আমার সমসাময়িক যাঁরা স্বর্ণযুগের গান শুনে বড় হয়েছেন তাঁরা নিশ্চয় সেই সময়ের ভজনশিল্পী -যূথিকা রায়, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, রথীন ঘোষ প্রমুখদের ভজন গান রোমন্থন করে মনের শান্তি খুঁজে পান।
বর্তমান ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল যূথিকা রায়ের জন্ম শতবর্ষ পার হয়ে গেল। যূথিকা রায়ের জন্ম হয় ১৯২০ সালের ২০ এপ্রিল। হাওড়ার আমতায়। তাঁর আদি বাড়ি ছিল বর্তমান ওপার বাংলার খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে। সংগীত চর্চ্চার প্রচলন ছিল। যূথিকা রায়ের বাবা সত্যেন্দ্রনাথ রায় সংগীতপ্রিয় ছিলেন এবং নিয়মিত তবলা বাজাতেন। যূথিকা রায়ের গানের হাতেখড়ি হয়েছিল পিতার কাছে। মাতা স্নেহলতা দেবী মেয়েকে যথেষ্ট প্রেরণা যুগিয়েছেন সংগীতের ব্যাপারে। যূথিকা রায়ের সংগীতশিক্ষার জীবনে শিক্ষকদের নাম হচ্ছে গোপাল ভট্টাচার্য, গোপাল মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানরঞ্জন সেন, ভীষ্মদেব চট্টোপাধায়। যূথিকা রায় রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে সংগীতসাধনা শুরু করেন, তখন তাঁর বয়স সাত বছর। গানটি ছিল – আর রেখো না আমারে আঁধারে। তাঁকে এই গানটি শিখিয়েছিলেন সুবোধ মজুমদার। গ্রামোফোন রেকর্ডে যূথিকা রায়ের গান আজও যেন আমাদের কানে বাজে-“মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে”,”ওরে নীল যমুনার জল”- বিখ্যাত বাংলা ভক্তিগীতি – রচনাকার কাজী নজরুল ইসলাম, সুরকার কমল দাসগুপ্ত।
যূথিকা রায় বিখ্যাত হয়েছেন ভজন গানের মধ্য দিয়ে। তাঁর ভজন গানে মুগ্ধ হয়েছেন জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, মোরারজী দেশাই, গান্ধিজী প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিরা, জানা যায় গান্ধিজী প্রতিদিন সকালে যূথিকা রায়ের ভজন শুনে প্রার্থনা ও দিনের কাজ শুরু করতেন। ১৯৬৯ সালে গান্ধিজীর জন্মশতবর্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আগ্রহে এবং পৃষ্টপোষকতায় গুজরাটের পোরবন্দরে গান্ধিজীর জন্মভিটেয় যূথিকা রায়কে দীর্ঘ সময় ধরে ভজন গান পরিবেশন করতে হয়েছিল। বেশির ভাগ ভজনই ছিল মীরার ভজন। মীরার ভজন গান্ধিজীর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। আরও জানা যায়, সদ্য স্বাধীন ভারতে হিন্দু – মুসলমান ভাতৃঘাতী দাঙ্গায় ক্ষত বিক্ষত গান্ধিজী যখন মৌনব্রতী ছিলেন বেহালায়, তখন যূথিকা রায় গান্ধিজীকে কয়েকটি মীরার ভজন শুনিয়ে ছিলেন। “রামনাম কি চুডিয়াঁ” আর “ম্যাঁ চাকর রাখো জী” – ইত্যাদি গান শুনিয়েছিলেন। ‘ওরে নীল যমুনার জল’ বাংলা ভক্তিগীতিও গান্ধিজীকে শুনিয়েছিলেন।
সংগীত জীবনে যূথিকা রায় যত সম্নান লাভ করেছেন তার মধ্যে সর্বপ্রথমে নাম করতে হয় ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি- র হাত থেকে পদ্মশ্রী খেতাব। ১৯৭৭ সালে এইচ-এম-ভি কোম্পানী তাঁকে গোল্ড ডিস্ক প্রদান করে সম্নানিত করে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়া যূথিকা রায় ব্রিটিশ ইষ্ট আফ্রিকা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ইত্যাদি জায়গায় অনুষ্ঠান করেছেন। ২০১২তে মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্র সদনে যূথিকা রায়কে সংবর্ধিত করেন। যূথিকা রায়ের বেসিক মানের সংখ্যা প্রায় প্রায় তিনশো, তা ছাড়াও বিভিন্ন আনুষ্ঠানে গান তো গেয়েছেন। সংগীতপ্রিয় মানুষদের একান্ত প্রিয়জন এই মহান ভারত বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ইহলোক ত্যাগ করেন ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী কলকাতায়। তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি।
সুমিত্রা ঘোষ