘এক রাষ্ট্রীয় অধ্যক্ষের স্ত্রী আমাদের কী বলছেন? এই মহা বিপদের সময় আমরা গাড় আকর্ষিত মেকআপ করব ? বড় গলার ব্লাউজ পরবো ? মুসলিম গুন্ডারা কি কেবল এই জন্যই আমাদের দিকেই আকৃষ্ট হয় ? আর তারা যদি আমাদের ধর্ষণ করার চেষ্টা করে তবে আমাদের কি রাজপুত মহিলাদের মতো জওহর করা উচিত .. ?
এই মহা বিপদের সময়ে কেবল কংগ্রেসের নেতারা নয়, তাদের স্ত্রীরাও আসল বাস্তবিক স্থিতি এবং মুসলিম মানসিকতা থেকে অনেক দূরে …
দিল্লির একই সামরিক সদর দফতর …
দ্বিতীয় তলায় একটি বিশাল পরিসীমা। এতে, গোর্খা রেজিমেন্টের সামরিক সদর দফতরের একটি ছোট্ট অফিস। ‘গোর্খা রাইফেলস’, একদল নাইট সৈনিক যারা সারা বিশ্ব জুড়ে তাদের সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। এই রেজিমেন্টের চারজন কর্মকর্তা এখানে একটি বড় টেবিলের কাছে বসে কিছু গভীর আলোচনা করছেন । যেহেতু ভারতীয় সৈন্যরাও বিভক্ত হতে চলেছে, এখন গোর্খা রেজিমেন্টের পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত কিনা তা এক বড় বিষয় । এর আগে, ব্রিটিশ আধিকারিকদের অনুরোধে গোর্খা রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য সিঙ্গাপুরকে দেওয়া হয়েছিল। কিছু গুর্খা সৈন্যকে ব্রুনাইয়ে পাঠানো হয়েছিল। নেপাল সরকারও এই সমস্ত বিষয়ে সম্মত ছিল। তবে এক জন গোর্খা সৈনিকও পাকিস্তানে যেতে প্রস্তুত নয়।
অবশেষে গোর্খা রেজিমেন্টের এই চার প্রবীণ আধিকারিক সর্বসম্মতিক্রমে একটি নোটশিট প্রস্তুত করে সর্বাধিনায়ককে অর্পণ করেছিলেন যে, গোর্খা রেজিমেন্টের একটিও ব্যাটালিয়ন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে প্রস্তুত নয়, আমরা ভারতেই থাকব।
__ __ __ __
লখনউ ….
রাজ্য বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়। শক্তিশালী শরীর এবং ঘন গোঁফের অধিকারী গোবিন্দ বল্লভ পঁথ প্রসন্ন প্রকৃতির মানুষ সহকর্মীদের সাথে হাসি ঠাট্টা করে কিছু আলোচনা করছেন এবং রসিকতা করছেন। কৈলাশনাথ কাটজু, রাফি আহমেদ কিদওয়াই, পিএল শর্মার মতো মন্ত্রীরা তাঁর আসেপাশে বসে আছেন।
আলোচনার মূল বিষয় যে, ব্রিটিশ সরকার দ্বারা অপভ্রংশ করা শহর এবং নদীগুলির নাম তাদের মূল হিন্দু নাম দিয়ে সনাক্ত করার জন্য পরিবর্তন করা উচিত। ব্রিটিশরা গঙ্গাকে ‘গঙ্গেজ’ এবং যমুনা নদীকে ‘জমনা’ বানিয়েছিল। ব্রিটিশরা পবিত্র মথুরা শহরটির নামকরণ করেছিল ‘মুত্তরা’। এরকম শহর ও নদী ইত্যাদির আসল নামকরণ করে চিহ্নিত করা উচিত। এই প্রসঙ্গে, মুখ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এই কমিটি একটি আদেশ নির্গত করে যে অবিলম্বে শহর, নদী এবং গ্রামের অপভ্রংশ নাম পরিবর্তন করে আসল নাম দিয়েই লেখা উচিত।
__ __ __ __
১৭, ইয়র্ক রোড।
জওহরলাল নেহেরুর বর্তমান বাসভবন… অর্থাৎ স্বাধীন ভারতের বর্তমান প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র।
সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেছে এবং নেহেরু বিদেশমন্ত্রীর ভূমিকায় এসেছেন। পাকিস্তানের অস্তিত্ব আসতে মাত্র এক সপ্তাহ বাকি রয়েছে। এই পাকিস্তানেও ভারতের রাষ্ট্রদূত থাকা দরকার। এই মুহূর্তে এমন অনেকগুলি বিষয় রয়েছে যা ভারত-পাকিস্তানকে পারস্পরিক সম্প্রীতিতে সম্পন্ন করতে হবে। হিন্দু ও শিখদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার মূল প্রশ্ন এবং তাদের সমস্যাগুলি সমাধান করা, এইজন্যই পাকিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদূত দরকার। এই পরিস্থিতিতে নেহেরুর সম্মুখে শ্রীপ্রকাশের নাম উঠে এল।
শ্রীপ্রকাশ প্রয়াগের। অর্থাৎ নেহেরুর এলাহাবাদের। তিনি বহুবার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করে। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে তাঁর দু বছরের জন্য জেল হয়েছিল। শ্রীপ্রকাশ ভদ্র ও স্পষ্ট বক্তা। কেমব্রিজে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত সাতান্ন বছর বয়সী এই ব্যক্তির চমৎকার প্রশাসনিক দক্ষতা রয়েছে। অর্থাত্, নবগঠিত পাকিস্তানে ভারতের প্রথম হাই কমিশনার হিসাবে শ্রীপ্রকাশের নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ১১ ই আগস্ট, কায়দে আজম জিন্নাহ পাকিস্তানের সংসদে তার প্রথম ভাষণ দেবেন। তার আগেই শ্রীপ্রকাশকে করাচি গিয়ে রিপোর্ট করা দরকার।
আগামী দু’বছর ধরে লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও শিখ পাকিস্তান থেকে বাস্তুচ্যুত হবে এই বিষয়টি… পাকিস্তানের জেদী,অমানসিক ও উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির…মানুষ জন, দখল করার পাকিস্তানি কৌশল… শ্রীপ্রকাশ কে এই রকম অনেক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে একথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।
__ __ __ __
বৃহস্পতিবার ৭ আগস্ট, রাত গড়িয়ে যাচ্ছে। অমৃতসর থেকে গান্ধীজির ট্রেন যাত্রা শুরু হয়েছে। এক জায়গায় বসে বসে গান্ধীজির শরীর জড়োসড়ো হয়ে গেছে। অনেকদিন থেকেই হেঁটে চলাটা তাঁর পছন্দের । এরকম ব্যক্তিকে সারাদিন এক জায়গায় বসিয়ে রাখা কিছুটা শাস্তির মত ছিল। ট্রেনেতে গান্ধীজির পঠন-পাঠন চিন্তা ভাবনা করার অবকাশ আছে। সেই সময় ট্রেন সংযুক্ত প্রদেশ পার করছে। যে স্টেশনে ট্রেন থামছে কংগ্রেস কার্যকর্তারা এবং জনগণেরা ওনার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। অধিকাংশ মানুষের একটাই বক্তব্য, “বাপু হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা কবে থামবে ?”
এদিকে ট্রেনে বাপু চিন্তান্বিত, তিনি ওয়াহা শরণার্থী শিবির এবং লাহোর শহরে যা যা দেখেছেন শুনেছেন তা ভীষণই ভয়ানক। তবুও তার মনে একটি বড় সংশয় যে, মুসলমানদের হামলার কারণে নিজেদের বাড়িঘর সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে ভারতে চলে আসাকি উচিত ? এতে তো আমার সিদ্ধান্ত টাই পুরোপুরি ভুল প্রমানিত হবে।
কাল সকালে গান্ধীজি পাটনা নামবেন। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ট্রেন এগিয়ে চলেছে গান্ধীজি জালনা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মনে এখন একটাই আশঙ্কা, এক অসুরক্ষিত ভারত আসন্ন।