‘আবার চালে ভুল করলি, ‘মন্ত্রী দিয়ে কিস্তি দিলি, কিন্তু ওই দূরে আমার গজটা কি শুধু শুধু বসে আছে? তোর মন্ত্রী তো শিকার করতে এসে নিজেই শিকার হয়ে যাবে রে!’
‘তাই তো, বড় ভুল হয়ে গেছে!’
‘এই রকম বোকাবোকা চাল এই নিয়ে তিনবার  হল। খেলায় মন নেই না কি?’
‘ঠিকই, আজ কিছুতেই মন বসাতে পারছি না।’
‘স্বামী-স্ত্রীতে আবার ঝগড়া হয়েছে?’
‘হয়েছিল গতকাল রাত্রে, তারপর থেকে কথাবার্তা বন্ধ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছেলেকে নিয়ে মিসেস বাপের বাড়ি গেছে।’
‘বৌ রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে, আর তুই নিশ্চিন্তে বসে আমার সাথে দাবা খেলছিস!’
‘সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার দায় কি খালি আমার? ভ্যাং ধরে চলে গেলেই হল? আমি আর পারছি না বাপু।’
‘কেউ বিয়ে করে পস্তায় আর কেউ না করে।’
‘যেমন আমি আর তুই।’
‘আমি বলি কী, এই সুযোগে শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘুরে আয়।’
‘এবার আর আমি ওনার ভ্যাং ভাঙাতে যাচ্ছি না। ওনার যখন ইচ্ছে হবে তখন ফিরবেন, না ফিরলেও আপত্তি নেই। আমার প্রেসটিজ নেই নাকি? মাঝে মাঝেই বলে আমার মত কেয়ারলেস মানুষের সঙ্গে নাকি থাকা যায় না। তা, থাকাই যখন যায় না, তখন বিদেয় হও না কেন বাপু? রাগের মাথায় এই কথাটা বলে ফেলেছিলাম। তার জন্যে এত!’
‘অ, এ-তো চোরের মায়ের বড় গলা।’
‘মানে?’
‘তুই নিজেই বৌকে তাড়িয়েছিস, সেই কথাটা স্পষ্ট করে বল না!’
‘আমি কি মন থেকে বলেছি? মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে কথাটা।’
‘অবচেতন মনে কথাটা তৈরি হয়েই ছিল, বেরোবার জন্যে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছিল শুধু।’
‘হয়তো তাই। কিন্তু এমন একটা কথা অযথা মনের মধ্যে তৈরি হবেই বা কেন? আমি একাই তো এর জন্যে দায়ী নই। আসলে আমাদের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কটা এখন একটা সরু সুতোর মত হয়ে গেছে। যে কোনও মুহূর্তে ছিঁড়ে যেতে পারে।’
হিমাংশু দাবার ঘুঁটিগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে খেলাটাকে ভণ্ডুল করে বলল, ‘তোকেও সেপারেশনের বাই পেয়েছে দেখছি!’ 
‘সেপারেশন হলে হবে। কিছু যায় আসে না।’ নির্লিপ্তির রূপ ধরে গলন্ত লাভার মত উষ্মা বেরিয়ে এল আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে। 
‘ভুল, মস্ত ভুল। তোর কিছু যায় আসে না বটে, কিন্তু অন্য কারও যায় আসে কিনা ভেবে দেখেছিস?’
‘জ্ঞান দেওয়া খুব সোজা। তাও বুঝতাম, নিজে যদি ভুক্তভোগী হতি। ভয়ের চোটে তুই তো বিয়েই করলি না।’ 
কথাটা ঝাঁঝের সঙ্গেই বললাম, কিন্তু কথার খোঁচাটাকে পাত্তাই দিল না হিমাংশু। সিগারেট ধরিয়ে বড় একটা টানে খানিকটা ধোঁয়া টেনে নিল সে। তারপর পায়ের উপর পা তুলে সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে লাগল। সবকটা রিং মুখ থেকে বেরিয়ে গেলে বলল সে, ‘লিপি মিত্রকে মনে আছে?’
‘লিপি মিত্র? মানে লিপিকা মিত্র? মনে থাকবে না আবার? আমাদের আফিসের সেকশন-অফিসার ছিল। কী জাঁদরেল মহিলা, উফ! গত বছর রিটায়ার করার পর আমরা সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।’
‘ধুত্‌। আমি তোদের লিপিকার কথা বলছি না। আমি বলছি অভিনেত্রী লিপি মিত্রের কথা।’
‘লিপি মিত্র? থিয়েটার কিংবা টিভি সিরিয়াল হলে আমি তাকে চিনতে পারব না বাপু। আর সিনেমা যদি হয় তো— ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে মাঝেসাঝে দেখি বটে, কিন্তু লিপি মিত্র বলে কোন হিরোইনের নাম এই প্রথম শুনলাম।’
‘লিপি মিত্র কিছু টিভি-সিরিয়ালে অভিনয় করেছিল। পরের দিকে খান কতক সিনেমাতে নায়িকা হিসেবে খুব নাম করেছিল। তবে নাম করেছিল লিপি মিত্র হিসেবে নয়, লি হিসেবে। নিজের নাম বদলে নিয়েছিল। “লি” নামে পরিচিত হয়েছিল সে, শুধু লি।’
‘তাই বল। লি। লিকার যেন ডিগবাজি খায়! বাংলা বর্ণমালার অতিরিক্ত বা বাতিল বর্ণ “লি”-কে নিজের নামের বানান বানিয়েছিল সে।’
‘চিত্রপরিচালক “Q” কিংবা অভিনেত্রী “ঋ” থেকেই অনুপ্রানিত হয়েছিল বোধহয়।’
‘লি-এর সিনেমাগুলো আমি দেখেছি। হলে মুক্তি পেত না। সেন্সরবোর্ড এডাল্ট-মার্ক লাগিয়েও ছাড়পত্র দিত না।’
‘ঠিক। নেটে রিলিজ করা হত। সিনেমাগুলোতে অতিরিক্ত মাত্রাতেই লিপিকে ব্যবহার করা হত। লিপি এতটাই আধুনিকা ছিল যে, নগ্নতায় তার আপত্তি ছিল না। বরং বিতর্ক আর নেগেটিভ প্রচারকেই নিজের সাফল্যের হাতিয়ার করেছিল। ওর শেষ সিনেমাটা দেখেছিস?’
‘ট্যাটু?’
‘না, ট্যাটু নয়, একটা শর্ট ফিল্ম, নাম “খোকন”। ঐ সিনেমাটা বিদেশের কোন একটা ফিল্ম ফেস্টিভালে পুরস্কার পেয়েছিল। সেই খুশিতে পরিচালকের বাড়িতে একটা পার্টি চলছিল। সেই পার্টিতে—’
হিমাংশুকে বাধা দিয়ে বললাম আমি, ‘জানি জানি, সেই পার্টিতে একটা দুর্ঘটনায় লি মারা গিয়েছিল।’ 
‘হুঁ, নিউজ পেপারে ঐ রকমই প্রচার হয়েছিল বটে।’
‘মানে? লি মারা যায়নি?’
‘আমি কি তাই বললাম? লি অবশ্যই সেই পার্টিতে মারা গিয়েছিল। তবে সেটা দুর্ঘটনা, না খুন, সেটা নিয়ে কনফিউশন হচ্ছিল। ঘটনাটার তদন্তভার পেয়েছিলাম আমি। পুলিস ওটাকে দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখিয়েছিল। কিন্তু লিপির মা লিপির মৃত্যুকে খুন বলে দাবি করেছিল। শেষে কেস সি.আই.ডির হাতে আসে। ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখে আমারও মনে হয়েছিল সেটা দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত খুন।’
‘লি খুন হয়েছিল, না দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল, তার সঙ্গে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কী সম্পর্ক?’ কিছুটা বিরক্তিভাব মিশিয়েই কথাটা বললাম আমি। 
হিমাংশু অ্যাসট্রেতে সিগারেটের শেষ অংশটা ফেলে দিয়ে বলল, ‘সম্পর্ক আছে। ঘটনাটা পুরো শুনলে তুই নিজেই বুঝতে পারবি। কিন্তু তার আগে বল, ভোদকা নিবি না স্কচ? গলাটা না ভেজালে ঠিক মুড আসছে না।’
‘মদ? এই ভরসন্ধ্যায়?’
‘ঠিক আছে তোর জন্যে না হয় ম্যাংগো-জুস আনছি। তবে চিকেন তন্দুরির সংগে কি জুস পোষাবে? মুর্শেদচাচা আজ তন্দুরি চিকেন করেছিল। সেটাকে গরম করতে বলি। আমি তো তন্দুরির সঙ্গে স্কচ সাঁটাবো।’
‘আমার জন্যেও স্কচ আন তাহলে। এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন?’
হিমাংশু হেঁড়ে গলায় বাবুর্চি কাম পরিচারক মুর্শিদ খান এলাহাবাদীকে ডেকে তন্দুরি চিকেন গরম করে আনতে বলল। আর বলল দুটো গ্লাস দিয়ে যেতে। আর নিজে আলমারিতে যত্ন করে রাখা বোতলগুলোর মধ্যে থেকে বেছে একটাকে নামিয়ে আনল।
মাইক্রোওয়েভ ওভেনে চটজলদি খাবার গরম হয়ে যায় বলে আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মুর্শেদচাচা দুটো প্লেটে তন্দুরি চিকেন সাজিয়ে নিয়ে এল। গ্লাসে এক পেগ স্কচ ঢেলে তার সঙ্গে সোডা মিশিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে হিমাংশু বলল, ‘সেদিন ওরাও স্কচ খেয়েছিল।’
‘কারা?’
‘পরিচালক অনিরুদ্ধ কর, সহ-পরিচালক শান্ত দাম, নায়িকা লি, নায়ক খোয়াহিশ—’
‘খোয়াহিশ? ফ্রম মুম্বাই?’
‘নো স্যার। আসল নাম দামোদর পোদ্দার। সিনেমা লাইনে ওসব সেকেলে নাম চলে না। ট্রেন্ডি নাম নিতে হয়। তাই দামোদর থেকে খোয়াহিশ হয়েছে।’
‘এই কয়জনই পার্টিতে উপস্থিত ছিল?’
‘আরো কয়েক জন ছিল।’ মদে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল হিমাংশু, ‘ক্যামেরাম্যন জি কে গোপাল। নাম শুনে দক্ষিন ভারত থেকে আমদানি বলে মনে হয়, আদপে কিন্তু খাস বাঙাল। পিতৃদত্ত নাম গোপালকৃষ্ণ ঘোষ। নামটাকে উল্টে নিয়ে হয়েছে ঘোষ কৃষ্ণ গোপাল। তারই এব্রেভিয়েশন জি কে গোপাল। বাঙালীর কদর নেই, নামের মধ্যে দক্ষিনী কেতা না আনলে বড় বড় সিনেমা ফার্মে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই নাম নিয়ে এই রকম কায়দা করতে হয়। এছাড়াও সেদিনের পার্টিতে ছিল স্ক্রিপ্ট রাইটার রঞ্জন রায়। ছিল বাংলা ব্যান্ড অক্টোপাসের প্রধান গাইয়ে কাম গীটারিস্ট রক ইসলাম। আটজনের টিম বলেই বোধহয় ওই রকম বিদঘুটে নাম। আর পরিচালক অনিরুদ্ধ করের পরিবার তো ছিলই। অনিরুদ্ধর পরিবার বলতে, স্ত্রী তিস্তা আর ছেলে সমু, ভাল নাম সম্বুদ্ধ। অনিরুদ্ধ থাকে বালিগঞ্জের নিজস্ব বাড়িতে। তিনতলা বাড়ি। অনুরুদ্ধ পৈতৃকসূত্রে প্রভুত সম্পত্তির মালিক হয়েছিল। প্যাশন ছিল চিত্রপরিচালক হওয়া। পয়সার তো কমতি নেই, তাই নিজেই একটা সিনেমা প্রডাকশন হাউস খুলেছিল। ট্রায়াল হিসেবে প্রথমে শর্টফিল্ম দিয়েই শুরু করল সে। পরিচিতিটা দরকার। কলেজ লাইফের বন্ধু রঞ্জন মাইতি উঠতি সাহিত্যিক। তাকে দিয়েই স্ক্রিপ্ট লিখিয়ে নেওয়া হয়েছিল। গভীর রাত পর্যন্ত পার্টি চলেছিল। প্রথম ছবিতেই পুরস্কার, এটা অনিরুদ্ধের পক্ষে কম ব্যাপার নয়। তাই পার্টিতে আয়োজনে ত্রুটি ছিল না। ছিল ঢালাও খানা, ছিল ঢালাও পানীয়। সঙ্গে রক ইসলামের গান। কিন্তু পার্টির অন্তিম লগ্নেই ঘটে গেল ছন্দপতন। আড্ডা চলছিল একতলার বিশাল হল-ঘরে। দোতলার টয়লেটে গিয়েছিল লি। টয়লেট থেকে বেরিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামছিল সে। হঠাৎ পা পিছলে সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ল সে। মাথা তুলে শুধুমাত্র একটাই শব্দ বলল। তারপরই এলিয়ে পড়ল। লি-কে তুলে হসপিটালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে।’
‘কী বলেছিল মরার আগে?’
‘আর।’
‘শুধুই আর?’
‘হ্যাঁ। শুধু “আর”। এর বেশি কিছু বলা হয়ে ওঠেনি।’
‘আর ফর রঞ্জন?’
আমাকে অপ্রস্তুত করে ‘হা হা হা’ শব্দে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল হিমাংশু। হাসির দমক থামার পর বলল সে, ‘এ ফর এপেল, বি ফর ব্যাম্বু, আর ফর র‍্যাট অথবা রঞ্জন। হাসালি বটে, মরার সময় কেউ কি কারো নাম বানান করে বলে?’
তাইতো! নিজের বোকামিতে লজ্জা হল আমার। 
‘আর ফর আরুষ হতে পারত।’ বলল হিমাংশু, ‘আমার এমন সন্দেহই হয়েছিল। হয়তো লি আরুষ বলতে চেয়েছিল।’
‘কিন্তু পার্টিতে আরুষ নামে তো কেউ উপস্থিত ছিল না!’
‘আরুষ হচ্ছে লি-এর প্রাক্তন প্রেমিক। অরিজিনাল নাম ক্ষিতীশ পোদ্দার। হিরো হবার বাসনায় মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিল। একখানা বি-গ্রেডের সিনেমাও করেছিল। তখন নাম নিয়েছিল আরুষ। সিনেমা ফ্লপ, মুম্বাইয়ের কেরিয়ারও শেষ। সেই সাথে শেষ লি-এর সঙ্গে সম্পর্কটাও। এখানে বেশ কিছু পরস্পর বিরোধী সম্ভাবনা উঁকি দেয়। এক নম্বর, আরুষ হয়তো আমন্ত্রণ ছাড়াই কোন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গোপনে সেই পার্টিতে এসেছিল। দুই নম্বর, মৃত্যুকালে লিয়ের হয়তো প্রাক্তন প্রেমিকের নাম মনে পড়েছিল, তিন নম্বর, হয়তো লিয়ের “আর”, আরুষ নয়, অন্য কেউ, অথবা অন্য কিছু। আরুষের পক্ষে সেই পার্টিতে আসা সম্ভব ছিল না, তার কারণ, ঘটনার দুদিন আগে একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে আরুষ গুরুতর আহত হয়ে একটা নাসিং হোমে ভর্তি হয়। দুই দিনের মধ্যে লি যাকে দেখতে নাসিংহোমে যাবার সময় পায়নি, মরার সময় তার কথা মনে করবে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। সুতরাং প্রথম আর দ্বিতীয় সম্ভাবনা খারিজ। আগেই বলেছিলাম, কেসটার তদন্ত শুরু করেছিল পুলিস। তার দিন তিনেক পর থেকে আমরা কেসটা হাতে নিই। পুলিস লিয়ের ডেডবডির ময়না তদন্ত করেছিল। অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। তাই পুলিস সাধারণ দুর্ঘটনা হিসেবেই কেসটাকে বর্ণনা করেছিল। কিন্তু আমার খটকা লাগছিল। লি সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে। কেউ কি ধাক্কা মেরেছিল? পার্টিতে সবাই নেশায় টলমল অবস্থায় ছিল। লি ভালই মদ খেয়েছিল। তার উপর মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। পা হড়কে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তার উপর ঘটনাটার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিল। মানে, পা হড়কে পড়ে যেতে অনেকেই দেখেছিল। কিন্তু আমার খটকা অন্য জায়গায়। পা হড়কে গেল কেন? লি কি অন্যমনস্ক ছিল? তা যদি হয়, অন্যমনস্কতার কারণ কী? তাকে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গিয়েছিল। এই ব্যস্ততারই বা কারণ কী? তার মোবাইল ফোনে কি এমন কোন কল কিংবা মেসেজ এসেছিল যা তাকে উত্তেজিত করে তোলে? না, ঘটনার দুই ঘন্টার মধ্যে এমন কোন কল কিংবা মেসেজ তার মোবাইল ফোনে আসেনি। পার্টিতে যারা উপস্থিত ছিল তাদের জেরা করেও তার ব্যস্ততার কিংবা অন্যমনস্কতার কারণ জানা যায়নি। তবে লিয়ের মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয়, পরিকল্পনা করে দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছিল সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম লিয়ের হাই-হিল-স্যান্ডেল পরীক্ষা করে। স্যান্ডেলের সোলে সাবান লাগানো ছিল। কিন্তু লাগাল কে?’
‘কে?’ প্রশ্ন না করে পারলাম না। 
‘ধীরে বন্ধু ধীরে। গোয়েন্দা গল্পে এই প্রশ্নটাই তুরুপের তাস। অপরাধীর ভান্ডাফোড় করা হয় শেষ বেলায়। সেদিন পার্টিতে যারা উপস্থিত ছিল সবাইকে জেরা করলাম। ঘটনার সময় কে কোথায় ছিল সেটা জানা প্রয়োজন ছিল। তিন জন বাদে বাকি সবাই ফার্স্ট ফ্লোরের হল ঘরে ছিল। একজন হল স্ক্রিপ্ট রাইটার রঞ্জন। আরেক জন ক্যামেরাম্যান জি.কে. গোপাল। অন্যজন অনিরুদ্ধর স্ত্রী তিস্তা। সিনেমা পরিচালনায় অনিরুদ্ধর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না।  চিত্রপরিচালনার কোন ট্রেনিংও তার নেই। শুটিং-এর সময় পদে পদে অসুবিধায় পড়ছিল সে। গোপাল পরিচালনার কাজে সহায়তা করেছিল। বলা ভাল, ফিল্মটার আসল পরিচালক গোপালই। কিন্তু পুরস্কার পাবার পর যে সাংবাদিক সম্মেলন হয়েছিল, সেখানে বক্তব্য রাখার সময় অনিরুদ্ধ গোপালের ভূমিকা বেমালুম চেপে যায়, গোপালকে তার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে। তাই অনিরুদ্ধর উপর গোপালের একটা চাপা ক্ষোভ ছিলই। মদের প্রভাবে সেই ক্ষোভ প্রকাশ্যে এসেছিল সেদিনের সেই পার্টিতে। এই নিয়ে অনিরুদ্ধর সঙ্গে তার তর্কাতর্কি হয়। রঞ্জন ঠান্ডা মাথার লোক। সে যদি মোক্ষম সময়ে গোপালকে সেখান থেকে সরিয়ে ব্যালকনিতে নিয়ে না যেত, তাহলে হয়তো অনিরুদ্ধর সঙ্গে তার হাতাহাতি হত। এই কারণেই কি লি দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেছিল? তাহলে মৃত্যুর সময় “আর” বলে সে কী বোঝাতে চেয়েছিল? পার্টিতে অনিরুদ্ধর স্ত্রী তিস্তার উপস্থিতি নাম মাত্রই। পার্টিতে কিছুক্ষণ কাটিয়েই সে উপরের তলায় চলে যায়। তার নাকি মাথা ব্যাথা করছিল, উপরের তলার বেডরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে, এমনটাই তার দাবি। তিস্তা ছিল ও.সি.ডি-র রুগী। ও.সি.ডি. হচ্ছে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার। এই রোগীরা হয় শুচিবায়ুগ্রস্ত। এদের মনে নানা অবাস্তব চিন্তাভাবনা কাজ করে। এরা কল্পনাবিলাসী। সন্দেহপরায়ণও বটে। তিস্তার সঙ্গে তার স্বামীর মাঝে মাঝেই ঝগড়া হত। মনমালিন্য হত। এর কারণ ছিল লি। তিস্তা লি-কে “নোংরা মেয়েছেলে” বলত। অনিরুদ্ধর সঙ্গে লি-এর শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে তার ছিল তীব্র সন্দেহ। কর্তা-গিন্নির ঝগড়া বেশ উচ্চগ্রামেই হত, বাড়ির ঠিকে ঝি, দারোয়ান, পরিচারক, এমন কী প্রতিবেশীদের কাছেও এই ঝগড়ার খবর অজানা ছিল না। সন্দেহটা সঠিক কিনা, সেই তদন্ত অবান্তর। মোদ্দা কথা লি-এর দুর্ঘটনা ঘটানোতে তিস্তার স্বার্থ ছিল। তাই তিস্তার উপর আমার সন্দেহ হল। সে যে সত্যি সত্যিই ঘুমাচ্ছিল সেই প্রমাণ নেই। আবার সে যে মিথ্যে কথা বলছে, তাও প্রমান সাপেক্ষ। কেসটা নিয়ে যখন আমি একান্তই নাজেহাল, তখন এফ.এম. রেডিও আমাকে রাস্তা দেখাল। পানের দোকানে গিয়েছিলাম সিগারেট কিনতে। সেখানে রেডিওতে বাজছিল উপল সেনগুপ্তর গাওয়া একটা গান।’ 
‘উপল? মানে চন্দ্রবিন্দু?’ 
‘হুম, বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দু। উপল মানে চন্দ্রবিন্দু, এতটা যখন তোর জানা, তাহলে গানটাও তুই শুনেছিস নিশ্চয়ই— আজকালকার মেয়েগুলো সব ক্যাট, মুখে লেগেই আছে ইংরিজি ফ্যাট্‌ ফ্যাট্‌, সাজেগোজে শ্রীদেবী, মনেতে সব ফুলনদেবী, আর ঐ…’ 
‘আরশোলাটা দেখলে পরেই ফ্ল্যাট!’ হিমাংশুর মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে আমি সোৎসাহে গানটাকে সম্পূর্ণ করে দিলাম।  
‘আরশোলাটা দেখলে পরেই ফ্ল্যাট— এই কথাটা আমাকে হন্ট করতে লাগল। মনে হল, লি-এর “আর”, আরশুলা নয়তো? বাথরুমে আরশুলা দেখেই হয়তো ভয় পেয়েছিল সে। কিন্তু বড়লোকের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাথরুমে আরশুলা থাকতে পারে কি? বাথরুম চেক করে সেই সম্ভাবনা মানতে মন চায় না। বাথরুমের পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠলে একটা ধাপে বাথরুমের দরজাটাকে ঠিক নীচে পাওয়া যায়। অর্থাৎ সিঁড়ির উপর থেকে আরশোলা লি-এর গায়ে ফেলা যায়। প্রথমত জুতোতে সাবান মাখয়ে রাখা, দ্বিতীয়ত গায়ে আরশুলা ফেলে ভয় দেখিয়ে দৌড় করানো— দুর্ঘটনাটাকে যে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত ভাবে ঘটানো হয়েছিল, সেই সম্ভাবনাকেই সমর্থন করে। কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছিল তার একটা আন্দাজ পাওয়া গেল। কিন্তু এর পেছনে কারসাজি কার? পার্টিতে উপস্থিত সবার বয়ান আবার নতুন করে পরীক্ষা করলাম। তখন খেয়াল হল, এমন একজনকে আমরা জেরা করিনি যে পার্টিতে উপস্থিত ছিল, অথচ আমারা তাকে হিসাবের মধ্যেই ধরিনি।’
‘কে সে?’
‘সে হল অনিরুদ্ধর নয় বছরের ছেলে সম্বুদ্ধ। ডাক নাম সমু। আমি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব জমালাম। তার খেলনাপাতি দেখলাম। যা আশা করেছিলাম তাই। সমুর খেলনাপাতির মধ্যে একটা প্লাস্টিকের আরশোলা পেলাম। আরশোলাটার প্রশংসা করতেই সমু খুব খুশি হয়ে গর্বের সঙ্গে বলল, “জানো এই আরশুলাটার পায়ে সুতো বেঁধে লি-আন্টির গায়ে ফেলতেই লিআন্টি ভয়ে কী দৌড়টাই না দৌড়েছিল! লি-আন্টি এটাকে সত্যিকারের আরশোলা ভেবেছিল।” সমু খিলখিল করে হাসতে লাগল। আমিও সেই হাসিতে যোগ দিলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “সেই জন্যেই কি তোমার লি-আন্টি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল?” সমু উত্তর দিল, “লি-আন্টি যখন বাথরুমে ঢুকল তখন তার জুতোতে সাবান মাখিয়ে দিয়েছিলাম না? তারপর আবার সিঁড়িতেও জল ঢেলে দিয়েছিলাম। সেই জন্যেই তো লিআন্টির পা হড়কে গেল!” আমি বললাম, “বাহ্‌, তোমার বুদ্ধি তো দারুণ! কিন্তু লিআন্টিকে ফেললে কেন?” সমুর মুখটা ম্লান হয়ে গেল। বলল, “লি-আন্টির জন্যেই বাবা-মার মধ্যে ঝগড়া হত যে!” তাহলে বুঝতেই পারছিস, বাবা-মার মধ্যে অশান্তি সন্তানের উপর কী রকম কু-প্রভাব ফেলে!’
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ নীরবতার পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাচ্চাটার কী হল? তাকে গ্রেফতার করলি?’
‘পারলাম না। বাচ্চাটাকে গ্রেফতার করলে বড় হয়ে হয়তো সে আরো বড় অপরাধী হয়ে যেত। বাচ্চাটার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে আমি কঠোর হতে পারিনি। সেটা তার পড়াশুনা করার বয়স, খেলাধুলা করার বয়স। তার অপরাধ গুরুতর ছিল, কিন্তু তাকে শাস্তি দিলে অবিচার করা হত। তাই, জীবনে প্রথমবার কর্তব্য থেকে বিরত থাকলাম। অনিরুদ্ধ-তিস্তাকে ঘটনাটা জানিয়ে বাচ্চার উপর মনোযোগী হবার পরামর্শ দিলাম। জানি না তাতে কতটুকু কাজ হয়েছিল। লি-এর মায়ের অভিযোগ নস্যাৎ করে আমি লি-এর মৃত্যুকে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে অফিসে রিপোর্ট জমা দিলাম।’
‘শুধুমাত্র বাবা-মার মধ্যে ঝগড়ার কারণে একটা বাচ্চা একটা মানুষ খুন করল। বাচ্চাটাকে ক্রিমিনাল মাইন্ডেড বলতে হয়। নয় বছরের কোনও বাচ্চা এতটা নৃশংস কী করে হয়?’ 
আমার মন্তব্য শুনে হিমাংশু আমার দিকে স্থির-দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘ছেলেবেলায় ফড়িং ধরে ঝাঁটার কাঠিতে গেঁথে পিঁপড়েদের ভোজ খাইয়েছিস কখনো? ঢিল ছুঁড়ে পাখি মেরেছিস? খাতার পাতায় প্রজাপতি আঠা দিয়ে সেঁটেছিস? এসব নৃশংসতা নয়? খেলাচ্ছলে এসব করে না এমন বাচ্চা কমই পাওয়া যাবে।’
‘কিন্তু এটা তো ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত খুন! বাবা-মার ঝগড়া থামানোর জন্য মানুষ খুন করার কথা চিন্তা করাই তো সাংঘাতিক ব্যাপার!’
‘বাবা-মার ঝগড়া উপলক্ষ্য মাত্র। আসল কারণ সমু নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত।’
‘ডাইভোর্সের সম্ভাবনায়?’
‘আনিরুদ্ধর সিনেমাটা সমু দেখেছিল। সেই সিনেমায় দেখান হয়েছিল, বাবা-মার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হচ্ছে, আর তাদের ছেলেকে পাঠানো হচ্ছে হস্টেলে। ছেলেটা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করছে। সিনেমাটার স্ক্রিপ্ট নচিকেতার একটা গানের উপর নির্ভর করে লেখা।’ 
হিমাংশু তার বেসুরো গলাতেই গুন গুন করে গাইতে লাগল, ‘পৃথিবীটা বড় রঙিন ভাবত সে কথা খোকন..’
আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। এখনও সময় আছে। নিজের পরিবার আগলে রাখার দায়িত্ব আমারই। আমার আর আমার গৃহিনী দুজনেরই আরেকটু সংযত হওয়া দরকার, দরকার আমাদের সন্তানের মুখ চেয়েই। শিশুর চারিত্রিক বিকাশে পরিবারের অবদানই বেশি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, কাল সকালেই শ্বশুরবাড়ি যাব, অহং ত্যাগ আমাকে করতেই হবে। বৌয়ের মানভঞ্জন করে আমি আমার সংসার বাঁচাব। বাঁচাব আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। আমার বিশ্বাস শিশুর জন্যে তার বাবা আর মা দুজনেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের মঙ্গলের জন্যে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাকে ভালো রাখতেই হবে।

প্রবীর মজুমদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.