#পর্ব_৩
শাহাজী প্রায় ৭ থেকে ৮ বৎসর আপন পুত্র শিবাজী হতে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। তিনি পুত্রের অলৌকিক গুণপরম্পরা শ্রবণ করে তাঁদের দেখবার বাসনা তাঁর হৃদয় বড়ই প্রবল হল।শাহাজী তাঁর প্রথম স্ত্রী জিজাবাই এবং মধ্যম পুত্র শিবাজীকে আনয়ন করার নিমিত্ত দূত ,রক্ষী এবং বাহক প্রেরণ করলেন।
আচ্ছা আচ্ছা অবাক হলেন ? শাহাজীর প্রথম পত্নী এবং মধ্যম পুত্র শব্দ শুনে? শাহাজী দ্বিতীয় বার বিবাহ করেছিলেন। শাহাজী গর্ভিনী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে বিজাপুর রাজ্যে গমন করেন। ওদিকে লুখজী স্বীয় কন্যাকে বন্দিনী করেন। এসব কথা আমি পূর্বেই বলেছি। তো, পত্নীর প্রত্যর্পণের নিমিত্ত শাহাজী বারবার প্রার্থনা করে পাঠালেও শ্বশুর জামাতের আবেদনকে গ্রাহ্য করেননি। এদিকে শাহাজী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে দ্বিতীয়দ্বার পরিগ্রহন করলেন। শাহাজীর দ্বিতীয় পত্নীর নাম তুকাবাই। ইনি ছিলেন মাহিতের কন্যা এবং ভেঙ্কজীর গর্ভধারিনী।
ভেঙ্কজী তাঞ্জর মারাঠা বংশের স্থাপনা করেছিলেন । ভেঙ্কজী প্রতিষ্ঠিত বংশ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঞ্জর বা তাঞ্জাবুরুতে রাজত্ব করেছিলেন। যদিও এর পূর্বেই তাঞ্জর মারাঠা সাম্রাজ্যের অধিকাংশ ব্রিটিশ শাসনে চলে যায়। প্রসঙ্গত সোনার পাত দিয়ে নির্মিত তাঞ্জর চিত্রকলা পৃথিবী অন্যতম মূল্যবান ও সুন্দর চিত্রকলা বলে পরিগণিত হয়।
তো যাই হোক, ইতিহাস বলে উক্ত কারনে জিজাবাই কোনোদিনই শাহাজীকে হৃদয় হতে ক্ষমা করতে পারেন নি। সেই কারণেই জিজামাতা পুত্র শিবাজীকে হিন্দুত্বের স্বাভিমান ও স্বরাজের শিক্ষা দান করেছিলেন। বিদেশি নয় দেশের মানুষই দেশ শাসন ও দেশ সেবার অধিকারী এই চিন্তা তিনি ও দাদোজী শিবাজীর মস্তিকে বপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা শিবাজীকে পিতার ন্যায় ম্লেচ্ছদের অধীনস্থ হয়ে কাজ নয় বরং স্বায়ত্তশাসক হতে শিখিয়েছিলেন।
শাহাজী প্রথম যেদিন শিবাজীকে দেখলেন তিনি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে রইলেন। শিবাজীর নবদূর্বাদলের ন্যায় বর্ন, উন্নত ললাট, বিশাল নেত্র, ধনুকের ন্যায় ভ্রু যুগল , তিলফুলসম অগ্রভাগণত নাসিকা, সূক্ষ্ম ওষ্ঠদ্বয়, সুগঠিত চিবুক, সুন্দর গ্রীবা, বিস্তৃত বক্ষ, আজানুলম্বিত বাহু, সুবিভক্ত সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে শাহাজী যারপরনাই বিস্মিত এবং আহ্লাদিত হলেন।শাহাজী মুরারাও প্রমুখ প্রধান প্রধান কর্মচারীগণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মুরারাও জগদেব বিজাপুর নিজামশাহী দরবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি অতীব বিচক্ষণ ব্রাহ্মণ ছিলেন। তো, সেসব রাজকর্মচারী শিবাজীর নির্ভীকতা , বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিভা দর্শন করে নিজামের নিকট বালকের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। নবাব বড় কৌতুহলী হলেন শিবাজীকে নিয়ে এবং শিবাজীকে তাঁর সম্মুখে আনয়নের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।
বালক শিবাজী আমন্ত্রণের সংবাদ শ্রবণ অবধি পিতাকে বললেন , ” আমরা হিন্দু তাঁরা যবন , তাঁদের অপেক্ষা নীচ জাতি আর কেহ নাই। দরবারে গমন করলেই তাঁদের প্রণাম করতে হবে। তাঁদের প্রণাম করতে আমার প্রাণ কণ্ঠাগত হয়। পথিমধ্যে গোহত্যা অবলোকন করলে আমার হৃদয়ে বৃশ্চিক দংশন প্রায় যাতনা হয় । তখন খুব ইচ্ছাকরে এই সকল ম্লেচ্ছদের শিরচ্ছেদন করি। পাছে আপনারা বিরক্ত হন সেই চিন্তা করে আমি এসব কার্য হতে নিজেকে বিরত রাখি। যাঁরা ধর্মনিন্দা ও গোব্রাহ্মনের প্রতি অন্যায় অত্যাচার করে, তারা যতই শক্তিশালী হোকনা কেন তাঁদের নিকট আমার যেতে কিছু মাত্র প্রবৃত্তি হয় না। “
শাহাজী পুত্রের হৃদগত ভাব অবগত হলেন, তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু শিবাজী তাঁর দৃঢ় অধ্যাবসায় হতে বিচলিত হলেন না। পিতার বহু আদেশ , অনুরোধ এবং উপরোধের পর অবশেষে শিবাজী বললেন , ” যাঁরা গো ব্রাহ্মন তথা হিন্দুদের এবং দেবতার অনিষ্টসাধনের কর্মে নিযুক্ত, যাঁরা আমাদের সঙ্গে পশুর ন্যায় আচরণ করে ,যারা আমাদের স্বাধীনতা হরণ করে আমাদের দাস ভাবে রেখেছেন, কেমন করে সেই সব ম্লেচ্ছ দস্যুদের নিকট গমন করব। প্রাণ বহির্গত আমি স্বইচ্ছায় ওঁদের নিকট গমন করব না। তবে আপনি আমার পিতা। দাদোজী শিখিয়েছেন –
পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম: পিত্য হি পরমং তপ:
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা
সুতরাং আপনাদের আদেশ শিরোধার্য। “
বালক শিবাজী বিষন্ন ভাবে এইরূপ উত্তর প্রদান করে মৌনাবলম্বন করলেন।শাহাজী মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। কারন তিনি নিজামের রুটি নমক খান। পুত্র এমন ধারা হলে বাস উঠবে। কারাবাস হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
একদিন শাহাজী নবাবের আদেশানুসারে পুত্রকে নিয়ে রাজসভায় গমন করলেন। শিবাজী কোনো প্রকার প্রণাম না করেই আসনে উপবেশন করলেন। এমন ধারা ব্যবহার দেখে নিজাম বাদশাহ ভারী অবাক হলেন। অভিবাদন না করার কারন তিনি প্রধানমন্ত্রী মুরার রাওকে শুধোলেন। বিচক্ষণ ব্রাহ্মন মুরার রাও শিবাজীর প্রকৃতি ও মনোভাব সম্পর্কে প্রথম থেকেই অবগত ছিলেন এবং তাতে তিনি সূক্ষ্ম মদতও দিয়েছিলেন। তাই নবাবের প্রশ্নে সেসব গুপ্ত করে তাঁর অনভিজ্ঞতা নিবেদন করেন। সুন্দর ফুলের মতো বালক শিবাজীকে নবাবও ভাবেন যে এসব শিশু বয়সের খামখেয়ালীপনা । তাই নবাব শিবাজীর সঙ্গে আলাপ করতে বসেন।
নবাব শিবাজীর সঙ্গে আলাপ করে ভারী খুশি হন। সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে নানা প্রকার অলঙ্কার এবং সুন্দর পরিচ্ছদ প্রদান করেন। গৃহে প্রত্যাগমন করে শিবাজী পরিধেয় বস্ত্র ত্যাগ এবং স্নান করে পবিত্র হন। বালক শিবাজী বাল্যকাল হতে ম্লেচ্ছ বিদ্বেষ এরূপ দৃঢ়ভূত হয়েছিল যে, তাঁদের উৎকর্ষ শিবাজী সম্মুখে করলে তাঁর মুখমন্ডল আরক্ত হয়ে তাঁকে অধীর করে তুলত। এরূপ অবস্থায় শিবাজীকে কখন রাজধানী মধ্যে রাখা হিতকর নয় এরূপ বিবেচনা করে শাহাজী তাঁকে পুনায় পাঠানোর নিমিত্ত কৃতসংকল্প হন।
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ছত্রপতি মহারাজ শিবাজীর জীবন চরিত