#পর্ব_৪
শিবাজীকে বিজাপুর হতে পুনা প্রেরণের পূর্বে শাহাজী শিবাজীর বিবাহের ব্যবস্থা করেন। অতি সমারোহে সেই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। সেই সময় শিবাজীর বয়ক্রম ছিল মাত্র দশ বৎসর। আরে অবাক হবে না….সেই সময় ওই বয়সে অনেকের ই বিবাহ হত। ইতিহাস প্রসিদ্ধ মহারাট্টাদের অনেকেই বাল্যকালে বিবাহ করেছিলেন। শিবাজীর পুত্র সম্ভাজী ও রাজারাম উভয়েই বাল্যকালে বিবাহিত হন। বালাজী বাজীরাও নবম বৎসর বয়ক্রমে, বিশ্বাস রাও অষ্টম বৎসর , বড়মাধব রাও নবম বৎসর , নারায়ন রাও দশম বৎসর , সওয়াই মাধব রাও অষ্টম বৎসর, নানা ফড়নবিশ ১০ বৎসর সময় বিবাহিত হন।
শিরকে বংশের কন্যাকে পাত্রী রূপে নির্বাচন করেন শাহাজী। কন্যার নাম ছিল সইবাই । সইবাই ছিলেন পরম রূপবতী , কিন্তু রূপের থেকে তাঁর উচ্চ গুণের কদর হত অধিক। শিবাজী সময় সময় রাজনৈতিক প্রহেলিকায় অবসন্ন হয়ে পড়লে বীরাঙ্গনা সইবাই সুমন্ত্রীর ন্যায় যুক্তিযুক্ত উপদেশ প্রদান করতেন। অনেক সময় তাঁর উপদেশ অনুসারে শিবাজী নিজেকে পরিচালিত করে অনেক দুষ্কর কার্য সম্পন্ন করেছিলেন। তাঁর প্রেম ও স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা অতীব প্রগাঢ় ছিল।
শিব্বা রাওয়ের বিবাহের কিছুদিনের মধ্যেই জিজামাতা নব বরবধূকে নিয়ে পুনা প্রত্যাগমনের উদ্যোগ করতে লাগলেন।দাদোজী বার্ধক্যবশতঃ রাজকার্যকরণে অসমর্থ , এই নিমিত্ত শাহাজী সমীপে পুনা প্রান্তস্থ জায়গীর শাসনের নিমিত্ত কয়েকজন কর্মচারী প্রয়োজন সেই সংবাদ জ্ঞাপন করেন। শাহাজী দাদোজীর কথা অনুসারে শ্যামরাও নীলকন্ঠ পেশোয়া, বালকৃষ্ণ পন্তে মজুমদার, সনোপন্ত দবীর এবং রঘুনাথ বল্লালকে সবনীস পদে বরণ করেন । তাঁদেরকে জিজামাতার সঙ্গে পুনায় প্রেরণ করেন।প্রসঙ্গত বলে রাখি পেশোয়া বা পেশওয়া পদবী ছিল সৈনিক এবং রাজ্যশাসনবিষয়ক উচ্চতম কর্মচারীদের। পেশওয়া আসলে একটি আরবী শব্দ। ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণাত্যে গিয়াসউদ্দিন সা বামনী এই শব্দ প্রথমে ব্যবহার করেন। পরে #পেশবা এই শব্দ শিবাজীর ব্যবহারে সুপ্রচারিত হয়।
প্রধানঃ পেশবা তথা….
কিছু অমাত্য মজুমদার ছিলেন।” অমাত্য সাৎ মজুমদার।”যুক্তি প্রদানে অভিজ্ঞরাই ছিলেন দবীর। যুক্ত্য্যভিজ্ঞ দবীর সাৎ।সবনীস স্তথা সেনা লেখক পরিকীর্ত্তিতঃ।
উক্ত ব্যক্তিগন যথা সময়ে নির্বিঘ্নে পুনায় উপস্থিত হয়ে রাজকার্য সুচারুরূপে নির্বাহ করতে আরম্ভ করেন। বয়স্ক দাদোজী নতুন কর্মচারীদের যথোপযুক্ত উপদেশ প্রদান ও বিষয়কার্য হতে অবসর গ্রহণ করে ঈশ্বর চিন্তা এবং শিবাজীর চরিত্র গঠনে মনোনিবেশ করেন। এই সময় তিনি শিবাজীর অবস্থানের জন্য পুনায় বিখ্যাত রঙ্গমহল প্রাসাদ নির্মাণ করেন।ইহা শিবাজীর বড় ভালোবাসার স্থল ছিল।মাতার সঙ্গে তিনি অনেক দিন এই গৃহে অতিবাহিত করেন।
শিবাজীর বিজাপুর থেকে পুনা প্রত্যাগমনে সঙ্গে তাঁর চক্ষু হতে একটি আবরণ উদঘাটিত হল। ভ্রমনকালীন দাদোজী কন্ডো দেবের ন্যায় শিক্ষক , শিবাজীর ন্যায় শিষ্যকে কি রূপে স্বভাব পরিদর্শন করে তা অধ্যয়ন করতে হয় ,কিরূপে পরিদৃশ্যমান পদার্থে র অন্তঃস্থলে প্রবেশ করতে হয় ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দাদোজী শিব্বাকে উপদেশ প্রদান করতে আরম্ভ করেন। তিনি হিন্দু ও অখন্ড ভারত রাষ্ট্রকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দৃশ্যমান করতে লাগলেন শিবাজীর নিকট। শিব্বা রাও দেখলেন গ্রাম গুলি ম্লেচ্ছ সৈন্য কর্তৃক লুন্ঠিত, ভস্মীভূত, অত্যাচার – নিপীড়িত, ক্ষেত্র সকল অশ্বপদ বিক্ষেপে মর্দিত, কর্তিত এবং বিধ্বস্ত, গ্রাম পুরুষ শূন্য, দারুন দারিদ্র রাক্ষসী গ্রাম গুলিকে গ্রাস করেছে, সকলে ক্ষুধার্ত , জীর্ণ, শীর্ণ ও মুমূর্ষু। দেবালয় সকল খন্ডিত, স্ফুটিত ও চূর্ণী কৃত।
শিবাজীর হৃদয়পটে হিন্দু জাতির এক করুণ অবস্থা চিত্রিত হলো ।পুনা প্রত্যাগমনের পর শিবাজীর হৃদয় হতে অভিমান, অহংকারের ন্যায় কিছু নিম্ন শ্রেণীর মনোভাব দূরীভূত হল। সেই স্থলে স্বদেশানুরাগ প্রকটিত হল। এই সময় হতে তিনি উপলব্ধি করলেন হিন্দু ধর্মে কুত্রাপি উচ্চ নীচ ভেদ নাই। এখানে সকলেই আদিম , প্রাচীন , সনাতনী। এ জ্ঞান যদিও বৃদ্ধ দাদোজী শিব্বা রাওকে এই জ্ঞান দান করেছিলেন যে বর্ণাশ্রম সৃষ্টি কেবল কর্মের ভিত্তিতে। তাই সকলের ঈশ্বর ভজন , অস্ত্র ধারণ , রাজ্য রক্ষা এবং সেবার অধিকার আছে।
দাদোজী তাঁকে গীতার কথা শুনিয়েছেন…সেখানে বলা আছে :
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্ ।।
ভগবান শ্ৰী রামের বড় প্রিয় বন্ধু ছিলেন গুহক। তবে তাঁর প্রিয় সাথী কেন অত্যন্তজ শ্রেণী হতে পারবেন না ? বালক শিব্বা রাও অত্যন্তজ শ্রেণীর পুরুষদের সঙ্গে প্রীতিভাবে মিলতে আরম্ভ করলেন । সেই সমাজ দ্বারা সৃষ্ট অত্যন্তজ শ্রেণীর মানুষগুলি তবালক শিবাজীর প্রেমরজ্জুতে দৃঢ়বদ্ধ এরূপ হলেন যে, তাঁরা শিবাজীর জীবনের সঙ্গে অতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলেন।
এই অত্যন্তজ শ্রেণীর পুরুষদের কথা যে আমি উল্লেখ করলাম, এঁরাই হলেন শিবাজীর বিখ্যাত মবলা সৈন্য বাহিনী। ভগবান রামচন্দ্রের ন্যায় শিবাজী অতি যত্ন করে , উদ্যোগ ও অধ্যাবসায় এই সকল অরণ্যবাসী এবং সমাজ দ্বারা অচ্ছুৎ মানুষদের এরূপ সুশিক্ষিত ,যুদ্ধে নিপুণ এবং ক্লেশ সহিষ্ণু সৈন্যতে পরিণত করেছিলেন যে তাঁরা ভগবান শ্ৰী কৃষ্ণের নারায়ণী সেনার তুলনায় কোনো অংশে কম ছিল না। তাঁরা এক শরীরে পাহাড় ভাঙার ক্ষমতা রাখতেন। সমুদ্র গুপ্ত হুন আক্রমন ঠেকানোর নিমিত্ত যে তারা একজন শরীরে শক্তি ধারণ করেছিলেন তারা সমুদ্রগুপ্তের দ্বারা বিশেষ ভাবে নির্মিত হুন দমনকারী সেনাদের থেকে কোনো অংশে কম ছিলেন না।
এই সকল মবলা সৈন্যদল এতই রণপটু এবং দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেন যে , তাঁরা আলেকজান্ডার , প্রাচীন রোম ও হানিবলের সৈন্য অপেক্ষা কোন অংশে কম ছিলেন না। তাঁরা তুরস্কীয় সৈন্য জেনসীমারীগনের ন্যায় বিলাসপরায়ন হয়ে অকর্মণ্য হয়ে যান নাই। অন্তত শিবাজী জীবিত থাকাকালীন তো নয়ই। এঁরা নেপোলিয়ানের সুবিখ্যাত ইম্পীরিয়াল সৈন্যবাহিনী অপেক্ষা প্রভুর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন।
মহারাট্টা প্রদেশ শুষ্ক আবহাওয়া সম্পন্ন পাহাড়ী এলাকা…বৎসরান্তে বৃষ্টির পরিমান দেশের অন্যত্র তুলনায় স্বল্প। অরণ্যরাজীও ছিল যদিও। তবে দুর্গম গিরিপথ অরণ্য অপেক্ষা অধিক কঠিন ছিল। বর্ষার আগমনে সারা বৎসরের ঝির ঝির করে বহমান শীর্ণ নদী, গিরিখাত এবং নির্ঝরিনীগুলি অকস্মাৎ উত্তাল হয়ে উঠত। সে সময় অতিবড় যোদ্ধারও সাহস হত না সেই দুর্গম প্রকৃতিকে বিরক্ত করার। শিব্বা রাও তাঁর নির্মিত সৈন্যদের সঙ্গে সেই দুর্গম অভেদ্য পর্বতে পর্বতে , অরণ্যে অরণ্যে ভ্রমন করতেন। ফলে তাঁরা সকলে এরূপ অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে কোনো স্থানের উপল খন্ড কিরূপ ভাবে অবস্থিত , কোন স্থানে নির্ঝরিনী অথবা নদী কেমন করে প্রবাহিত, কোন জল বা কোন গাছের ফল খাদ্য যোগ্য, কোন পথ তাঁদের জন্য দ্রুত ও সুগম এবং শত্রুর জন্য নরক তুল্য এসব বিষয় নখদর্পণে ছিল।
যে সময় শিব্বা রাও মবলাগণকে একত্রিত করে সৈন্য বাহিনী নির্মাণ করেছিলেন, সে সময় মবলা সম্প্রদায় হিরডস্ , পবন, অন্দর ইত্যাদি দ্বাদশ উবিভাগে বিভক্ত ছিলেন। সেখানেও নিজেদের মধ্যে উচ্চ নিচ ইত্যাদি নিম্ন ধারণা ছিল। ফলত, মবলারা নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ বিবাদে ব্যস্ত থাকতেন। শিব্বা রাও তাঁদের অধিনায়কদের একে একে সাম ,দান , ভেদ , দন্ড দ্বারা বশীভূত করে তাঁদের পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৈন্য বাহিনীতে পরিনত করেন। স্বয়ং সেই বাহিনীর অধিনায়ক হন। মবলাগন পূর্ব বৈরী বিস্মৃত হয়ে সকলে এক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে একপ্রাণ এক হিন্দু হয়ে কার্য করতে প্রবৃত্ত হন।
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ছত্রপতি মহারাজ শিবাজীর জীবন চরিত