প্রাচীন তন্তুবায় গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কথা

একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা ।
পশ্যৈতা দুষ্ট মষ্যেব বিশন্ত্যো মদবিভূতয়ঃ।।

তিনি আদি , তিনি নিত্য, তিনিই সনাতনী। তিনি বিভক্ত হন নানা ভূমিকায় আপাত ভিন্নতায় । ভাগ হয়ে যান সমাজ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে। সনাতনী নানা মার্গে বিভিন্ন প্রস্থানে তিনিই অবস্থান করেন নানা রূপে।তিনিই আদি পরাশক্তি মহামায়া মহামেধা। তিনিই বেদোক্ত সরস্বতী , ঊষা, তিনিই অদিতি, তিনিই দুর্গা। তিনিই মহালক্ষ্মী । তিনিই চন্ডী। তিনি নানা মতে , নানাভাবে অন্নপূর্ণা, চামুন্ডা, ছিন্নমস্তা । তিনিই তন্ত্রের দশমহাবিদ্যা। তিনিই দার্শনিক তত্ত্ব ত্যাগ করে লৌকিক মাতা মঙ্গলচন্ডী, গৌরী, উমা, সর্পদেবী। বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলি দেবীকে একেবারে প্রাণের মাঝে আপন করে নিয়েছে। তিনি তখন ভূমি মাতা, তিনি জন কল্যাণী ।

ক্রমে তিনিই হয়ে উঠেছেন বন্যপশুকুলের রক্ষয়িত্রী চণ্ডী, বনদুর্গা। তিনি বল্লুকা কুলে শিবের ঘরণী হয়ে শস্য উৎপাদন করেন। তিনি শাঁখা পরেন, আলতা , সিঁদুরে লাল হয়ে সংসার প্রতিপালন করেন।

অর্থাৎ , সুরলোক, সুমেরু পর্বত, ইলাবৃতবর্ষ , হিমালয় কিংবা বিষ্ণুর নাভিপদ্মে নিশ্চিন্ত যোগনিদ্রা ছেড়ে প্রত্যক্ষ যুক্ত হয়ে যান গ্রাম্যজীবনের সঙ্গে, একটি ধীবর সমাজ, একটি কৃষি সমাজ , একটি সূত্রধর সমাজ ইত্যাদির সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যান। এক হয়ে যান গ্রাম্য প্রাচীন আচার অনুষ্ঠান , আশা আকাঙ্খার সঙ্গে।

” ….Earth…A female figure…” বা ” a divine figure” …

তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন সনাতনী চিন্তায়। ব্রহ্মময়ী মা তাঁর সকল রূপভেদের সমন্বিত চেহারায় আদিমাতা , পৃথ্বীমাতা। তাই কেবলমাত্র মা দুর্গা দুর্গতি নাশিনীই নন , তাঁর রূপভেদ জাত দেবীরাই সম্পর্কিত হয়ে পড়েন আমাদের সমাজ – চরিত্রের সঙ্গে।

সনাতনী ভারতবর্ষে অসংখ্য লৌকিক – আঞ্চলিক দেবী বিভিন্ন নামে দুর্গা – আদ্যাশক্তি – মহামায়া হিসাবে পূজিতা হন। অনেক ক্ষেত্রেই অনুরূপ দেবী মূর্তি বা মূর্তি নয় এমন প্রাকৃতিক উপাদানও পূজা হন মা রূপে। সুপ্রাচীন শাক্তপীঠ ভারতের প্রাচীন স্থান বঙ্গও সেই নিয়মের ব্যতিক্রমে যায় নি। নানা ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষির বঙ্গ , নানা মহারথী রাজা মহারাজার বঙ্গভূমি সতী পীঠ , তন্ত্রের মহাক্ষেত্র। এখানে নানা রূপে, নানা নামে এবং নানা নামে আদি মাতৃশক্তি উপাসিত হন । যেমন – বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা , মন্তেশ্বরের মা চামুন্ডা, যাজিগ্রামের শাকম্ভরী, মির্জাপুর এবং কলিগ্রামের দেবী জয় দুর্গা ….এমন অজস্র উদাহরণ আছে।

আজ আমি এমনি মাতৃ উপাসনার কথা ও তাঁর মন্দিরের কথা বলব। তিনি হলেন #হরিপালচৌতারারদেবী_ভবানী। ভবের এই সংসার যিনি চালনা করেন তিনিই ভবানী। ভব অর্থাৎ শিব। শিব অর্থাৎ পরম ব্রহ্ম । তিনি নিরাকার হয়েও সাকার। তিনি গুণের গুণময় তাই তিনি নির্গুণ। তিনি শূণ্য শূণ্য মহাশূণ‍্য‍ । তাঁর সেই মহাশূণ‍্যর যিনি শক্তি তিনিই মহামায়া আদি পরাশক্তি। এই ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ীর হাতেই সৃষ্টি এই মায়ার জগৎ। তাই তিনি ভবের ভাবময় সংসারের সদা কর্ত্রী। তিনিই ভবানী। এছাড়াও ভব হলেন এগারো জন রুদ্রের অন্যতম। তিনিই প্রলয়ংকর অগ্নির সাক্ষাৎ স্বরূপ। ভবানী অর্থাৎ – Parvati in her pacific and amiable form. A devi of the Sakti cult. ( হরিবংশপুরাণ)

জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।

দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোঽস্তু তে।।

হে দেবী, তুমি সর্বোৎকৃষ্টা জয়যুক্তা দেবী জয়ন্তী; তুমি জন্মমৃত্যুবিনাশিনী মোক্ষপ্রদায়িনী দেবী মঙ্গলা; তুমি সর্বসংহারকারিণী কালী; তুমি সুখদায়িনী ভদ্রকালী; আবার তুমিই প্রলয়কালে ব্রহ্মা প্রমুখের মাথার খুলি হস্তে নৃত্যরতা কপালিনী। তুমি দুর্গা, কারণ বহু কষ্ট স্বীকার করে তবে তোমায় লাভ করা যায়; তুমি চৈতন্যময়ী শিবা; তুমি করুণাময়ী ক্ষমা; তুমি বিশ্বধারিণী ধাত্রী; তুমি দেবগণের পোষণকর্ত্রী স্বাহা ও পিতৃগণের পোষণকর্ত্রী স্বধা। তোমায় নমস্কার করি।

শক্তিস্বরূপিণী মা ভবানী শান্ত ও রুদ্র প্রলয়ঙ্করী ভেদে বিবিধ প্রকৃতি। তিনি এই শক্তির বঙ্গে তথা সনাতনী প্রাচীন ভারতের দেবী শেষোক্ত রূপে পূজিতা হন । চৈত্র শুক্ল পঞ্চমীতে দেবীর আবির্ভাব হয় । ওই দিন তাই ভবানী ব্রত পালন করা হয়। শৈবগণ নিরাকার ব্রহ্ম স্বরূপ শিবলিঙ্গ এবং শিবের শক্তি যোগিনী স্বরূপ ভবানীর উপাসনা করেন।

ভবানী শব্দের বুৎপত্তি নির্ণয় করলে পাই – ভব – ভবত্যাস্যাৎ , ভু + অপ – ভব্ + আনুক – ভব + আন্ – ভবান্ – ভবান্ + ঙীপ ( স্ত্রী প্রত্যয় ) – ভবান্ + ঈ – ভবানী । #চণ্ডী – র অষ্টম অধ্যায় দেবীর ধ্যানমন্ত্রে বলা হয়েছে –

অরুণাং করুণাতরঙ্গিতাক্ষীং ধৃতপাশাঙ্কুশ
মুখ্যচাপ হস্তাম্।
অণিমাদিভিরাবৃতাং ময়ূখৈরহমিত্যের বিভাবয়ে ভবানীম্।।

অর্থাৎ, যিনি অরুণবর্ণ ও যাঁর নয়ন থেকে অবিরত কৃপাতরঙ্গ উত্থিত হচ্ছে ; যাঁর চতুর্হস্ত পাশ , অঙ্কুশ , পূর্ণচাপ ও শর এবং যিনি অণিমা অষ্টসিদ্ধিপরিবৃতা ও জ্যোতিরাশিমন্ডিতা তিনিই ভবানী।

প্রাণতোষণী মন্ত্রের মধ্যে দেবী ভবানীর স্তুতিমন্ত্রে বলা হয়েছে –

ত্রিনেত্রাং হাস্যসংযুক্তাং সর্ব্বালঙ্কার ভুষিতাম্ ।
বিজয়াংত্বামহং বন্দে দুর্গাং দুর্গতিনাশিনীম্।।
ব্রহ্মাদিভিঃ স্তূয়মানাং সিদ্ধ গন্ধর্বসেবিতাম্ ।
ভবানীং ত্বামহং বন্দে দুর্গাং দুর্গতিনাশিনীম্।।

অর্থাৎ , ত্রিনয়নী হাস্যময়ী অলঙ্কারে ভূষিতা দেবী , ব্রহ্মাদি দেবগণ যাঁর স্তব পাঠ করেন এবং সিদ্ধ ও গন্ধর্ব প্রভৃতি দেবগণ যাঁর সেবা করেন , সেই দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা ভাবনী নামে বন্দনা করছি।

এই ধরাধামে শক্তির আরাধনা শুরু হয় শরৎকাল থেকেই, দেবী দুর্গার অসুরনাশিনী মূর্তি পূজার মধ্যে দিয়ে। অন্য দিকে, মরাঠা বীর ছত্রপতি শিবাজীর আরাধ্যা দেবী ভবানী। শিবাজীর তরবারির নামও ছিল ভবানী । মহাশক্তি ভবানী রূপে উদয় হয়ে শ্রী রামদাসের কৃপায় শিবাজীকে শক্তিপূত অসি দিয়েছিলেন এবং স্বাধীন মহারাষ্ট্র গঠনে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি উপাসিতা হতেন রাজপুত রাজবংশেও।

ভাবনীর শাস্ত্রীয় পরিচয়ের পাশাপাশি তাঁর লোকায়ত স্বরূপটি উপেক্ষার নয়। গ্রাম্য সমাজে তিনি শাস্ত্রীয় , দার্শনিক আভরণ পরিত্যাগ করে আটপৌরে তাঁতের শাড়ি পরিধান করেছেন। তিনি সেখানে নিরাভরণ হয়েও ধনসম্পদা। তাঁকে আপন করে নিয়েছেন উচ্চ নীচ সকল বর্ণের মানুষ। তাঁর নিকট এসে থেকে গেছে উঁচু নিচুর বাছবিচার। সকলে মা ব্রহ্মময়ীর সনাতনী সন্তান হয়ে আরাধনা করছেন। লোকসাধরণের নিকট তিনি গ্রামের কুলদেবী। তিনি রোগ – তাপ – শোক – হরণকারিণী এক আশ্চর্য দেবী।

চৌতারা তন্তুবায় প্রধান গ্রাম। সেখানে ঘরে ঘরে তাঁত বোনা হয়। গ্রামের নাগ ও পাল পরিবার হল বর্ধিষ্ণু পরিবার। আর গ্রামে আছে বাগদী ও বাউড়ি সম্প্রদায়। এছাড়াও আছে এক ঘর ব্রাহ্মণ, এক ঘর বেনে , একঘর কর্মকার , একঘর নাপিত । তাঁত ছাড়াও এখানের মানুষের অন্যজীবিকা বলতে বোধয় কৃষিকাজ। কোথাও সেথায় দুই ফসলী জমি , কোথাও তিন ফসলী জমি। সেসব জমিতে উৎপন্ন হয় ধান, পাট, আলু। গ্রামে যাতায়াতের পথ হল – #হরিপালরাধানগররোড। বছর চল্লিশ আগে এখানে আলপথই ভরসা ছিল। গাঁ ঘরের ছেলেমেয়েরা পাটের জল মাড়িয়ে পাঠশালায় পড়তে যেত। বর্ষাকালে জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে একাকার অবস্থা হতো। এখন গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় মা ভবানীর মন্দিরের ঠিক বিপরীতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পথ কৌশিকী নদী পেরিয়ে চলে গেছে কৈকালা অভিমুখে।

চৌতারা গ্রাম নামের উৎস এবং শব্দটির বানান নিয়ে দ্বিমত আছে। ‘র’ ও ‘ড়’ – দুই ই সমান তালে প্রচলিত। চৌতারা অর্থাৎ , চত্বর। কৃত্তিবাস ওঝার রচনায় পাই –

বাহির চৌতারায় রাম করেন দেওয়ান।
ছত্রিশ কোটি সেনাপতি দাণ্ডায় প্রধান।।

সেই অর্থে এক চত্বর ভুমিখন্ড নিয়ে নাতিবৃহৎ গ্রাম “চৌতারা “। আবার চৌতার শব্দ থেকে চৌতারা হতে পারে এবং সেই সম্ভবনা প্রবল। #চৌতার = চৌ ( <চতুঃ) তার ( সূত্র) । মধ্যযুগে বঙ্গে চরকার সূতায় তৈরি বস্ত্র বিশেষ বা কাপড় কে বলা হতো চৌতার ।

প্রসঙ্গত বলে রাখি , বঙ্গ শব্দের অর্থ হলো #কার্পাসতুলো । #আল সংস্কৃত শব্দের মানে হল #সমৃদ্ধ….. অর্থাৎ বাঙ্গাল শব্দের অর্থ হলো #কার্পাসতুলোসমৃদ্ধঅঞ্চল ।অনেকে এরকম মনে করেন যে অস্ট্রিক ভাষা শব্দ #বোঙ্গা থেকে বঙ্গ শব্দের উৎপত্তি । আবার তামিল ভাষায় বঙ্গ মানে #সুতিবস্ত্র । বস্ত্র ব্যবসায়ীরা বঙ্গ বলতে বোঝেন #তাঁত। তামিল শব্দটির সংস্কৃত রূপ দ্রাবিড়। আর এস মুগালি “কন্নড় সাহিত্যের ইতিহাস” গ্রন্থে লিখেছেন ” দ্রাবিড় কথাটি তামিল কথারই সংস্কৃত রূপ”….

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ” বঙ্গীয় শব্দকোষ” গ্রন্থে বঙ্গ শব্দের অর্থ নির্ণয় প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন :

১. রঙ্গ, রাং, টিন ২. কার্পাস ৩. বেগুন গাছ ৪.বঙ্গদেশ

মহাভারতে রাজা বলি …. তাঁর পাঁচ পুত্র ছিলেন। তার মধ্যে এক পুত্র হলেন বঙ্গ। বঙ্গের অধিকার স্থিত দেশ বঙ্গদেশ। তিব্বতীয় #bans শব্দের অর্থ হলো জলময়, স্যাঁতস্যাঁতে। যার সঙ্গে বঙ্গের সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। বঙ্গদেশ ছিল নদী বহুল ও জল বিধৌত। আমরা সে তথ্যঃ রঘুবংশেও পাই।

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তার “বাঙ্গালার ইতিহাস” গ্রন্থে লিখেছিলেন “বঙ্গ রাজ্য সমুদ্র তীরস্থ”।

সুতরাং উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয়- বঙ্গ শব্দের সঙ্গে কৃষি, বীরত্ব এবং জল এই তিনটি বিষয় নানাভাবে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে ।

নীহাররঞ্জন রায় “বাঙ্গালীর ইতিহাস” গ্রন্থে বলেছেন – বঙ্গ শব্দের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় #ঐতেরয়_আরণ্যকে।

বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদাঃ।

এছাড়াও রামায়ণ-মহাভারতে #বঙ্গ এর উল্লেখ রয়েছে ।

১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নেপালের স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরে “বঙ্গাল অধিপতি” বলে একটি শব্দ পাওয়া গিয়েছে। উক্ত সকল কারনে তাই বঙ্গবাসী বাঙ্গালী।

এই সেই বাংলা বা বঙ্গাল যেখানে প্রথম ধান পাওয়া যায় । খ্রীস্টপূর্ব ৩৫০০ সময়কাল… বর্তমান বিহারের সারন জেলার চিরন্দতের। পরেশ চন্দ্র দাশগুপ্তের “এক্সক্যাভেশন ইন পাণ্ডুরাজাস ঢিবি” গ্রন্থে তার সাক্ষ্য মেলে।

বাঙ্গালী বীর এবং বণিক জাতি। শুধু কৃষি নয় কুটির ও গ্রামীণ শিল্পসহ স্বর্ণ , বস্ত্র শিল্পে দক্ষ এক জাতি ।পৃথিবীতে তুলোর পোশাকের অগ্রদূত প্রাচীন বঙ্গবাসী। সমুদ্রযাত্রার অসামান্য পারদর্শী ।আমরা নীহাররঞ্জন রায় থেকে শুরু করে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যেকটি ঐতিহাসিকের বাঙ্গালীর ইতিহাসে সে কথা জানতে পারি । রামায়ণ, মহাভারত, রঘুবংশ, চাণক্য, ওভিদের রচনা, গ্রীক ঐতিহাসিক প্লিনির বিবরন, মেগাস্থিনিসের বিবরণ তার সাক্ষ্য বহন করে চলে। মহাপদ্মবংশ উল্লিখিত বাঙ্গালার #সিংহগড়ের (সিঙ্গুর ) সন্তান বীর বিজয় সিংহের লঙ্কা বিজয় ও লঙ্কার নাম সিংহল হওয়ার ঘটনা রয়েছে ।শুশুনিয়া লিপিতে মেলে সে ইতিহাস।

মহাভারতের রাজা বলি পাঁচ পুত্র : অঙ্গ, বঙ্গ, সুব্হ্ম, সমতট, পৌন্ড্র। বলি রাজার মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভেপাঁচ পুত্রের জন্ম হয় । তাদের নামে পাঁচটি রাজ্য । মহাভারতে বলা হয়েছে:

অঙ্গবঙ্গঃ কলিঙ্গশ্চ পুণ্ড্রঃ সুব্হ্ম তে সুতাঃ।
তেষাঃ দেশাঃ সমাখ্যাতাঃ স্বনামনা কথিতা ভুবি।।

রামায়ণে দশরথের প্রিয় বন্ধু ছিলেন অঙ্গরাজ্যের রাজা।মহাভারতে কর্ণ ছিলেন অঙ্গরাজ। মহাভারতের পৌন্ড্ররাজ বাসুদেবের কথা রয়েছে, ইনি কৌরব পক্ষে ছিলেন। চেদি রাজ ছিলেন শিশুপাল। মহাভারতে অনুযায়ী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় পৌন্ড্রবর্ধনের রাজা ছিলেন পৌন্ড্র বাসুদেব, কৌশিকগুচ্ছে মহৌজা, বঙ্গে সমুদ্রসেন রাজত্ব করেছিলেন।

একটা সময় পর্যন্ত চরকাই প্রাচীন হিন্দু জাতির বস্ত্র যোগান দিত। তখন কল-কারখানা বা অন্য কোনো বিপুলায়তন যন্ত্রের প্রচলন ছিল, এরূপ মনে করা যায় না। কিন্তু কত পূর্ব কাল হতে যে চরকা এদেশে বস্ত্রদান করিয়া আসিতেছিল তাঁহা নিশ্চিতরূপে নির্ণয় করা কঠিন । যতদিন থেকে হিন্দুগণ বস্ত্র ব্যবহার করে আসছেন, ততদিন হতেই চরকার সৃষ্টি হয়েছিল বলে অনুমান করা যেতে পারে।

আর অতি সুদুরকাল হতে অখন্ড ভারতবাসী তাঁদের সভ্যতায় সমুন্নত ছিলেন এবং সভ্যজনোচিত বসনাদি ব্যবহার করতেন, তা সুনিশ্চিতরূপে বলা যায়। সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা যে কতকাল আগের , তা বারংবার উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। পুরাণাদির সাক্ষ্য গ্রহণ করলে সেকালের সীমা নির্ণয় হয় না ; বর্তমান কালের ঐতিহাসিকদিগের বিবেচনাতেও উহা বিংশ, ত্রিংশ বা পঞ্চাশং শতাব্দী খ্ৰীষ্ট-পূৰ্ব্ব যুগে গিয়ে পড়ে। সেই অতিপ্রাচীন কাল হতেই যে বয়নশিল্প ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, এবং ভারতীয় সভ্যতার পরিচ্ছদ জোগাত, তাতে সন্দেহ নেই।

ঋগ্বেদ পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ তা মহাপন্ডিতগন স্বীকার করেছেন । বেদে ধর্মনীতি হতে সমাজনীতি, রাজনীতি আদি বস্তুবিষয়ের মৌলিক তত্ত্ব নিহিত আছে। তৎকালে হিন্দুদের সামাজিক গঠন, শিল্প-নৈপুণ্য প্রভৃতি কিরূপ ছিল, বৈদিক গ্রন্থে তার আভাস পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের সূক্তসমূহ যে সময়ে প্রচলিত হয়, মানবইতিহাসের সেই প্রাচীনতম যুগে, হিন্দু পূর্বপুরুষগণ বয়ন-শিল্প সবিশেষ অবগত ছিলেন ; এবং সভ্যজনোচিত .বেশভূষাদি পরিধান করতেন। বিবিধ মন্ত্র হতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

উষ্ণনীয় শব্দটির অর্থ হল মস্তকের ভূষণ বা বসন । বৈদিক গ্রন্থে এর বহুল উল্লেখ আছে—
বিজ্ঞানং বাসোহরূনষণীয়ং ; ( অথর্ব ১৫,১৫ )…
এছাড়াও মৈত্রেয় সংহিতা (৪।৪৩ ), কঠক সংহিতা (১৩১- ) ঐতরেয় (৬১), শতপথব্রাহ্মণ ( ৩৩২৩ ) প্রভৃতি আরও অনেক স্থলে এর দৃষ্টান্ত আছে।

‘পরিধান’ শব্দের অর্থ সাধারণ কাপড় বা ধুতি ; “নোবি’র অর্থ ভিতরে পরিবার বস্ত্র, ন্যাগট-বিশেষ ; “অধিবাস” অর্থে উপরে গায়ে দেবার কাপড়-ওড়না বুঝায়। বৈদিক মন্ত্রে এদের উল্লেখ আছে—

বত্তে বাসঃ পরিধানং যাং নোবিং কৃণুষে জন্ম।
শিবং তনবে তৎকৃন্মঃ সংস্পর্শে দ্রম্ভমন্তুতে ॥ (खर्षर्वि-४२॥१७ ) —যেই বস্ত্র তোমার ধুতিরূপে পরিধান করিয়াছ, যাহা তার নীচে পরিয়াছ, তাহা তোমার শরীরের পক্ষে উত্তম শোভাদায়ক হইয়াছে, আর উহাতে তোমার শরীরে স্বল্পর্শ করিবে মাত্র।

আবার, অধিবাসং পরিমাতুরিহন্নহং (ঋগ্বেদ) -ইহা মাতার উপরে-পরিবার (উড়নী ) বস্ত্র।

যজ্ঞোপবীত বা পৈতা ধারণের যে সংস্কার এবং পৈতার গঠনতন্ত্র সম্পর্কে যে শাস্ত্রনির্দেশ সেই দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।।

“কার্পাসমুপবীতং স্যাদ্বিপ্রস্যোর্দ্ধবৃতং ত্রিবৃৎ।
শণসূত্রময়ং রাজ্ঞো বৈশ্যস্যাবিকসৌত ্রিকম্।।”
অর্থাৎঃ কার্পাসের তিনটি সূত্র দুই করতলমধ্যে ধারণ করত দক্ষিণকর উর্দ্ধে ও বামকর নিম্নে চালনা দ্বারা যে সুত্র প্রস্থুত হয়, তাহাকে ঐরূপ হস্তমধ্যে ধারণপূর্বক বামকর উর্দ্ধে ও দক্ষিণকর নিম্নে চালনা করিলে যে সুত্র প্রস্তুত হয় তাহাকে তিনবার গ্রন্থী বন্ধন করিলে যজ্ঞপবিত হয়।।

রাঢ়বঙ্গ নাতিশীতোষ্ণ এখানকার মানুষ তাই হালকা পোশাক পরিধান করতেন। যেমন পুরুষেরা পড়তেন ধুতি ,চাদর ,জামা উত্তরীয় এবং পাটের তৈরি মোটা কাপড়। আর নারীদের মধ্যে শাড়ি ছিল পরিধেয় ।

পূর্বাঞ্চলে কার্পাস দ্বারা তৈরি হতো মসলিন নামক এক ধরনের পরিধেয় । অভিজাত শ্রেণীর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ছিল। শ্রেণী ভেদে স্বতন্ত্র পরিধেয়র কথা জানা যায় । তবে সে নির্ভর করত অর্থনীতির উপর । দরিদ্র , সন্ন্যাসী মানুষেরা এক ধরনের পোশাক পরত অপরদিকে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা ব্যবহার করতেন আর এক রকমের পোশাক। জীবনযাপনের জন্য একটিমাত্র বস্ত্র ছিল সাধারণ মানুষের পরিধেয় ।লজ্জা নিবারণের জন্য সামান্যটুকু ব্যবহার করতেন। সাধারণ দরিদ্র মানুষের মধ্যে এক টুকরো কাপড় দিয়ে বানানো কৌপিন ,খুত্র প্রভৃতি পরিধানের চলছিল। এছাড়া শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে জীবনধারণের মান কত নিম্নস্তরের ছিল তা বোঝা যায় পাট ও শনের মোটা কাপড়, ধুকড়ি, খুত্র ইত্যাদি বস্ত্র পরিধানের দিকে তাকালে। এগুলোর মূল্য কম ছিল।
কার্পাসের সন্ধান আমরা চর্যাগীতি গ্রন্থ থেকেই পেয়ে যাই। এই গ্রন্থ সাধনার আনন্দ সংগীত । এর অনেক পদের অর্থ অবশ্য সুস্পষ্ট নয় ।তথাপি নানা রাগরাগিণীর এই গানগুলো সাধনার আনন্দ প্রকাশ করে থাকে এ কথা সহজেই বোঝা যায় ।

উপরক্ত পদটি কবি শবরপাদের রচিত। এর প্রথম দুই লাইনের তিব্বতি অনুবাদ হতে সংস্কৃত অনুবাদ করেছিলেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয়-

মম উদ্যানবাটিকাং দৃষ্টা খসম সমতুল্যাম্।
কার্পাসপুষ্পম্ প্রস্ফুটিতম্ অত্যর্থং ভবতি।।

বাড়ির বাগানে কার্পাসফুল ফুটেছে, দেখেই আনন্দ, যেন ঘরের চারপাশে উজ্জ্বল হল ,আকাশের অন্ধকার দূরীভূত হল। এই হতে উপলব্ধি করা যায় যে কার্পাসকে ঠিক কতখানি মূল্য প্রদান করা হতো তদানীন্তন বঙ্গ।

শান্তিপাদের একটি পদে আছে –
তুলা ধুঁনি আঁসুরে আঁসু ।
আঁসু ধুনি ধুনি নিরবর সেসু ॥
তুলা ধুঁনি ধুঁনি সুনে আহারিউ ।
পুন লৈয়া অপনা চটারিউ ॥

  তুলা ধুন তা হতে তৈরি হচ্ছে আঁশ ।
  আঁশ ধুনে ধুনে শেষ ॥
  তুলা ধুনে ধুনে শুন্যে উড়াচ্ছি ।
  পুনঃ লৈয়া আপনি ছড়াচ্ছি ॥

হয়তো এর কোনো গূঢ় অর্থ আছে। কিন্তু তুলা ধুনার জন্য যে এই বাস্তব চিত্র তাতে সন্দেহ নেই ।

কাহ্নপাদের একটি পদে আছে:

তান্তি বিকণঅ ডোম্বী অবর ন চাংগেড়া

  ডম্বিনী বাঁশের তৈরি তাঁত বিক্রয় করছে।

সাধারণত ডম্বিনী রাই বোধয় বাঁশ দিয়ে তাঁত তৈরি করে বিক্রি করত।

আর একটি পদের রচয়িতার নাম পাইতেছি। তন্ত্রীপাদ। তন্ত্রীপাদের বুৎপত্তিগত অর্থ হল, তাঁত-শিক্ষক অথবা তাঁতী-গুরু। এটাই বোধয় সেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পদ-রচয়িতার পূর্বতন বৃত্তি ছিল। পরে তিনি ‘সিদ্ধ” হন।

চর্যাপদ গীতিকায় একমাত্র তন্ত্রীপার পদটিই খুঁজে পাওয়া যায় নি। এজন্য তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না। তন্ত্রীপাদের পদটি বৌদ্ধগানের খণ্ডিত অংশে থাকায় আমরা তা পাই না। বৌদ্ধাগানের সংকলন ‘Buddist Mystic Songs’ গ্রন্থে বলা হয়েছে- “Tantripa is the author of the song no. 25. He was a disciple of Jalandharipa and afterwards of Kanhapa. In the ms. He is missing.”

তবে তন্ত্রীপাদের ২৫ নম্বর পদটির তিব্বতী অনুবাদ হতে প্ৰবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয় যে সংস্কৃত অনুবাদ করেছিলেন তার কিয়দংশ হতে অনুভব করা যায়, গীত ও সাধন-সংবদ্ধ সমস্ত রূপকটি গড়ে উঠেছিল বস্ত্রবয়নকে অবলম্বন করে।

কালপঞ্চকতন্ত্রং নির্মলং বস্ক্রিং বয়নং করোতি।
অহং তন্ত্রী আত্মনঃ সূত্রম।
আত্মনঃ সূত্রস্য লক্ষণং ন জ্ঞাতম ৷।
সাৰ্দ্ধত্ৰিহস্তং বয়নগতিঃ প্ৰসরতি ত্ৰিধা।
গগনং পূরণং ভবতি অনেন বস্ত্ৰবয়নেন ৷।

কবিকঙ্কন মুকুন্দ রচিত চন্ডীমঙ্গল কাব্যে ধনপতির উপাখ্যানে আমরা পাই এক দারুণ বাণিজ্যের চিত্র। সেখানে আমরা সুতো , পাট ইত্যাদির গুরুত্ব যে কত সে কথা জানতে পারি।

কুরঙ্গ বদলে মাতঙ্গ পাব নারিকেল বদলে সঙ্গ। বিড়ঙ্গ বদলে লবঙ্গ পাব সুঁঠের বদলে টঙ্ক।।
আবার দেখতে পাচ্ছি , ধনপতি বলছেন যে,

চিনির বদলে কর্পূর পাইব আলতার বদলে নাটী।
সকলাত কম্বল পামরি পাব বদল করিয়া পাটি।

এস্থলে সুঁঠ বলতে সুতো বা
সুতির বস্ত্র এবং পাটি বলতে পাট কে বোঝানো হয়েছে এবং সেই সুতি বিক্রি করে তিনি অনেক টাকা পাবেন এই কথা বলছেন । আবার পাট বিক্রি করে তিনি দামি কম্বল পাবেন সেই কথা কবি উল্লেখ করেছেন।

কাব্য গত এই সমস্ত বাণিজ্যিক দ্রব্যের উল্লেখ থেকে যে বাস্তব চিত্রটি ফুটে ওঠে তা হল কারিগরি ,ফল , ধাতুদ্রব্য, রোগের ঔষধ, সোরা ইত্যাদির দিক থেকে বাংলা কিছুটা হলেও অন্য প্রদেশের উপর নির্ভর করলেও, ভালো সুতিবস্ত্র, মসলিন,খাদ্যশস্য ইত্যাদির জন্য বাংলা ছিল পুরোপুরি স্বনির্ভর। ধান, ইক্ষু, ইক্ষু জাত চিনি, গুড় , লবণ , ভেড়া, পায়রা , রবি শস্য,পাট ও পাটজাত দ্রব্য , সর্বোপরি বস্ত্র রপ্তানিতে বঙ্গ ভারতে সেই সময় ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্ছ্বসিত প্রশংসিত ছিল।

যাক গে, #চৌতারা এই শব্দটি বোঝাতে গিয়ে অনেক অন্য কথা বলে ফেললাম। যেহেতু চরকার সূতাকে চৌতার বলে এবং চৌতার একটি সুপ্রাচীন বস্ত্রবয়ন গ্রাম।বয়ন , সূতা , চরকা একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত। সুতরাং, চৌতার > চৌতারা হওয়া জীবন ও জীবিকার সূত্রে প্রাসঙ্গিক।

কিন্তু “র” এর স্থলে ” ড় ” হয় যখন , তখন ” আড়া” শব্দটিও অনিবার্য ভাবে চলে আসে। #আড়া শব্দের অর্থ নদী বা জলাশয়ের পাড় অথবা নদী পুষ্করিণী তীরস্থ বন।
চৌতাড়া যদি হয় গ্রামটির নামের বানান , তবে বলতে হয়, গাঁয়ের এক পাশ দিয়ের কৌশিকী নদী বহমান। অন্যপ্রান্তে উচ্চ পাড় যুক্ত কুড়ি বিঘা আয়তনের সুবিশাল দীঘি। একসময় দীঘির পাড়সংলগ্ন অঞ্চলে শ্বাপদ সংকুল কেয়াবন ছিল। সুতরাং, চতুর্দিকে আড়া , অর্থাৎ চৌতাড়া।

আবার আড়া বা আঢ়া শব্দটি ভূমির পরিমাপবাচক শব্দ রূপেও ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে ১ আড়া= ৪ বিঘা , ১৭ কাঠা ৮ ছটাক জমি। সেই পরিমাপ মত চার আড়া ভূমিভাগ নিয়ে গড়ে ওঠা নাতি বৃহৎ গ্রাম #চৌতাড়া। এছাড়া ধান্যের মাপ হিসাবে আড়া শব্দটির লোকায়ত ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। হুগলী এলাকার হরিপাল ও সংলগ্ন অঞ্চলে ৯৬ সের ওজনে এক আড়া হতো।সুতরাং, চৌতাড়ার উৎপাদিত ধানের মোট পরিমাণের ভিত্তিতে গ্রাম নাম হয় চৌতাড়া এমন ধারণাও করে থাকতেন পন্ডিতগন।

চৌতারা গ্রামের গ্রামদেবী মাতৃস্বরূপা ভবানী । আদিতে তিনি ঘটস্থাপিতা ছিলেন। পরবর্তীকালে দেবীর বিগ্রহ নির্মাণ করা হয় । হরিপাল ঘোষপাড়া নিবাসী কালীচরণ দাস ও নিস্তারিণী দাসীর পুত্র শ্ৰী পিয়ারীমোহন দাসের পত্নী শ্রীমতি হরিমতি দাসী ১৩২৭ বঙ্গাব্দে ভবানী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । পরামানিক বা নাপিত সম্প্রদায়ের এই দাস পদবীধারীরা দেবীর আদি সেবায়েত। কথিত আছে, হরিমতী দাসী কর্তৃক মন্দির প্রতিষ্ঠার পূর্বে একটি চালাঘরে দেবী অনাড়ম্বরভাবে পূজিতা হতেন। মন্দিরসংলগ্ন দুটি ছোট পুষ্করিণী ছিল – যার একটি পরচায় দাস পুকুর নামে, অন্যটি পান্না পুকুর বলে উল্লিখিত।

মন্দিরটির দাগ নং ৮১৮ , খতিয়ান নং ৩৪৬ , তৌজি নং ১৪ । মন্দির চত্বর ৬৫ শতক । মোট দেবোত্তর সম্পত্তির পরিমাণ ১ একর ২ শতক। এর মধ্যে ৫ শতক বাঁশ বাগানও ছিল। এক সময় এসবের খাজনা বরাদ্দ ছিল ৬ টাকা ৬৩ পয়সা। পরবর্তীকালে প্রামাণিক সম্প্রদায়ের পিয়ারীমোহন দাস ১৯২৩ সালের ২৯ শে জানুয়ারি একটি অর্পণনামার মাধ্যমে সকল দেবত্তোর সম্পত্তি ও মন্দির এবং মাতা ভবানী ঠাকুরানীর প্রাত্যহিক সেবা পূজা চালানোর জন্য ২৫০ টাকা দান করে যান। এই অর্থ কোনও ব্যাংকে জমা করে তার সুদে নিত্য পূজা চালাবার পরামর্শ দিয়ে যান। অর্পণনামার মোট ভূসম্পত্তির মূল্য ছিল ৫৯৯ টাকা।

সেই আদ্যিকাল থেকে চৌতারার দ্বারিকানাথ চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও তাঁদের পরিবার বংশানুক্রমে মা ভবানীর পুরোহিত। আরও একটি পরচায় সেবায়েত রূপে বিভূতিভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের ( পিতা কৃষ্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ) নাম পাওয়া যায়। এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাটী ছিল কুলতেগড়ি গ্রামে । দ্বিজ কৃষ্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্বশুর বাড়ি ছিল চৌতাড়া গ্রামে। ভবানী মন্দিরের পাশেই ছিল শ্বশুর মহাশয় যোগীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বসত বাটী। সেই সূত্রে কৃষ্ণচন্দ্র চৌতারা গাঁয়ে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরে তিনি পরামানিক সেবায়িত মা ভবানীর পূজার দায়িত্ব লাভ করেন।

চৌতারা গ্রামে ভবানী মন্দিরের দৈর্ঘ্য ১৪ ফুট এবং ২০ ফুট । সমুখস্থ চাতালের প্রস্থ ৩ ফুট । ভিত্তিভূমি থেকে চাতালের উচ্চতা ১ ফুট ১০ ইঞ্চি। দালান রীতির দক্ষিণ মুখী এই মন্দিরের প্রবেশমুখে তিনটি সোপান বিদ্যমান ।

পূর্বেই বলেছি যে চৌতারা গ্রামের কুলদেবী ভবানী আদিতে ঘট স্থাপিতা ছিলেন। কারণ , ঘটে পটে পূজাই আসল পূজা। মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনীর উপাসনা ভাবের উপাসনা। তিনি এই বিশাল ব্রহ্মান্ড জুড়ে অবস্থান করছেন। তাই তাঁকে ভক্তির ভাবে পূজা উপাসনা করতে হয়। যাক , তো আদি ঘট টি মাটির ছিল। ফলে , ঘটটি ভঙ্গুর দশা প্রাপ্ত হলে একসময় স্থানীয় মালাধর পুকুরে সেটি বিসর্জন দেওয়া হয় । পরিবর্তে একটি পিতলের ঘট স্থাপন করা হয়। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমার দিন মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। সেই উপলক্ষ্যে ওই দিন প্রতি বৎসর একটি বার করে ঘটে নতুন জল ভরা হয়। বর্তমানে ঘটপূজার পাশাপাশি মাতৃমূর্তিও প্রতিষ্ঠা করার । ১৩৮৮ বঙ্গাব্দে চৌতারা নিবাসী শ্রীযুক্ত পরেশচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের সহধর্মিনী শ্রীমতি দেবী চৌধুরানী দত্ত কতৃর্ক এই মাতৃমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় মন্দিরটির আমূল পরিবর্তন ও সংস্কার করা হয়। সে সময় দেবীর পুরোহিত ছিলেন বিভূতিভূষণ চট্টোপাধ্যায় ।

লোহার কাঠামো বা খাঁচা নিৰ্মাণ করে তার উপর সিমেন্ট জমিয়ে ৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মা ভবানীর মূর্তিটি নিৰ্মাণ করেছেন শিল্পী মন্টু চক্রবর্তী। বিগ্রহ নিৰ্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় দুই মাস । সেই সময় তিনি চট্টোপাধ্যায়দের সদর ঘরে বাস করতেন। মূর্তি নিৰ্মাণ করতে খরচ হয়ে ৫০০০ টাকা। অভিষেকের দিন তারকেশ্বর মাঠের মোহান্ত মহারাজ এসেছিলেন । চারজন বিশিষ্ট পন্ডিত অভিষেক যজ্ঞ করেছিলেন। তাঁরা হলেন – কৈকালা নিবাসী বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য , বাহিরখন্ড নিবাসী সনৎ শাস্ত্রী , তেঘরা বা ট্যাগরা নিবাসী শিব প্রসাদ ভট্টাচার্য এবং মন্দিরগৃহের পুরোহিত বিভূতিভূষণ চট্টোপাধ্যায়।

চৌতারা গাঁয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভবানী সিংহরূঢ়া । পিঙ্গলবর্ণ ঘোটক মুখ বিশিষ্ট হুঙ্কাররত সিংহ আপন বীরত্ব প্রকাশ করছে। তাঁর পৃষ্ঠে চতুর্ভুজা দেবী ভবানী অধিষ্ঠান করছেন। তাঁর উপবেসনের ভঙ্গি জগদ্ধাত্রীর ন্যায়। বাম পা ঝুলিয়ে , ডান পা ভাঁজ করে জানুর উপর রাখা। প্রথম দর্শনে কেবল রাঙা বাম চরণটি ভক্তবৃন্দের দৃষ্টি গোচর হয়। অতসীপুষ্প বর্ণা দেবী ভবানী চতুর্ভুজা এবং আয়ুধ সজ্জিতা। দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে তিনি চক্র এবং ত্রিশূল ধারণ করে আছেন এবং বাম হস্ত দ্বয়ে তিনি শঙ্খ এবং কৃপাণ । কৃপাণটি দীর্ঘ ছুরিকা ন্যায় দেখতে। যে হাতে দেবী ত্রিশূল ধারণ করেছেন সেই হাতে একটি চাঁদমালা ঝুলছে। দেবী ত্রিনয়না। পরনে সবুজপাড় লাল শাড়ি। দেবী সুসজ্জিতা এবং এলোকেশী। মুখমণ্ডলে এক অসম্ভব এবং অলৌকিক শান্তভাব বিরাজ করছে। করতল এবং পদতল রক্তিম।

দুইধাপে বাঁধানো বেদীর উপর দেবীর অধিষ্ঠান। বেদীর দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি, প্রস্থ ২ ফুট ৬ ইঞ্চি ও উচ্চতা ১ ফুট ৬ ইঞ্চি। গর্ভগৃহের বহির ভাগে চারধারে চাতাল। তার উপরিভাগে এসবেটাসের ছাউনি। গর্ভগৃহের ছাদটি গম্বুজাকৃতি । ঢালাই ছাদ । গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে একটি ছোট শিব লিঙ্গ এবং পিতলের সিংহাসনে চেলির কাপড়ে ঢাকা নারায়ণ শিলা রাখা আছে। আছে পিতলের দেবীঘট । গর্ভগৃহে দুইটি জানালা এবং প্রবেশমুখে একটি গ্রীলের দরজা। দেবালয়ের পশ্চিম দিকে একটি অশোক গাসিব এবং দক্ষিণে একটি বাদাম গাছ আছে।

মোরাম পথ চলে গেছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। সেই পথের উত্তর ধারে গাছের ছায়ায় দেবী ভবানীর ছিমছাম নিরঙ্কৃত পবিত্র দেউল। পথচলতি মানুষ এখনও প্রখর বৈশাখের দুপুরে মাঠ পেরিয়ে এসে খানিক জিরিয়ে নেন এই ছায়াসুশীতল দেবালয়ের খোলা চাতালে । নতুন আসা মানুষেরা চমৎকৃত হন মায়ের মূর্তি দর্শন করে।

সিদ্ধচাল ও মিষ্টান্ন সহযোগে দেবীর নিত্যপূজা হয় পঞ্চোপচারে। সন্ধ্যায় জলবাতাসা উপাচারে হয় শীতল পূজা। শারদীয়া দুর্গা পূজার নবমীর দিন হয় বিশেষ পূজা। তবে বার্ষিক উৎসবের দিন হল – বৈশাখী পূর্ণিমা । ওইদিন দেবীর প্রতিষ্ঠা দিবস। চৌতারা , মোহন বাটী , বড়ম্বা , ও খামার চণ্ডী থেকে ভক্তরা আসেন পূজা দিতে। সকাল থেকে ষোড়শোপচারে পূজা হয়। খিচুড়ি ভোগ, পরমান্ন ভোগ নিবেদন করা হয়। পূর্বে এই দিন আখ ও কুমড়ো বলি হতো , তবে এখন বোধহয় হয় না।

গাঁয়ের তন্তুবায় সম্প্রদায়ের মানুষরা দেবীকে কুলদেবী হিসাবে মানেন । দীঘির ধারের বাউরী , জলাপাড়ার বাগদীরা দেবীকে জগদ্ধাত্রী জ্ঞানের পূজা করেন। এছাড়া বিপদে, আপদে , অসুখের বিসুখে, খরা বন্যায় সকল গ্রামবাসী এবং আশেপাশে গ্রামের মানুষজন দেবীর শরণাপন্ন হন। সারাবছর দেবীর থানে মানুষজনের আনাগোনা চলতে থাকে।

হাওড়া তারকেশ্বর রেলপথে হরিপালা স্টেশন। সেখান থেকে হেঁটে চৌধুরীপাড়ার ভিতর দিয়ে সাঁওতালখাল শ্মশান পেরিয়ে কৈকালাগামী মোরাম পথ ধরে অনেকটা হেঁটে চৌতারা – দীঘির পশ্চিমে ভবানী মন্দির।

ভক্তদের ব্যাকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে করুণাময়ী মহামায়া ভবানী সকল কৌলীন্য ত্যাগ করে মর্তলোকের মেঠো পথ ধরে এই অখ্যাত পল্লীতে প্রবেশ করেছেন। বঙ্গ তথা ভারতের গ্রাম্য চিরাচরিত লোকায়ত স্বরূপে রাজরাজেশ্বরী অধিষ্ঠান করছেন এক ছায়া সুনিবিড় বৃক্ষতলে গ্রামদেবী রূপে।

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১ . লোকায়ত রাঢ় বঙ্গ
২. বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন ভারত ও সমকালীন অন্যান্য দেশ
৩. ঋগ্বেদ সংহিতা
৪. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
৫. বঙ্গাব্দ
৬. হুগলী জেলার লৌকিক দেবদেবী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.