জয় করো এই তামসীরে – প্রথম পর্ব

প্রথম পর্ব

রাহুলদের বাড়ি আজ খুব হৈচৈ, বাড়ির ছেলে প্রথমবার চাকরি পেয়ে ট্রেনিং করতে বাইরে যাচ্ছে, তাও আবার ব্যাঙ্গালোরে । সকাল থেকে সবাই ব্যাস্ত। ট্রলি, ব্যাগ, ল্যাপটপ, সব ডকুমেন্টস গুছিয়ে নিয়ে রাহুল অবশেষে রওনা দিলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ফ্লাইট যখন টেক অফ করছে তখন রাহুলের মায়ের চোখে অল্প জল, রাহুলের মনখারাপ না এমনটা নয়, কিন্তু প্রথম চাকরির উত্তেজনায় মনটা যেন কোন দূর দিগন্তে চলে গেছে। দুঘন্টা বাদে যখন কেম্পগৌড়া এয়ারপোর্টে ফ্লাইট পৌছালো, এয়ারপোর্ট থেকে ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে এসে সাবাকে ফোন করতেই সাবা বলে উঠলো ,”এয়ারপোর্টের বাইরেই আছি, সাবওয়ের পাশে দেখ, ওলার নম্বর 4536″। 

পৌঁছে গিয়ে রাহুলের মুখে এক মিষ্টি হাসি, তারপরই শুরু হলো ওলা সফরের মধ্যে দিয়ে ব্যাঙ্গালোরে রাহুলের চাকরি জীবন, নাকি এক নতুন বন্ধুত্ব জীবনও বটে। রাহুল ও সাবার বন্ধুত্ব দুজনের বাড়িতেই মানেনি, রাহুলের এক ফটোগ্রাফি এক্সিবিশানে সাবার সাথে রাহুলের আলাপ। সাবা ফারহিন, ছিপছিপে গড়ন, মুখে সর্বদা হাসি লেগে আছে,আড্ডা মারতে ভালোবাসতো কম্পিউটার সাইন্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীটি। প্রথম আলাপেই দুজনের বন্ধুত্ব শুরু। ধীরে ধীরে শুরু হয়ে বাড়ি যাওয়া আসা,বন্ধুত্বের চরম আবেগ উপলব্ধি করার মনমাতানো অনুভূতি।

 রাহুলের বাড়িতে তার মা একটু সন্দেহ করতো, সাবার মা অবশ্য এসব জানতেন না বেশি যদিও রাহুলকে তিনি পছন্দ করতেন, তবে সাবার বাবা আবার খুব গোঁড়া। কিছুদিনের মধ্যেই রাহুলের মা সাবাকে গোপনে বললেন বাড়ি আসাটা তার পছন্দ না , রাহুলের বাবা তো সোজাসুজি বন্ধুত্তটাই ভেঙে দিতে বললেন, নির্লিপ্ত রাহুল মেলামেশা বন্ধ করলো বটে, কিন্তু সেটা লোকদেখানো, অশান্তিকে দূরে রাখতে। উইকেন্ডে দুজনে দেখা করা , ফোন, হোয়াটসআপ চলতে থাকলো, শুধু সাবার নামটা মোবাইলে পরিবর্তিত হলো গিয়ে মনিকা। সাবা রাহুলের সিনিয়র হওয়ার কারণে এক বছর আগেই চাকরি পায়।

 ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে সে রাহুলকে জানায় জীবনের চরম মাধুর্য যদি উপলব্ধি করতে চায় একবার বাড়ির বাইরে বেরোক, কলকাতার চেনা ছক থেকে মুক্তি নিক। রাহুল ব্যাঙ্গালোরে চাকরির চেষ্টা করতে থাকে। সাবার অফিসের ম্যানেজারের সোর্সের সাহায্যে খুব জলদি একটা চাকরিও পায়। ছেলেকে প্রথমবার চোখের আড়াল করতে রাহুলের মা র কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তিনি এই ভেবে খুশি হলেন যে ওই মেয়েটার থেকে ছেলে মুক্তি পেল। বাড়িতে জানলো মনিকা বলে রাহুলের এক সিনিয়র দিদি ব্যাঙ্গালোরে থাকে, তাই কোনো অসুবিধা হবেনা, একই অফিস…..শুধু রাহুলই জানলো মনিকা আর সাবা……. এত একই আত্মা, দুটো আলাদা নাম, যা প্রয়োজনের স্বার্থে ব্যবহৃত। 

ব্যাঙ্গালোরের ট্রেনিং পিরিয়ডের 6 মাস ছিল রাহুলের জীবনের সেরা সময়, ওদের সম্পর্কটা ছিল একটা সত্যিকারের বেস্ট ফ্রেন্ড রিলেশান, যেটা ওরা ছাড়া কেউ বুঝতোনা, ভালোলাগা আমাদের জীবনে অনেক সময় আসে, ভালোবাসাও আসে, কিন্তু ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা চিন্তা ও বিবেচনা করে সেটাকে কে কেমনভাবে নিচ্ছে সেটাই আসল। রাহুলরা পরিবারকে বিরক্ত করতে চায়নি, আবার নিজেদের যে বন্ধন সেটাকেও খুব ভালোবাসতো। তাই নিজেদের সুখের ব্যাবস্থা নিজেরাই করে নিয়েছিল। তারা শপথ নিয়েছিল কখনো প্রেমে না পড়ে সম্পর্ককে উপলব্ধি করবে। 

নন্দীহিলসে ভোরবেলা বাইক ভ্রমণ, উটি তে সানরাইজ, মারাথলির সান্ধভ্রমণ, ভজহরি মান্নাতে সরস্বতী পুজোর দিন পোলাও বা কোরমঙ্গলাতে ক্রিতুঙ্গা রেস্টুরেন্টে বৃষ্টির মধ্যে রুফ টপে আমব্রেলা জোনে বসে কফির সাথে মেক্সিকান স্যালাড……ওয়ার্ল্ড কাপ সেমিফাইনালের ভারত বাংলাদেশ ম্যাচ শেষে চিন্নাস্বামী রোড দিয়ে নিশুতি আলোতে হাত ধরে হেঁটে যাওয়া বাহ বানেরঘাট্টা চিড়িয়াখানা ভ্রমণ.… হয়তো জীবন মানে ব্যাঙ্গালোর না, কিন্তু জীবনের কিছুটা তো ব্যাঙ্গালোর ছিলোই।

ফেরার আগেরদিন যখন ইসকন মন্দিরে সন্ধ্যারতি দেখতে দুজন গেল হটাৎ রাহুলের হাতটা চেপে সাবা বলে উঠলো “একদিন হয়তো ভিন্ন সংস্কৃতির বিয়ে স্বীকৃতি পাবে, আমাদের বন্ধুত্ব সেইদিনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে,আমরা হয়তো মিথ্যেবাদী, কিন্তু ক্ষতিকারক না, আমরা নিজেদের আনন্দকে শুধু নিজেদের মতো গুছিয়ে নিলাম”। রাহুল বললো “আমি চলে গেলে খারাপ লাগবে, একটা বয়ফ্রেন্ড জোটা”, সাবার নির্লিপ্ত উত্তর “তোর মতো পাবলিক পেলে একসেপ্ট করবো, নাহলে দরকার নেই, আমার কাছে ক্যারিয়ার অনেক ইম্পর্ট্যান্ট”।

রাহুল এখন নামকরা ফটোগ্রাফার, সাবা প্রমোশন পেয়ে IBM এ ম্যানেজার, যোগাযোগ খুব ভালো আছে, উইকেন্ডে কথাও হয়ে। তবু কখনো কখনো বৃষ্টির মন খারাপ করা বিকালে রাহুলের মনে পড়ে নন্দীহিলসের দুর্গামন্দিরে যখন ঠাকুর মশায়ের দেয়া লাল টিপ সাবাকে সে পরিয়েছিলো, সাবা সবসময় পেছনে লাগার ঢঙে বলে উঠেছিল “তুই এটাকে সিঁদুর ভাবিসনি তো পাগল”। হয়তো 2500 কিলোমিটার দূরে অফিসে 15 তলার ডেস্কে ক্লায়েন্ট কলের ফাঁকে সাবাও গুনগুন করে গেয়ে ওঠে “তাই চমকিত মন, চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি।” সাবারা বেঁচে থাকুক, মনিকা হয়েই বাঁচুক, কিন্তু বাঁচুক। 

ক্রমশঃ

©সুমন কুমার দত্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.