সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বিরোধিতায় সিপিএম যখন রাজপথে ঠিক তখনই প্রকাশ্যে এল শরনার্থীদের নিয়ে সিপিএম দলের ২০১২ সালে কেরলের কোঝিকড় পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত ও ওই সময় তৎকালীন ইউডিএ সরকারে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে লেখা প্রকাশ কারাতের একটি চিঠি। যাতে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার পক্ষেই সওয়াল করা হয়েছিল! যদিও এই চিঠি এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে সিপিএম পলিটব্যুরো গত ৮ ডিসেম্বর বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে ‘বিজেপির মিথ্যাপ্রচার উন্মোচন’।
এই বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, তাঁরা শরণার্থীদের নাগরিকত্বের বিরোধী নন। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে এই আইন পাশ হয়েছে। মুসলিমদের শরণার্থীদের এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তাই তাঁরা এর বিরোধিতা করছেন।
সিপিএমের কোঝিকোড়ে ৪ থেকে ৯ এপ্রিল ২০১২-তে অনুষ্ঠিত ২০তম পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তাবনা যেটি সিদ্ধান্ত আকারে রয়েছে সিপিআইএম ডট ওআরজি ওয়েবসাইটে তাতে বলা হয়েছে,‘ এই পার্টি কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাচ্ছে যে, এদেশে আসা বিপুল সংখ্যক বাঙালি শরণার্থীদের ভারতের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বিবেচনা করা হোক। যারা পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন। যাদের অধিকাংশই তফসিলি জাতি, প্রধানত নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ এবং এদের সকলেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে বসবাস করছেন। সেইসঙ্গে এই পার্টি কংগ্রেসে একটি বিষয় উঠে এসেছে, তা হল- বর্তমানে যে আধার অভিযান চলছে, সেখানে এই সম্প্রদায়ের সকলেই তীব্র নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ২০০৩ নিয়ে আলোচনার সময় সমস্ত রাজনৈতিক দলই বিষয়টিকে সমর্থন জানিয়েছে যে- যে সমস্ত নাগরিক ঐতিহাসিক পরিস্থিতির কারণে নির্যাতনের শিকার তাঁদের সুরক্ষা দেওয়া। অনেক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এখনও আইন এদের সকলেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারি হিসাবে দেখা হচ্ছে। তাদের ক্ষেত্রে এমন মামলা হচ্ছে, যেন তাঁরা অপরাধী।
এই পার্টি কংগ্রেস বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের ক্ষেত্রে উক্ত নাগরিকত্ব আইনের ধারা ২ (আই) (বি)-র উপযুক্ত সংশোধন দাবি করেছে। সেইসঙ্গে অসম চুক্তির সুরক্ষার ক্ষেত্রে এটি করা উচিত যা অসমের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। কেন্দ্রীয় সরকার সংসদের আসন্ন বাজেট অধিবেশনেই এই সংক্রান্ত সংশোধনী আনার দাবি জানিয়েছে। যেটি এই সম্প্রদায়গুলির ন্যায্য দাবির সংগ্রামকে সিপিআই(এম)এর সমর্থনের আশ্বাস দেয়।
ঠিক একই ভাবে সিপিএমের কেন্দ্রীয় ভাবে প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা পিপলস ডেমোক্রাসি ওয়েবভার্সানে পাওয়া যাচ্ছে ৩ জুন ২০১২-র সংখ্যায় তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাতের লেখা সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে লেখা একটি আবেদনমূলক চিঠি। ২০১২ সালে ২২ মে এই চিঠি পাঠানো হয়েছিল মনমোহন সিংকে। যাতে ‘বাঙালি শরণার্থীদের অধিকার দিন’ শিরোনামে কারাত লিখেছেন,‘ নাগরিকত্ব সমস্যা শুরু হয়েছিল, যখন পূর্ব বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণে শরণার্থীরা আসতে শুরু করে। কারণ বাংলাদেশ গঠনের পরেও নানান রাজনৈতিক কারণে ওই সব শরণার্থীদের দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। অর্থনৈতিক কারণে যারা সেই সময় পূর্ব বাংলা থেকে চলে এসেছিল তাদের থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা পরিস্থিতি ছিল উদ্বাস্তুদের।
পাশাপাশি চিঠিতে লেখা হয়েছে, ২০০৩ সালে সংসদে নাগরিকত্ব ইস্যুটি যখন ওঠে আপনি বিরোধী দলের নেতা হিসাবে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছিলেন। এনডিএ সরকারের অধীনে ২০০৩ সালে সংশোধনী বিল রাখা হয়েছিল। ওই বিলে প্রভাবিত হতে পারে এমন বিভিন্ন শ্রেণি মধ্যে কোনও পার্থক্য রাখা হয়নি। সেই সময় আপনি বলেছিলেন যে “আমাদের দেশ বিভাগের পরে শরণার্থীদের সঙ্গে বিষয়ে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলির সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে এই অসহায় মানুষদের আমাদের দেশে আশ্রয় দিতে হয় তাহলে এই দুর্ভাগ্যজনক ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও উদার হওয়া উচিত। আমি ধন্যবাদ জানাই আপনাকে, এবং সেইসঙ্গে আমরা আশাবাদি উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবেন।’
সেই আবেদনের ভিত্তিতে উপ-প্রধানমন্ত্রী লাল কৃষ্ণ আদবানি বলেন, বিরোধী দলনেতার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ রূপে একমত। বাংলাদেশ থেকে আসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের বিষয়ে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ২০০৩ এর ধারা ২ (আই) (বি) এর উপযুক্ত সংশোধন করে এটি অনুসরণ করা উচিত ছিল। কিন্তু তারপরেও প্রায় এক দশক ধরে বিষয়টি বিচারাধীন রয়েছে। এরই মধ্যে শরণার্থীদের মনে এই নিরাপত্তাহীনতাবোধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। যেহেতু আধারের বর্তমান অভিযানে তারা বাদ পড়েছে। অবৈধ শরণার্থীদের হুমকির সামনে পড়তে হচ্ছে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, এদের বেশিরভাগই নমশুদ্র, পোন্ড্রক্ষত্রিয়, মাঝি প্রভৃতি তফসিলি সম্প্রদায়ের।
যদিও এ প্রশ্নে শরণার্থীদের নিয়ে সিপিএম দ্বিচারিতা করছে বলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অম্বিকা রায় বলেন,‘ আমরা নিখিল ভারত বাঙালি উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির পক্ষ থেকে ২০১২-তে বৃন্দা কারাতে সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁর ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত এবং চিঠি দিয়েছিল সিপিএম। এখানে পরিষ্কার তাঁরা দলিত শ্রেণি বিশেষত নমশূদ্র, পোন্ড ক্ষত্রিয়র কথা বলেছিলেন। মুসলমানদের নাগরিকত্ব চাননি। এই দলিত শ্রেণির মানুষরা সবাই হিন্দু। তখন চাইলেন এখন বিরোধিতা করছেন কেন? শুধু তাই নয় সংবিধানের যে ধারায় নাগরিকত্বের কথা বলা হচ্ছে সেই ধারায় মোদি সরকার আমদের নাগরিকত্ব দিচ্ছেন।’
সাংসদ শান্তুনু ঠাকুর বলেন,‘ এরা ভোটের রাজনীতিই করছে। মারিচঝাঁপিতে গণহত্যার তদন্ত হয়নি। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারও করেনি। মানুষ এর জবাব দেবে।’