চতুর্থ অধ্যায় – তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে নববর্ষ

চতুর্থ_অধ্যায়

আহ্নিক আর বার্ষিক গতিতে পৃথিবীর চলন সীমাবদ্ধ নয়। তার আরও একটি গতি আছে। পৃথিবীর অক্ষ নিজের কক্ষতলের নিজের কক্ষতলের উপর লম্ব নয়।তাই ২৫৮০০ বছরে লম্বের চারিদিকে একবার আবর্তন করে পৃথিবীর অক্ষ। পরিণামে , সূর্যের তুলনায় ক্রান্তিবৃত্ত ও বিষুবরেখা ছেদ বিন্দুও ২৫৮০০ বছরে একবার ৩৬০ ডিগ্রি আবর্তিত হয়। একেই অয়ন বা মেরুগতি বলে। সুদীর্ঘ বছর ধরে এই যে চলন , এখানে পৃথিবীর লক্ষ্যও অস্থির হতে বাধ্য হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় , আজকের পৃথিবীর চলন ধারা ধ্রুবতারার অভিমুখে । কিন্তু একটা সময়ের পর আর তা থাকবে না।

এ প্রসঙ্গে কামিনীকুমার দে বলেছেন :

ড্রেকো মন্ডলের আলফা অর্থাৎ সর্বজ্জ্বল তারাটি প্রসিদ্ধ। শিশুমারের শেষ তারা এবং সপ্তর্ষির বশিষ্ঠের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত এই তারাটি পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে আমাদের ধ্রুবতারা ছিল। তখন খ গোলকের মেরুবিন্দু ইহার কাছাকাছি ছিল এবং উত্তর আকাশে ইহাকে স্থির নিশ্চল মনে হইত । আকাশের তারাগুলি প্রত্যেকে ইহাকে কেন্দ্র করিয়া আকাশ পরিক্রমা করিত।মেরুবিন্দু ক্রমে অতি ধীর গতিতে সরিয়া বর্তমানে শিশুমার মন্ডলের সর্বজ্জ্বল তারার কাছে আসিয়াছে এবং ইহা আমাদের বর্তমান ধ্রুবতারা ।(এখন হইতে ৫০০০ বছর পরে মেরুবিন্দু সিফিউস মন্ডলের উজ্জ্বলতম তারার কাছে যাইবে ; ১২০০০ বছর পরে উত্তর আকাশের উজ্জ্বলতম তারা অভিজিতের কাছে যাইবে এবং ইহারা যথাক্রমে ধ্রুবতারা রূপে গণ্য হইবে। )

কামিনীবাবুর বক্তব্য পড়ার পর মহামান্য তিলকের অনুমান সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। কিন্তু এর একটা প্রভাব পৃথিবীর উপর অতি দ্রুত অনুভূত হয়। নিসর্গের পরিবর্তন ঘটে যাবে আগামী ৪ -৫ হাজার বছরের মধ্যে। তার কারণ ঋতুর পরিবর্তন ঘটবে। যে সময় বর্ষা আসার কথা সে সময় বর্ষা আসবে না ।কৃষিকাজের সময় যাবে কৃষি কাজের সময় যাবে বদলে। তাই কখনো মার্গশীর্ষ কখনো বা ফাল্গুনী পূর্ণিমা তে বছরের সূচনা হত, আবার হয়তো সেই একই ভাবে আবার অন্য কোন সময় বছরের সূচনা হবে।

আমাদের অনুমান প্রাচীন পণ্ডিতগণ অয়ন নিয়ে কোন আলোচনা স্পষ্ট না করলেও বিষয়টিকে যথেষ্টভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। অনেক পরের শতকের মাঝামাঝি সময়ে একমাত্র দ্বিতীয় আর্যভট্ট #আর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থটিতে অয়নগতি সংক্রান্ত ভাবনা ব্যক্ত করেছেন।

সেদিনের সুপ্রাচীন মানুষগণ বৎসর গণনা করতেন চান্দ্র দিবস বা মাস ধরে। পূর্ণিমার পরদিন থেকে আরেক এক পূর্ণিমা অবধি। মাস ছিল ৩০ দিনের আর ৩৬০ দিনে হত বৎসর। এজন্য কখনো কখনো এক মাস বেশি ধরে অধিবাসের ব্যবস্থা ছিল । কিন্তু চন্দ্রের পরিক্রমণে অভাব ছিল শৃংখলার । তাই নক্ষত্রে তিথির হিসেবে চন্দ্রের ভোগকালের ২৭ নক্ষত্রের চেয়েও বেশি জরুরি ছিল রাশি গণনা। কেন না সৌর দিবসের হিসেব না রাখলে সবকিছুই গোলমাল । একমাত্র পঞ্জিকা ছাড়া বিশুদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিথির কোন গুরুত্ব নেই । তাই প্রাচীন পণ্ডিতগণ আকাশের বুকে কল্পনা করেন ১২ রাশির নিয়ে একটি চক্র । একে আমরা বলি রাশিচক্র।

খালি চোখে আমরা দেখি সূর্যের আকাশ পরিক্রমা। এই চলন কিন্তু কোন সরলরেখা ধরে নয়। সূর্য কখনো দক্ষিণ দিক ঘেঁষে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে পৌঁছানোর পর আবার উত্তরমুখী হয় । তখন দেখা যায় সূর্য চলছে উত্তর দিকে ধরে। উত্তর ও দক্ষিণে নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যস্থল বৃত্তাকার ১৬ ডিগ্রি পরিমিত। বলয়াকৃতি এই স্থানকে রাশি দ্বারা চিহ্নিত করা হয় । প্রাচীন ভারতের ঋষিগণ এই বলয়পথের দিয়েছিলেন #বৈশ্বানর_পথ বা #রবিমার্গ ।অর্থাৎ সূর্যের চলন পথ । আর বর্তমান জ্যোতির্বিজ্ঞানে এর নাম #ক্রান্তিবৃত্ত।

এই ক্রান্তিবৃত্ত কে প্রাচীনকাল থেকে ১২ ভাগে ভাগ করা হয়। ১২ ভাগ অর্থাৎ ১২ রাশি। সূর্য প্রতিমাসে একটি রাশি কে অতিক্রম করে । বছরে বারো রাশি অতিক্রম করতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ৯ মিনিট ৯.৫ সেকেন্ড।

১২ রাশি অর্থাৎ ১২ তারকা মন্ডল । সুদূর প্রাচীনকাল থেকে মণ্ডল গুলি কে চিহ্নিত করা হয় কোনো পার্থিব জীব বা বস্তুর নামে । কেন না কোন মন্ডল দেখতে মেষ বা বৃষের মতো হয় । ১২ মন্ডলের নাম তাই যথাক্রমে মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট , সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর , কুম্ভ, মীন।

আকাশের বুকের মধ্যে হিরের মতো জ্বলা তারা গুলির সমষ্টিকে রেখা দ্বারা যুক্ত করে এক একটি জীব বা বস্তু বা অবয়ব পায়। সূর্য এই রাশি বা তারকা পুঞ্জ পেরিয়ে বারো মাস পরে পুনশ্চঃ ফিরে আসে প্রথম পুঞ্জে বা মন্ডলে।

প্রতিটি মন্ডলের উজ্জ্বল নক্ষত্রটির নামে বারোটি মাসের নামও ঠিক করেন প্রাচীন পন্ডিতগণ । এ প্রসঙ্গে একটি কথা খুবই জরুরি। বৈদিক যুগে মাস সব সময় থাকত চান্দ্র বা চন্দ্র কেন্দ্রিক । কিন্তু বছরটি থাকতো সৌর ।পূর্ণিমান্ত মাস গণনাই প্রচলিত ছিল । অর্থাৎ পূর্ণিমা থেকে নতুন মাসের সূচনা হত।

যে নক্ষত্রের অবস্থান কালে চন্দ্রের পূর্ণিমা সেই নক্ষত্রের নাম অনুসারে গড়ে উঠত মাসের নাম । যেমন- বিশাখা নক্ষত্রের পূর্ণিমা হলে বৈশাখ ।সূর্য তখন মেষ রাশিতে অবস্থান করে। তেমনি সূর্যের বৃষ রাশিতে অবস্থান কালে চন্দ্র জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র গেলে পূর্ণিমা হবে । তাই জ্যৈষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের নাম। এইভাবেই পূর্বষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ , অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, মঘা থেকে মাঘ ইত্যাদি।

কিন্তু সূর্যের উপস্থিত কালে এই নক্ষত্রগুলোকে খালি চোখে দেখা যায় না আকাশে । তাহলে প্রাচীনকালে কিভাবে রাশিচক্র নির্ণীত হল ? আসলে চন্দ্রের ভ্রমণপথে এইসব নক্ষত্রের অবস্থান । তাই চাঁদের পরিক্রমন সূত্রে তাঁদের এই আবিষ্কার। কামিনীকুমার মহাশয় এই নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন । একে তিনি ” মাস , দিল, সময় নির্দেশক চিরস্থায়ী তারা ঘড়ি” নাম দিয়েছেন।

মঘা তারা মাঘ মাসে পূবেতে ভাতিবে,
উত্তর ফাল্গুনী তারা ফাল্গুনে উদিবে।
চিত্রা স্বাতী এক সঙ্গে চৈত্রের আকাশে
বৈশাখে বিশাখা তারা ধীরে ধীরে আসে।
জ্যৈষ্ঠ মাসে দুই তারা অভিজিৎ জ্যৈষ্ঠা ,
আষাঢ় শ্রাবনে দেখ শ্রবণা ধনিষ্ঠা।
ভাদ্রপদা ফোমালোকে ভাদ্রেতে পাইবে,
আশ্বিনে অশ্বিনী তারা উদিত হইবে।
কৃত্তিকা ও মৃগশিরা পর দুই মাসে,
পৌষেতে লুব্ধক পুষ্যা আকাশেতে।

ক্রমশঃ

দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১ . লোকায়ত রাঢ় বঙ্গ
২. বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন ভারত ও সমকালীন অন্যান্য দেশ
৩. ঋগ্বেদ সংহিতা
৪. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
৫. বঙ্গাব্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.