আজ ১৪২৭ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০২০ খ্ৰীষ্টাব্দ চলছে, অর্থাৎ গণিতের সরল হিসাবে বঙ্গাব্দের সূচনা (২০২০ – ১৪২৭) = ৫৯৩ খ্ৰীষ্টাব্দে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ৫৯৩ খ্ৰীষ্টাব্দে কী এমন যুগান্তকারী ঘটনা এই বাঙ্গালার বুকে ঘটেছিলো, যাতে নতুন বর্ষপঞ্জী চালু করতে হয়? এবং তার থেকেও বড় প্রশ্ন কে এই বঙ্গাব্দের প্রচলন করেছিলেন?
বঙ্গাব্দের প্রচলনকারী নিয়ে অনেকগুলো মতের মধ্যে প্রধান চারটি মত হলো:-
(১) মোগল সম্রাট আকবর,
(২) সুলতান হুসেন শাহ,
(৩) তিব্বতীয় শাসক স্রং-সন-গাম্পো,
(৪) গৌড় বঙ্গের প্রথম সার্বভৌম রাজা শশাঙ্ক
এক-এক করে প্রত্যেকটি মতবাদের পিছনের যুক্তিতে আসা যাক।
(১) “সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দের প্রবর্তক” — এই মতটি অনেক শক্তিশালী। পাকিস্তান আমল থেকে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে এই প্রচারণাটি চালানো হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, মোগল সম্রাট আকবর এক ইরানী পন্ডিতের সাহায্যে বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দ, হিজরী ৯৬৩ সালকে বঙ্গাব্দের প্রথম বছর ধরে আমীর ফতই উল্লাহ সিরাজির প্রচেষ্টায় বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেন।
আসুন, এবার একটু যুক্তি-তর্কের আলোয় ঢোকা যাক।
ক) বঙ্গাব্দ অনুযায়ী নববর্ষ পালিত হয় পয়লা বৈশাখ। এই পয়লা বৈশাখ বাঙ্গালা বর্ষপঞ্জী অনুসারে কখনও ইংরেজীর ১৪ই এপ্রিল পড়ে, আবার কখনও পড়ে ইংরেজীর ১৫ই এপ্রিল। এই একই সময়ে ভারতের আরও বিভিন্ন রাজ্যে নববর্ষের উৎসব পালিত হয়; কেরালাতে যার নাম বিশু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, পাঞ্জাবে বৈশাখী, কামরূপে (বর্তমান নাম – আসাম) ভাস্করাব্দ শুরুর উৎসবে পালিত হয় রঙ্গালী বিহু, ত্রিপুরার উপজাতিদের মধ্যে বৈসাগু ইত্যাদি। তো এখন প্রশ্ন হল, ভারতের এতরকম জাতির নববর্ষ একই সময়ে প্রায় একই দিনে পড়ছে কী’ভাবে, যদি আকবর কেবলমাত্র বঙ্গাব্দটুকুই চালু করে থাকেন? এবং আরও প্রশ্ন হল, আকবরের রাজধানী দিল্লির কাছেই পাঞ্জাব। অথচ “পাঞ্জাবের বৈশাখীর প্রচলন করেন আকবর”- এমন কোন মত প্রচলিত নেই, যেখানে দিল্লি থেকে পাঞ্জাব অনেক কাছে!
তাহলে মোগল বাদশা আকবর ঘরের পাশে পাঞ্জাবে বৈশাখী চালু না করে উত্তর ভারত, মধ্য ভারত পেরিয়ে সোজা বাঙ্গালায় এসে বঙ্গাব্দ চালু করতে গেলেন কেন? দিল্লির আশেপাশের অঞ্চল দিয়ে শুরু করলেন না কেন? আরও মজার ব্যাপার হল, দিল্লি এবং তৎসংলগ্ন উত্তর ভারত এবং মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় বর্ষপঞ্জী হিসেবে বিক্রম সম্বত বা বিক্রমাব্দের ব্যবহার রয়েছে। তা যিনি গোটা ভারতের বাদশা, তিনি সারা ভারতে এক বর্ষপঞ্জী চালু না করে শুধুমাত্র বাঙ্গালাতেই কেন আলাদা একটা বঙ্গাব্দ চালু করতে গেলেন? বাকি ভারতে কেন নয়? কারণ যে কোন রাজা যখন কোন নতুন বর্ষপঞ্জী চালু করবেন, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই গোটা রাজত্বে একই বর্ষপঞ্জী চালু করবেন। অতএব, নিজের রাজত্বের বাকি অংশের জন্য আকবর রাখলেন একরকম বর্ষপঞ্জী, আর শুধু বাংলার জন্য বানিয়ে দিলেন বঙ্গাব্দ — এটা মারাত্মক রকম কষ্টকল্পনা হয়ে যাচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় রাজা বিক্রমাদিত্যের কথা। বিশাল ছিল তার রাজত্বের পরিসীমা। ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অংশ হয়ে এমনকি ইউরোপের কিছু অংশে পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর শাসনের সীমা। তিনি কিন্তু তাঁর সম্পূর্ণ রাজত্বের জন্য প্রচলন করেন একটিই বর্ষপঞ্জী, যার নাম “বিক্রম সম্বত” বা “বিক্রমাব্দ”। মল্লরাজ আদিমল্ল তাঁর গোটা রাজত্বের জন্য চালু করেন “মল্লাব্দ”। কামরূপ রাজ ভাস্কর বর্মন তাঁর গোটা রাজত্বের জন্য যে বর্ষপঞ্জী চালু করেন, তার নাম “ভাস্করাব্দ”। তাহলে আকবর ব্যতিক্রম হবেন কেন? কারণ নিজের রাজত্বের একেক জায়গায় একেক রকম বর্ষপঞ্জী চালু করলে তো রাজকর্মচারীদের পক্ষেও দিন গণনা করা মুশকিল হয়ে উঠবে। এ ছাড়া বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি আকবরের শাসনে এলাহাবাদ, অযোধ্যা, আগ্রা, পাটনা ইত্যাদির মত বারোটি সুবা অধীনস্থ হলেও শুধু মাত্র বাঙ্গালার জন্য পৃথকভাবে একটি বর্ষপঞ্জী তৈরি করতে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তা ছাড়াও, ১৫৮৪ সালে যখন বাংলা সুবার রাজধানী রাজমহল, সেটা তখন বাঙ্গলার বাইরে। বাঙ্গালার অধিকাংশ অংশই তখন মুঘলদের হাতের বাইরে এবং প্রতাপাদিত্য, কেদার রায় ইত্যাদি বাঙ্গালার শাসকদের সাথে মুঘলদের বিরোধ। ঠিক সেই সময় বাঙ্গালার মত প্রান্তিক ও একটি সুবার জন্য কেনই বা আকবর নতুন একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করতে যাবেন? এই প্রশ্নগুলো একেক করে মনে এলেই “আকবর বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন”-এর ভিত দুর্বল হতে শুরু করে।
খ) তারপরেও যদি প্রচলিত মতানুযায়ী ধরেও নেওয়া যায় যে আকবর দিল্লির সিংহাসনে বসার পরেই বঙ্গাব্দ চালু হয়, তাহলে সেখানে গড়মিলটা কী হয়, একটু আলোকপাত করা যাক। এই মতের সব থেকে বড় মুশকিল হল, আকবর সিংহাসনে বসেন ১৫৫৬ খ্ৰীষ্টাব্দে, তার রাজত্ব চলেছিল ১৬০৫ খ্ৰীষ্টাব্দ অবধি। বর্তমানে চলছে ২০২০ খ্রীষ্টাব্দ। যদি ধরে নেওয়া যায়, আকবর ১৫৫৬ খ্ৰীষ্টাব্দেই বঙ্গাব্দ চালু করেন, তাহলে ১৫৫৬ খ্ৰীষ্টাব্দে সাল হওয়া উচিত বঙ্গাব্দ – ১। সেক্ষেত্রে, ২০২০ খ্ৰীষ্টাব্দে সাল হওয়া উচিত ২০২০-১৫৫৫= ৫৬৫ বঙ্গাব্দ। অথচ আমরা সকলেই জানি ২০২০ খ্ৰীষ্টাব্দের ১৪ ই এপ্রিল পালিত হচ্ছে ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। তাহলে আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠা করলে, প্রায় হাজার বছরের পার্থক্য আসছে কী’ভাবে? তখন “আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা”-র তাত্ত্বিকরা সব দলে-দলে মাথা চুলকাতে লাগলেন। হিসেবের এত বড় গোঁজামিল তারা মেলাবেন কী’ভাবে? তখন তারা এক অভিনব পদ্ধতির আশ্রয় নিলেন। তাঁরা বললেন, মোগল বাদশা আকবর নাকি বঙ্গাব্দ প্রচলন করেন ইসলাম ধর্মের আরব্য নবী হজরত মহম্মদের হিজরত-এর বছর অনুসারে। হজরত মহম্মদ মক্কা থেকে মদিনার দিকে যাত্রা বা হিজরত করেন ৬২২ খ্রীষ্টাব্দে। এই হিজরত থেকেই ইসলামী বর্ষপঞ্জী “হিজরী”-এর গণনা শুরু, অর্থাৎ ৬২২ খ্রীষ্টাব্দকে ১ বঙ্গাব্দ আকবর বঙ্গাব্দের বছর গণনা চালু করেন। সেভাবেও যদি হিসেব করা যায়, তাহলেও এই বছর হওয়া উচিত ২০২০-৬২১= ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ। অথচ এটা ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। তাহলে আঠাশ বছরের পার্থক্যটা এলো কী’ভাবে?
গ) আর এই প্রসঙ্গেই পরবর্তী প্রশ্ন উত্থাপিত হতে বাধ্য হচ্ছে যে হিজরত দিয়েই যদি আকবর বঙ্গাব্দ গণনা শুরু করতে চান, তাহলে বঙ্গাব্দের গণনাপদ্ধতি হিন্দু সূর্যসিদ্ধান্ত মতে কী’ভাবে হল? যিনি হিজরতের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা ইসলামিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে আস্ত বঙ্গাব্দ চালু করে ফেললেন, সেই বঙ্গাব্দের গণনাপদ্ধতির সাথে ইসলামী হিজরী বর্ষপঞ্জীর কিছু সঙ্গতি অবশ্যই থাকা উচিৎ। শুধু তাইই নয়, বঙ্গাব্দের মাসের নাম বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ ইত্যাদি এবং বারের নাম সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ইত্যাদি কী’ভাবে হতে পারে? এই সমস্ত মাসের নাম এবং বারের নাম সারা ভারতের প্রায় সমস্ত হিন্দু বর্ষপঞ্জীতেই এক। হিজরত অনুসারে এ কেমন বর্ষপঞ্জী চালু করলেন আকবর, যার গণনাপদ্ধতি চান্দ্রমাস অনুসারে হল না, বারের নাম শুক্র-শনি থেকে জুম্মা-আল সাবাত হল না? মাসের নামও বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য থেকে মাহে রমজান-রবিউল আওয়াল ইত্যাদি কিছুই হল না! বঙ্গাব্দের সমস্ত কিছুই যে ভারতের অন্যান্য হিন্দু বর্ষপঞ্জীর মতোই রইলো, যার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ এই একই সময়ে তামিল নববর্ষ পুথান্দু থেকে মালোয়ালি নববর্ষ বিশু, কামরূপের নববর্ষ ভাস্করাব্দ ইত্যাদি পড়া। গণনা পদ্ধতি একই রকম না হলে তো আর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের এতগুলো হিন্দু নববর্ষ এই একই সময়ে পড়তে পারে না। তাহলে, এ কেমন নতুন বঙ্গাব্দ চালু করলেন আকবর, যার কোনকিছুই বাকি ভারতের অন্যান্য হিন্দু বর্ষপঞ্জীর থেকে আলাদা হলো না, সবটুকুই একই রয়ে গেল? কিছু যদি নাইই পাল্টায়, তাহলে হিজরতের অনুপ্রেরণায় আলাদা বর্ষপঞ্জী তৈরির মানেটা কী?
আসলে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, আকবর সত্যিই এক নতুন বর্ষপঞ্জী চালু করেছিলেন, যার কথা আকবরের সমসাময়িক জীবনী এবং ঐতিহাসিকদের লেখায় রয়েছে। তবে সেই বর্ষপঞ্জীর নাম “তারিখ-ই-ইলাহী”! সেই বর্ষপঞ্জীর সাথে এবং তার গণনাপদ্ধতির সাথে বঙ্গাব্দের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই এবং কণামাত্রও মিল নেই। এমনকি আকবরের কোন জীবনীতে এমন কোন তথ্য প্রমাণের উল্লেখ নেই যে আকবর তার রাজত্বের বাকি অংশ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বাঙ্গালার জন্য একটা আলাদা বর্ষপঞ্জীর গঠন করেন, যার নাম “বঙ্গাব্দ”। আকবর নিজেও নিশ্চয়ই ভাবতে পারেননি, যে তার মৃত্যুর কয়েক শতক পর তার রাজত্বের এক প্রান্তিক কোণের নববর্ষ প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব তিনি পেয়ে যাবেন। আর সেজন্যই আইন-ই-আকবরী’র রচয়িতারাও আকবরের বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার প্রমাণ তো দূরের কথা, উল্লেখমাত্র এসব বইতে রেখে যাননি।
প্রসঙ্গতঃ, বাঙ্গলা বছরের ১২টি মাসের নামের উৎপত্তি হয়েছে প্রাচীন হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যা থেকে। ১২টি মাসের নাম এসেছে যথাক্রমে ১২টি নক্ষত্রের নাম থেকে। যথাঃ বৈশাখ – বিশাখা, জ্যৈষ্ঠ – জ্যেষ্ঠা, আষাঢ় – উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া, শ্রাবণ – শ্রবণা, ভাদ্র -উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ, আশ্বিন – অশ্বিনী, কার্তিক – কৃত্তিকা, অগ্রহায়ণ (মার্গশীর্ষ) – মৃগশিরা, পৌষ – পুষ্যা, মাঘ – মঘা, ফাল্গুন – উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী, চৈত্র – চিত্রা।
অন্যদিকে, আকবর প্রবর্তিত ইলাহি সনের প্রথম দিনটিকে প্রাচীন পারস্যের রীতি অনুসারে নওরোজ (নতুন দিন) হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। এছাড়া ইলাহি সনের মাসগুলোর নামগুলো গ্রহণ করা হয়েছিল প্রাচীন পারস্যের পঞ্জিকায় প্রাপ্ত নামগুলো থেকে। পারস্যের এই মাসগুলোর নাম ছিল- ফারওয়ারদীন (فروردین), আর্দিবিহশ্ত (اردیبهشت), খুরদাদ (خرداد), তীর (تیر), মুরদাদ (مرداد), শাহরীয়ার (شهریور), মেহ্র (مهر), আবান (آبان), আজার (آذر), দে (دی), বাহমান (بهمن) এবং ইসপন্দর (اسفند)। এই নামগুলো বঙ্গাব্দ কেন, কোনো ভারতীয় সংবৎ-এর সাথেই যুক্ত হয় নি।
ঘ) আকবর সত্যিই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হলে সেই যুক্তি অনুসারে ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দের আগে কোন বঙ্গাব্দ ছিলো না। সত্যিই কি তাই? আসুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
বাংলায় এবং কামরূপের বহু প্রাচীন মন্দিরের গায়ে এবং তাম্রলিপিতে এমন বঙ্গাব্দের উল্লেখ আছে, যেটা আকবরের সিংহাসনে বসার বহু আগের। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মৃন্ময়ী মাতার মন্দির ৪০৪ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দির শুধু আকবর নয়, বখতিয়ার খিলজিরও আগমনের আগে প্রতিষ্ঠিত। আকবর যদি বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতাই হন, তাহলে আকবরের বহু শতাব্দী আগের মন্দির গাত্রে এবং তাম্রলিপিতে বঙ্গাব্দের উল্লেখ কোত্থেকে এলো? এ ছাড়াও বাঁকুড়ার একটি মন্দিরে ১০২ বঙ্গাব্দের উল্লেখ আছে, বাঁকুড়ারই ডিহারগ্রাম ও সনাতপন গ্রামে প্রাচীন টেরাকোটার মন্দিরে ৯৬৩ খৃষ্টাব্দের আগের বঙ্গাব্দের উল্লেখ রয়েছে, বৃন্দাবনচন্দ্র পুততুণ্ড রচিত “চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস” গ্রন্থে ৬০৬ বঙ্গাব্দের উল্লেখ আছে। তা ছাড়াও, এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত যে দেওয়া যায়, শুধুমাত্র তাইই নয়, যারা পাণ্ডুলিপি বা পুরাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন, তারা দেখেছেন বা দেখবেন যে, সম্রাট আকবরের সময়ের বা ১৬ শতাব্দীপূর্ব পাণ্ডুলিপিগুলিতে অনেক স্থানেই বঙ্গাব্দের নিদর্শন পাওয়া যায়। বাংলা অঞ্চলে পাওয়া পাণ্ডুলিপিতে অধিকাংশ স্থানেই শকাব্দ এবং কিছুকিছু স্থানে শুধুমাত্রই তারিখ দেওয়া আছে, সেই তারিখগুলি সুস্পষ্টরূপে বঙ্গাব্দের। যারা আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলেন এবং বলেন যে ৯৬৩ হিজরী সালকে বঙ্গাব্দে প্রতিস্থাপন করেই বঙ্গাব্দ যাত্রা শুরু করেছে, সেটা যে কতটা হাস্যকর এবং বালখিল্য কথা, তা একটা দুধের শিশুও বুঝবে।
(২) “আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা” — এই মতের প্রধান প্রবক্তাগণ হলেন বাংলাদেশের শামসুজ্জামান খান, সৈয়দ আশরাফ আলী, সিরাজুল ইসলাম, আহমেদ জামাল ইত্যাদিরা। এনাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আকবরকে বাদ দিয়ে আলাউদ্দিন হুসেন শা-কে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে মত দিয়েছেন। এখানে মনে রাখা দরকার, হুসেন শাহের রাজত্বকাল ১৪৯৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দ অবধি। ইনি বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হলে বঙ্গাব্দের বয়স ৫০০ বছরের বেশী হতে পারে না।
আসলে একটু তলিয়ে দেখলেই বাংলাদেশের ঐতিহাসিকদের আকবর বা হুসেন শা-কে বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িয়ে দেবার মরিয়া চেষ্টার কারণটা বোঝা যায়। খুব বেশী দশক আগের কথা নয়, যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ বাঙ্গালীর চিরাচরিত বর্ষগণনা পদ্ধতিকে উল্টেপাল্টে একটি নতুন কৃত্রিম বর্ষগণনা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং সেটিরও নাম রাখেন বঙ্গাব্দ এবং এই কৃত্রিম বঙ্গাব্দকে “বাংলাদেশের জাতীয় বর্ষপঞ্জী” হিসেবে ঘোষণা করেন। এখানে স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯২ ভাগই মুসলমান, যাদের প্রধান উৎসব হল ঈদ, মহরম, ফতেহা দোয়াজ দহম ইত্যাদি, তাদের এইসব পরবগুলো কি এরশাদ রচিত কৃত্রিম বঙ্গাব্দ অনুসারে গণনা হয়? উত্তর হল – না। বাংলাদেশে ঈদ, মহরম ইত্যাদি সবই হিজরী গণনা পদ্ধতি অনুসারে হয়। উরস, ইজতেমা কি বঙ্গাব্দ অনুসারে গণনা হয়? বাংলাদেশের ৯২% তাদের সন্তানের আকিকা বা সুন্নত, নিকা কিংবা কবর জিয়ারত কি বঙ্গাব্দ দেখে করেন? আজ্ঞে না, বাংলাদেশের ৯২%-এর কোন কাজেই লাগে না বঙ্গাব্দ। তাহলে কী কারণে এরশাদ বঙ্গাব্দ-র গণনাপদ্ধতি পাল্টে দিলেন? বঙ্গাব্দ অনুসারে পূজা-পার্বন গণনা করেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। শিশুর নামকরণ থেকে হাতেখড়ি, বিয়ে থেকে শ্রাদ্ধ, পুজো-পার্বন থেকে গৃহপ্রবেশ এবং তর্পণ, সবটাই হয় বঙ্গাব্দ মেনে।
তবে কি তাদের পূজা-পদ্ধতিতে ব্যাঘাত ঘটানোর উদ্দেশ্যেই “বঙ্গাব্দ সংস্কার”-এর নামে জেনারেল এরশাদের এই নববর্ষ দখলের কু’প্রচেষ্টা? আর সেই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই কি বাংলাদেশের সিরাজুল-আশরাফ আলী-শামসুজ্জামানরা যেন-তেন-প্রকারেন বঙ্গাব্দের ইতিহাস থেকে বাঙ্গালীর নামগন্ধটুকু মুছে দিতে চান? বঙ্গাব্দ নামটুকু থাকবে, কিন্তু তার চিরাচরিত গণনাপদ্ধতি পাল্টে দেওয়া হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। বঙ্গাব্দ থাকবে, কিন্তু তার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে থাকবে কোন মোগল-পাঠানের নাম। তবেই তো বাঙ্গালীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে তার নববর্ষ! নববর্ষ দখল সম্পূর্ণ হলে বাঙ্গালীর কাছ থেকে বাংলাদেশের গ্রাসে যাবে বাঙ্গালীর এক অমূল্য ইতিহাস।
(৩) বঙ্গাব্দের উৎপত্তি নিয়ে ৩ নং মতটির পক্ষে বিশেষ তেমন যুক্তি নেই, তাই এ নিয়ে বিশেষ আলোচনায় যাওয়া অর্থহীন বলে সেই আলোচনা থেকে আপাততঃ বিরত থাকা হলো।
(৪) এইবার তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে আসল সত্যিটা কী? কে করলেন বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠা? এর উত্তর দিতে গিয়ে আমরা আবার অঙ্কের হিসেবে ফিরে যাবো।
এতক্ষণে এই ব্যাপারটুকু নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে ইংরেজী বছর এবং বাঙ্গালা বছরের মধ্যে অনেক বছরের ফারাক আছে। সেটা কত বছর? ২০২০ থেকে ১৪২৭ বিয়োগ করলে আমরা পাই ৫৯৩ বছর, অর্থাৎ বাঙ্গালা বর্ষপঞ্জী চালু হয় ৫৯৩ সাল নাগাদ। এই সময়ে এমন কেউ বাঙ্গালার সিংহাসনে বসেন, যিনি এই বর্ষপঞ্জী চালু করেন। ইতিহাস বলছে, ওই বছরই বাঙ্গালার বুকে যে অজস্র ছোটো-ছোটো রাজ্য ছিল, সেগুলোকে একত্রিত করে প্রথম স্বাধীন বাঙ্গালী সাম্রাজ্য স্থাপন করে সিংহাসনে বসেন মহারাজ নরেন্দ্রাদিত্য “শশাঙ্ক”। রাজধানী ছিল অধুনা মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ গ্রামে। শশাঙ্কের অধীনে ছিল বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যা, অসমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। প্রথম বাঙ্গালী সম্রাট শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেক থেকেই বাঙ্গালীর নিজস্ব ক্যালেন্ডার “বঙ্গাব্দ”-এর সূচনা। ভারতীয় তথা হিন্দু মতাদর্শে এই কাল গণনাও সৌর ক্যালেন্ডার অনুসারে হয়। শশাঙ্ক ছিলেন ঘোর শৈব, তাই শৈবদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার সোমবারে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। লোডস্টার, প্ল্যানেটোরিয়াম সহ বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে যদি দিনটিকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে যে ১ লা বঙ্গাব্দের ১ লা বৈশাখ তারিখটি ছিলো – ৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দের ১২ ই এপ্রিল, অর্থাৎ সোমবার। অর্থাৎ প্রথম বঙ্গাব্দের শুরুর দিনটিও ছিল সোমবার।
আসলে ইসলামিক পূর্ব পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই সেখানকার বাঙ্গালা ভাষায় কথা বলা কিন্তু আরবের মতাদর্শে লালিত বুদ্ধিজীবীরা বাঙ্গালার সব কিছুই হালাল করতে উদ্যোগ নেয়। বাঙ্গালা ভাষায় তাদের অবদান বিস্ময়করভাবে নগণ্য হলেও ভাষাটিকে তারা তাদের নিজেদের বলে দাবী করে। বাঙ্গালার সুপ্রাচীন সভ্যতাকে অস্বীকার করলেও নিজেদেরকে তারা “সহি-বাঙ্গালী” বলে প্রচার করে। এই দাবীকে আরও জোরালো করতে তারা বিভিন্ন ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশের বড় বড় বুদ্ধিজীবীরা ইদানীংকালে বাঙ্গালা ভাষাকেও আরবের অবদান বলে! এমনকি, “বাঙ্গালী” শব্দটিকেও আরবের অবদান বলে!!! আবার এদিকে সেই দেশে পয়লা বৈশাখ পালিত হয় ১৪ই এপ্রিল অর্থাৎ ইংরেজী তারিখ ধরে।
পয়লা বৈশাখ নববর্ষ একটি একান্ত বাঙ্গালী হিন্দুর উৎসব। একে সেকুলার বানানোর চেষ্টা হিন্দুর গৌরবকে ছিনতাই করার নামান্তর। পয়লা বৈশাখে দোকানে-দোকানে হালখাতা হয়, লক্ষ্মী-গণেশের পুজো হয়। বাড়িতে গরু থাকলে এই দিন গোমাতাকে ভগবতী জ্ঞানে পুজো করা হয়।
তাই, বাঙ্গালীর জাতিস্বত্ত্বাকে চুরি হতে দেবেন না। বাঙ্গালীকে সবসময় সজাগ থাকতে হবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। আমাদের নববর্ষ, আমাদের সংস্কৃতির অমূল্য অংশ। বাঙ্গালীর লিখিত ইতিহাস চাই, বাঙ্গালীর ইতিহাস খুব সহজলভ্য হওয়া চাই। যে জাতির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যত দুর্লভ হয়, সেই জাতির ইতিহাস বেদখল হবার সুযোগ তত বাড়ে।
এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তাঁরই সম্পাদিত “বঙ্গদর্শন” পত্রিকায় একটি উল্লেখযোগ্য সমালোচনা হলো, “সাহেবেরা যদি পাখী মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। গ্রীন্লণ্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে, মাওরি জাতির ইতিহাসও আছে, কিন্তু যে দেশে গৌড়, তাম্রলিপ্তি, সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, যেখানে নৈষধচরিত, গীতগোবিন্দ লিখিত হইয়াছে, যে দেশ উদয়নাচার্য্য, রঘুনাথ শিরোমণি ও চৈতন্যদেবের জন্মভূমি, সে দেশের ইতিহাস নাই। মার্শমান্, স্টুয়ার্ট্ প্রভৃতি প্রণীত পুস্তকগুলিকে আমরা সাধ করিয়া ইতিহাস বলি; সে কেবল সাধ-পুরাণ মাত্র।
কিন্তু শুধু ইতিহাসের জন্য ইতিহাস নয়, অহঙ্কার অনেক স্থলে মনুষ্যের উপকারী; এখানেও তাই। জাতীয় গর্ব্বের কারণ লৌকিক ইতিহাসের সৃষ্টি বা উন্নতি; ইতিহাস সামাজিক বিজ্ঞানের এবং সামাজিক উচ্চাশয়ের একটি মূল। ইতিহাসবিহীন জাতির দুঃখ অসীম। এমন দুই একজন হতভাগ্য আছে যে, পিতৃপিতামহের নাম জানে না; এবং এমন দুই এক হতভাগ্য জাতি আছে যে, কীর্ত্তিমন্ত পূর্ব্বপুরুষগণের কীর্ত্তি অবগত নহে। সেই হতভাগ্য জাতিদিগের মধ্যে অগ্রগণ্য বাঙ্গালী”।
আর এই ইতিহাস না লিপিবদ্ধ করার উদাহরণ তো আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। নিজের নববর্ষের প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে বাঙ্গালীর অজ্ঞানতাকে কাজে লাগিয়ে আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা বানাতে চায় একদল সাংস্কৃতিক আগ্রাসী। আর এদেরকে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে এপারের কিছু বঙ্গ-বিভীষণ। তাই এই আগ্রাসন ঠেকাতে চাই নিজের ইতিহাস সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান এবং সেই জ্ঞানের ক্রমাগত স্মরণ। ভুলে যাবেন না, কোন বিদেশী বাদশা আকবর নন, বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বাংলার ভূমিপুত্র রাজা শশাঙ্ক। লাগাতার অপপ্রচার ও ইতিহাস বিকৃতি সম্পর্কে সচেতন হন ও অন্যকে সচেতন করুন। বখতিয়ারের রক্তের মলিনতা থেকে বাঙ্গালীকে বাঁচান।
এই ভয়ানক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিনে, যখন মিডিয়ায়, ওয়েবসাইটে, খবরে, ভিডিওতে ক্রমাগত মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বঙ্গাব্দের নামে, তখন বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা শশাঙ্কের নাম মনে রাখা এবং এই তথ্যটিকে সমস্ত চেনা পরিচিতের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াটাই হল বাঙালির “সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ”। এই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অঙ্গীকার দিয়েই শুরু হোক নববর্ষ ১৪২৭। শুভ হোক নববর্ষ ১৪২৭।
শুভ নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি, হার্দিক শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন জানাই।
সায়ন পাল