স্নানযাত্রা সম্পন্ন হল জগন্নাথের। সেই কবে থেকে স্নানযাত্রায় যাচ্ছেন জগন্নাথ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। পুরীর জগন্নাথ নয়, এই জগন্নাথ একান্তই বাংলার। আরো স্পষ্ট করে বললে হুগলীর গুপ্তপল্লীর। গুপ্তপল্লী নামটির সন্ধান মিলছে ‘মহাপুরুষচরিতম’ নামের গ্রন্থে। এই অঞ্চলের রূপ ছিল নাকি কুসুমদশনা ও নতুন দূর্বাদলের মতো সবুজ।
‘তস্মিন্ হুগলী প্রথিত বিষয়ে গুপ্তপল্লীতি নাম
পল্লী রম্যা কুসুমদশনা নূতনদূর্বান্বরী চ ।
গঙ্গা যস্যা রজত সলিলিলা হার– শোভাং বিধত্তে
হিত্বা বৃন্দিবিপিন বসতিং বর্ততে যত্র কৃষ্ণঃ।।’
সে-দিনের সেই গুপ্তপল্লীই আজকের গুপ্তিপাড়া। বাংলার প্রথম বারোয়ারী দুর্গা পুজোর প্রচলন হয়েছিল এখানেই। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গলে ও দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যাায়ের লেখাতেও গুপ্তিপাড়ার উল্লেখ মেলে। এই জনপদের ইতিহাস নেহাত কম দিনের নয়।
আর, এই জনপদের ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িয়ে প্রায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা। ইতিহাসিক সুধীরকুমার মিত্র উল্লেখ করছেন- ‘বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথদেবের রথযাত্রা গুপ্তিপাড়ার অন্যগতম প্রধান পর্ব ; এইরূপ অত্যুুচ্চ রথ বাংলাদেশে আর কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। একমাত্র পুরী ব্যেতীত আর কোন রথ নাকি এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে না।
গুপ্তিপাড়ায় বৃন্দাবনচন্দ্রের এই মন্দিরকে মঠ বলেন এলাকার লোক। মন্দিরের পাশে রয়েছে শ্রীরামচন্দ্রর মন্দির। এই মন্দিরে স্থাপিত সীতাদেবী, লক্ষণ ও মহাবীরের মূর্তি। দক্ষিণ দিকে রয়েছে ‘জোড়-বাংলা’ শৈলীর গৌরাঙ্গ ও নিত্যা নন্দ মহাপ্রভু মন্দির। পাশেই হরিমন্দির। রথের প্রায় পনেরো দিন (তিথি অনুযায়ী) আগে রথদেবতা জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা-র স্নানকে কেন্দ্র করে হয় স্নানযাত্রা উৎসব। প্রধান মন্দির থেকে তিনজন দেবতার দারুমূর্তি নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দোতলা সমান একটি রাসমঞ্চের উপরে। প্রায় দু–ঘণ্টা পুজোপাঠের পর শুরু হয় জগন্নাথদেবের স্নান।
বড়ো বড়ো পাত্রে দুধ, গঙ্গাজল, ফুল-সহ আরো নানা উপকরণের সমারোহে স্নান করানো হয় দেবতাদের। স্নানের পর রাসমঞ্চের নিচে নল দিয়ে স্নানের সেই জল পড়তে থাকে। এই স্নানের জল দেতার প্রসাদ হিসেবে সকলে নিচে দাঁড়িয়ে থেকে পান করে। কেউ কেউ বোতলে, পাত্রে ভরেও নিয়ে যান ঘরে। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই জলে দেহের রোগজীবানু নাশ হয়। তাই মন্দিরের আশেপাশের নানা গ্ৰাম থেকে লোকজন আসতে থাকেন জগন্নাথের এই স্নানযাত্রায়। স্থানীয় থানা থাকে সমগ্ৰ অনুষ্ঠানটির তদারকি ও সুরক্ষায়। মন্দিরের পশ্চিম দিকে থাকে রথ। এইদিন রথেরও পুজা হয়। রথের উপরের ছাউনি খুলে দেওয়া হয় রথের যন্ত্রাংশ মেরামতি ও রং করার জন্য্।
গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের পাশে স্নানযাত্রা উপলক্ষে বসে ছোট্ট মেলা। এলাকার মাটির খেলনা, প্লাস্টিকের খেলনা, খাবার-সহ নানা দোকান। এই অনুষ্ঠানের জন্য সকাল থেকে এলাকার মানুষজন ভিড় জমাতে থাকেন। এই ভিড় দেখে সত্যিই মনে হয়, আজো বেঁচে রয়েছে বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরর এই রথযাত্রা। যা বাঁচিয়ে রেখেছেন এলাকার মানুষরাই। বাঁচিয়ে রেখেছেন সামাজিক উৎসব হিসেবেই। পাঁচ শতাব্দী-প্রাচীন এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ দেখে মনে পড়ে যায় সত্যকামের সেই গান–
‘জগতের নাথ তুমি প্রভু জগন্নাথ
স্মরণে তোমায় আমি রাখি দিনরাত
দেখা দাও হাতি বেশে স্নানযাত্রার শেষে
অপরূপ শোভা সে যে আকাশে বাতাসে…’