প্রবন্ধ: বাঙ্গালী বলতে কাদের বোঝায়ঃ একটি সাম্প্রতিক বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙ্গালী পরিচয় নির্মাণ

বিগত কয়েক দশক ধরেই এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা অপচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাঙ্গালী পরিচয়টাকে গুলিয়ে দেওয়ার। এই প্রচেষ্টা ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৬০ এর দশকের তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশে। কেন এই প্রচেষ্টা? ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অবিভক্তবঙ্গেযেব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় তা থেকে অধিকাংশ বাংলাভাষী মুসলিম নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখেছিল। মনে রাখতে হবে যে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত ভারতবর্ষে মুসলিম লীগ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল বাংলাভাষী মুসলিমরা। মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন ঢাকার নবাব সলিমউল্লাহ। পরবর্তীকালে মহম্মদ আলি জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে (এই তত্ত্ব অনুযায়ী হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি এবং তারা কখনই একত্রে বসবাস করতে পারে না) মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান দাবী করে তখনওপ্রায় সমগ্র বাংলাভাষী মুসলিম সমাজই এতে সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর তারা লক্ষ্য করে যে উর্দুভাষী মুসলিমরাই সমগ্র পাকিস্তানে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। বাংলাভাষী মুসলিমদের পাকিস্তানে প্রায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা হয়েছে। তখন নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে তারা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু তখনও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ২০% এর কাছাকাছি অমুসলিম। তাই তাদের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য সেখ মুজিবর রহমানরা বাঙ্গালীত্বের এই নতুন সংজ্ঞা জনপ্রিয় করে তোলে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলা ভাষায় যে কথা বলে সেই বাঙ্গালী।সেখানে যারা এতদিন মুসলিম বলে সগর্বে নিজেদের পরিচয় দিয়ে এসেছিল, যারা এতদিন বাঙ্গালীদের কাফের ও মালাউন বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করত, ১৯৪৬ এর নোয়াখালী গণহত্যা এবং ১৯৫০ ও ৬০ এর দশকের অসংখ্য দাঙ্গায় যারা নির্বিচারে বাঙ্গালী হত্যা করেছিল, তারাও নিজেদের বাঙ্গালী বলে দাবী করতে থাকে নিছক বাংলা ভাষায় কথা বলার সুবাদে।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর শ্রীকান্তউপন্যাসে বাঙ্গালী ও মুসলমানদের একটি ফুটবল ম্যাচের কথা  লিখেছেন। বামপন্থী সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়তাঁর আমি কি বাঙালি? নামক বইটিতে উল্লেখ করেছেন যে, ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যন্তও বাংলার মুসলমান নিজেকে কেবলই মুসলমান বলেছে, আর হিন্দু প্রতিবেশীকে ডেকেছে বাঙালী বলে। এর স্বপক্ষে তিনি একটি পুলিশ রেকর্ড উল্লেখ করেছেন যেখানে বিংশ শতকের প্রথম দিকে পূর্ববঙ্গের একদল বাংলাভাষী মুসলিম গ্রামবাসী এজাহার দিতে গিয়ে বলছে যে, এই গ্রামে মোট পাঁচ ঘর বাঙালী, বাকী সব মুসলমান। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের আগমনের পর কয়েকশত বছর ধরে বাংলায় এটাই ছিল দস্তুর। যারা ভয়ে-ভক্তিতে বা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তির কারণে (অধিকাংশই এই কারণে) আরবের মরুভূমিতে উদ্ভূত কাল্টটি গ্রহণ করতেনবা করতে বাধ্য হতেন তাদের বলা হত মুসলমান এবং বাকী এই অঞ্চলে বসবাসকারি দেশজ সংস্কৃতি ও ধর্মাচরণে বিশ্বাসী মানুষদের বলা হত বাঙ্গালী। উপরিউক্ত তথ্যগুলি থেকেই এ কথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাভাষী মুসলিমদের বাঙ্গালী বলার চল ছিল না (আর তারা নিজেরাও নিজেদেরকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতেন না) এবং ১৯৬০ এর দশক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কী উদ্দেশ্যে বাংলাভাষী মুসলিমদের বাঙ্গালীত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে নতুন বাঙ্গালীসংজ্ঞানির্মাণকরারচেষ্টাকরাহলতানিশ্চয়ইএতক্ষণেআমাদেরকাছেপরিষ্কার।

তাহলে বাঙ্গালী বলতে আমরা কাদের বুঝব?

বাঙ্গালীহলএকটিভাষাওসংস্কৃতিগতপরিচয়।অর্থাৎবাঙ্গালীহতেগেলেনিশ্চয়ইতারমাতৃভাষাবাংলাহতেহবে; কিন্তু শুধু ভাষা দিয়েই তার পরিচয় নির্ধারণ সম্ভব নয়। ভাষার ভিত্তিতে জাতির পরিচয় দিতে গেলে তো অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার মানুষদেরও ব্রিটিশ বলতে হয়, যেহেতু তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি। কিন্তু তারা আমেরিকান ও অস্ট্রেলিয়ান হিসাবেই পরিচিত হন। ঠিক একই যুক্তিতে কলকাতার বাঙ্গালী কোন বালক-বালিকা ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়ার ফলে বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে বেশিস্বচ্ছন্দ হলেও সে ইংরেজ হয়ে যায় না।

তাছাড়া শুধুমাত্র ভাষার মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির পরিচিতিকরণে আরেকটি বড় সমস্যা আছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলা ভাষা মোটামুটিভাবে ১০০০-১২০০ বছর পুরান। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদও সমসাময়িক কালের। তাহলে ১০০০-১২০০ বছর আগে ভাগীরথী ও পদ্মার চারপাশে বসবাসকারী মানুষদের কি বাঙ্গালী বলা হবে না? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর কয়েকহাজার বছরের বঙ্গভূমির ইতিহাস সংক্রান্ত ক্লাসিক গ্রন্থটির নাম দিয়েছেন বাঙ্গালীর ইতিহাসঃ আদি পর্ব। সুতরাং তিনি বাংলা ভাষার উদ্ভবের সঙ্গে বাঙ্গালী পরিচয় নির্মাণটাকে গুলিয়ে ফেলেননি।  

ওপরের আলোচনাতেই পরিষ্কার যে বাঙ্গালী কারা বুঝতে গেলে ভাষা নয়, সংস্কৃতিগত পরিচয়ই আমাদের প্রধান মানদণ্ড হওয়া উচিত। বাঙ্গালী সেই যার কোন ইন্ডিক নাম আছে, কোন একটি ভারতীয় দর্শনে সে বিশ্বাসী, দুর্গা-কালী- সরস্বতীকে মাতৃরূপে উপাসনা করে (উত্তর চব্বিশ পরগণার চন্দ্রকেতুগড়ে ২৫০০ বছরেরও বেশি পুরান যে প্রাচীন সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে সেখানে প্রাপ্ত বহু দেবী মূর্তি প্রমাণ করে যে বাঙ্গালী চিরকালই মাতৃ-পূজক বা শক্তির উপাসক), দেশীয় বেশভূষার প্রতি আস্থা আছে এবং কয়েক হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী এবং ভাগীরথী ও পদ্মার দুই তীরে কয়েক হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।

বাংলাভাষী মুসলিমদের কেন বাঙ্গালী বলা যায় না?

১। মুসলিমরা বাংলা বা কোন দেশীয় ভাষায় নয়; মূলত আরবি বা ফার্সিতে নিজের সন্তানদের নামকরণ করে।

২। তাদের প্রথম কালেমায় আছে লা ইলাহা ইল্লালাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। অর্থাৎ ভারতীয় দেব-দেবী এবং ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শনের প্রতি তাদের মনোভাব সহজেই অনুমেয়।

৩। তাদের পোশাক-পরিধানে বোরখা-হিজাব-ফেজটুপি প্রভৃতি দেখা যায়- যার কোনটাই ভারতীয় বা বাঙ্গালীদের ঐতিহ্যগত পোশাক নয়।

৪। মুসলিমরা ভারতীয় কোন ধর্ম নয়, পশ্চিম এশিয়ার মরুভূমিতে উদ্ভূত একটি কাল্ট বা রিলিজিয়নে বিশ্বাসী (প্রসঙ্গত বলা যায় যে ধর্ম ও রিলিজিয়ন এক জিনিস নয়। ধর্ম কিছু নৈতিকতার সমষ্টি, বৃহত্তর অর্থে জীবনচর্যা, যা রিলিজিয়নের তুলনায় অনেক বেশি ব্যাপ্ত)।

৫। বাংলাভাষী মুসলিমদের একটা অন্যতম প্রবণতাই হল বাংলা ভাষার মধ্যে বেশি করে আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ। যেটা অবশ্যই তাদের বাংলা ও বাঙ্গালী বিরোধী মানসিকতারই পরিচায়ক।

অধ্যাপক তমাল দাশগুপ্ত তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখছেন যে, সুনির্দিষ্ট হিন্দু সাংস্কৃতিক পরিচয় ছাড়া কোন বাঙ্গালী পরিচয় অসম্ভব। বাঙ্গালী হিন্দু এই বাক্যবন্ধটি একটি পুনরুক্তি বা টটোলজি। বাঙ্গালী হতে গেলে বৃহত্তর অর্থে হিন্দু হতেই হবে, অন্যথায়, আপনি শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলেন, এ দেশের আবহমানকালের সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রায় আপনার ভাগিদারী নেই এবং বাঙ্গালী হিসাবে আপনি গণ্য হতে পারেন না।

পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে বাঙ্গালী হতে গেলে মাতৃভাষা বাংলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বাঙ্গালী সংস্কৃতির অনুসারীও হতে হবে। আর এই বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলতে ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, উৎসব-অনুষ্ঠান, পালা-পার্বণ সবই বোঝায়। সহজভাবে বললে হালখাতা, রথযাত্রা, দুর্গোৎসব, কালীপূজা, ভাইফোঁটা, নবান্ন, সরস্বতী পূজা, চৈত্রসংক্রান্তি প্রভৃতি নিয়ে বাঙ্গালীর যে বার মাসে তের পার্বণ তা বাঙ্গালী সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যে সমস্ত মানুষ বাঙ্গালীর এই সংস্কৃতিকে অনুসরণ করেন বা পালন করেন বা এই ঐতিহ্যগত চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করেন তিনিই বাঙ্গালী।।।

(প্রবন্ধটি ‘স্বস্তিকা’ পত্রিকায় ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সালে নীল ব্যানার্জি ছদ্মনামে লেখক প্রকাশকরেছিলেন।)

অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.