#মহারাট্টার_উত্তরপুরুষ

#পর্ব_২
ভারতের পশ্চিম প্রান্তে প্রায় একই সময়ে দুইটি বীজ অতীব সামান্য ভাবে সংরোপিত হয়। কালক্রমে সেই দুই বীজ বিস্তার লাভ করে ভারতের আকাশকে আচ্ছাদিত করেছিল। এর মধ্যে একটি ছিল বিষবৃক্ষ আর অন্যটি ছিল অমৃত ফল বৃক্ষ। প্রথমটি ছিল , বণিকের বেশ ধরে আসা ইংরেজরা সুরাটে পদার্পন করেন।এর সম্পর্কে ইতিহাসজ্ঞ পাঠক সবিশেষ জ্ঞাত আছেন। দ্বিতীয়ত , শিবাজী জন্মগ্রহণ করে মহারাট্টা সাম্রাজ্য স্থাপনা করেন। পরে মহারাট্টারা দেড় শত বৎসর ধরে ভারতের অদৃষ্টকে নিজ ইচ্ছানুসারে পরিচালিত করেছিলেন। 


ঐদিকে নিজমশাহী রাজ্যে শান্তি স্থাপিত হল। শাহাজী তখন বিজাপুর রাজদরবারের এক সম্মানীয় সদস্য তথা সেনা নায়ক। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে নিজমশাহী , আদিলশাহী, আদিশাহী রাজন্যবর্গ ম্লেচ্ছ হলেও হিন্দুদের হাতেই রাজশক্তি প্রচুর পরিমানে ন্যস্ত ছিল। দ্রব্যবান ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই অল্প সময়ের সময়ের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সৈন্যবল সংগ্রহ করতে সমর্থ হতেন। সেকালে বহু সংখ্যক লোক যুদ্ধ দ্বারা নিজের জীবিকা নির্বাহ করতেন। ধনবান হলেই গার কিছু না কিছু সৈনিক থাকা আবশ্যক ছিল।  তাই ১০ বা ১৫ হাজার সৈন্যর অধিপতি এরূপ হিন্দু সে সময় মহারাষ্ট্রপ্রদেশে অনেকেই বতর্মান ছিলেন।


সমগ্র দেশের পরিস্থিতি এরূপ থাকলে হিন্দুদের স্বার্থপরতার জন্য – রাজনৈতিক বিষয়ে অদূরদর্শিতার নিমিত্ত প্রায় প্রত্যেক যুদ্ধে হিন্দুরা ম্লেচ্ছদের হাতে লাঞ্ছিত হতেন না। প্রসঙ্গত যিনি যখন অধিকতর কর্তব্যপরায়ণ হন তিনিই তখন জয়যুক্ত হয়ে থাকেন। তাই গীতায় পরমপুরুষ বলেছিলেন –   
“শ্রেয়ান্‌ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহ”। 
যা হোক, শাহাজী বিজাপুর দরবারের মধ্যস্থতায় নিজের পূর্বতন জায়গীর, স্ত্রী পুত্র পুনঃপ্রাপ্তির নিমিত্ত আবেদন করলেন।তৎকালীন বিজাপুর দরবারের কর্মচারীগন তাতে দোষের কিছু দেখলেন না, শাহাজীর এতে ন্যায্য অধিকার আছে। সুতরাং তাঁর উপর আপত্তি তো করলেনই না উপরন্তু শাহাজীকে জায়গীরাদি পুনঃ প্রদান করলেন। 


সকল গুন ও সুলক্ষণ নিয়ে শিশু শিবাজী বড় উঠতে থাকলেন। শাহাজী পুত্রের শিক্ষা দান নিমিত্ত এক চাণক্যর ন্যায় এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন। সেই ব্যক্তি একজন বিশ্বস্ত ,বুদ্ধিমান,বহুল জ্ঞান সম্পন্ন , রাজনীতি ও যুদ্ধে পারদর্শী এক ব্রাহ্মন ছিলেন । তাঁর নাম হল দাদোজী কন্ডো দেব। তাঁরই প্রযত্নে শিবাজী একজন অদ্বিতীয় অশ্বারোহী, লক্ষ্যভেদক, কূটনীতিজ্ঞ, বিচক্ষণ রাজা, অস্ত্র ও সেনা পরিচালক এবং যুদ্ধবিদ্যা পারদর্শী হয়েছিলেন।
সেই দাদোজীর উপদেশাবলী শিবাজীকে শৈশব হতে ভারতের শোচনীয় অবস্থা চিন্তা করতে শিখিয়েছিল। সেখান হতে হিন্দু সাম্রাজ্য সংস্থাপনের প্রদীপ শিখাটি প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল।


ভাবনা, ইচ্ছাশক্তি দ্বারা মানুষের অদৃষ্ট চক্র অনেক সময়আশ্চর্যরূপে পরিবর্তন হয়েছে। একটি ভাবনা বা একটি চিন্তা, একটি নিয়মনীতি , একটি আদর্শ দ্বারা মানিশ দেবতা অথবা পিশাচে পরিণত হয়। পূর্বপুরুষের সে সকল মহদ্ গুণাবলী শত শত বৎসর ধরে যা বিকশিত হয় নি, মানুষ একবার প্রবুদ্ধ হলে পুনরায় সেসকল গুনরাজী বিকাশ প্রাপ্ত হয়ে থাকে। জিজাবাই নিজের স্বপ্ন ও শ্বশুরের কথায় স্থির করেছিলেন যে তাঁর শিবাজীই গো ব্রাহ্মন করে রক্ষা করিতে সচেষ্ট হবেন এবং বিপুল রাজ্যশ্ৰী লাভ করবেন।
শিবাজীর শৈশব কালে তাঁর অজ্ঞাতসারেই জিজাবাইএর ইচ্ছারূপ বীজ শিবাজীর মানস ক্ষেত্রে উপ্ত হয়েছিল।
শাহাজী , দাদোজী কন্ডো দেব ব্যতীত জিজাবাইএর রক্ষণাবেক্ষণের নিমিত্ত  এবং তাঁর জায়গীর শাসনের নিমিত্ত কৃষ্ণাজীপন্ত হনুমন্তে, সক্রোজী নীলকন্ঠ, সোনাপন্ত প্রভৃতি কয়েকজন অতীব নিপুণ বিশ্বস্ত কর্মচারীকে নিযুক্ত করেন। 


দাদোজী কন্ডোদেবের অপরিসীম যত্নে শিবাজী ক্ষত্রিয়োচিত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে লাগলেন। দাদোজী পুস্তকাক্ষর গণনায় হয়ত দীক্ষিত করতেন ,কিন্তু তার থেকে বেশী বীররসে অভিষিক্ত করাকেই শ্রেয়স্কর বলে মনে করতে । তিনি সর্বদা বেদাদি, পুরাণাদি রামায়ন , মহাভারত , গীতা এবং অন্যান্য শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদি থেকে বীররসোদ্দীপক অংশ সকল পাঠ করতেন। গোব্রাহ্মনের নিমিত্ত, ধর্ম সংস্থাপনের নিমিত্ত , শত্রুর  আক্রমণ হতে জন্মভূমিকে রক্ষা করবার জন্য, ম্লেচ্ছগণের পাশব পীড়ন হতে স্বীয় ধর্মকে উদ্ধার করবার জন্য, সকল চতুর বর্নকে অস্ত্রধারণ করাকে সর্বতোভাবে বিধেয় করার শিক্ষাই প্রদান করতেন দাদোজী।দাদোজী শিশু শিবাজীর হৃদয়স্থলে ভৈরব মূর্তি , যুদ্ধনিহত ব্যক্তির স্পৃহনীয় পরলোক , তাঁর পূর্বপুরুষগনের অসাধারণ বীরত্ব , স্বদেশপ্রেমিকতা , নিঃস্বার্থপরতা ইত্যাদিকে চিত্র সুন্দর ভাবে অঙ্কিত করেন। 


বৃদ্ধ বহুদর্শী ব্রাহ্মণ দাদোজী , শিবাজীর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা দেখে মানবচরিত্র পরীক্ষা , অপরের নিকট স্বীয় অভিপ্রায় গোপন ইত্যাদি রাজনৈতিক পন্ডিতদের শিক্ষণীয় গুন সকল বাল্যকাল হতে নিপুনতার সঙ্গে শিক্ষা প্রদান করতে শুরু করেন।
এইরূপে শিবাজীরূপ উর্বর ক্ষেত্রে দাদোজীর উপদেশ রূপ অতু‍্যত্তম  বীজ যথাকালে পতিত হয়ে উপযুক্ত সময়ে সুস্নিগ্ধ শ্যামল পত্র, সুগন্ধিত পুষ্প, সুস্বাদু শস্যপিন্ড এবং বৃহৎ ছায়া যুক্ত বৃক্ষে হয়। সকল ক্ষেত্রে সকলের ভাগ্যে এমন উত্তম বীজ বা এমন উত্তম বীজ বপনকারী বা যত্নশীল ব্যক্তি মেলেনা । আর মিললে সকলের আবার সকল উত্তম বীজ বা বপনকারীর বা যত্নশীল ব্যক্তির সর্বগুন সম্পন্ন উর্বর ভূমি মেলে না । বহু বীজ মরু অঞ্চলে পতিত হয়ে এবং বহু ভূমি র বীজ অযত্নের নিমিত্ত নষ্ট হয়। শিবাজী ও দাদোজী উভয়ই ভাগ্যক্রমে উত্তম বীজ ও উর্বর ভূমি প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ছত্রপতি মহারাজ শিবাজীর জীবন চরিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.