একমাত্র ছেলেটা যে এভাবে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি অঞ্জনা। আপাত গোবেচারা কিশলয় বিদেশে পড়তে গিয়ে বিদেশিনী সহপাঠিনী এলিজাকে বিয়ে করে এনে সোজা ঘরে তুলেছে । অঞ্জনা আর তাঁর স্বামী মানসও জীবনে ভাবতে পারেননি তাঁদের অমন শান্তশিষ্ট ছেলেটা ভাব-ভালোবাসা করবে আবার বিয়ে করে তাকে নিয়ে সোজা কলকাতার বাড়িতে সারপ্রাইজ ভিজিট দেবে।
জীবনে কিছু কিছু জিনিস মেনে নিতে হয়। নিজের ফর্সা গালের ডানদিকে মেরুণ রংয়ের জড়ুলটার মত অঞ্জনাও সায় দিয়েছিলেন সেদিন। মানসবাবুও শরীরের অবাঞ্ছিত আঁচিলের মত নবপরিণীতা এলিজাকে পুত্রবধূরূপে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অঞ্জনা স্বামীকে সেদিনেই লকারে পাঠিয়ে তাঁর শাশুড়ির পান্না-মুক্তোর ব্রেসলেট জোড়া এলিজার নিটোল, ফর্সা ছিপছিপে হাতে পরিয়ে বলেছিলেন, আমার শাশুড়ির গয়না, রাখা ছিল তোমার জন্যে। সুখী হও তোমরা।
কিশলয় আহ্লাদে আটখানি হয়ে বৌ নিয়ে কালীঘাটে প্রণাম করে এসেছিল। বাড়ি ফিরে মা কালীর সিঁদুর ছেলের বৌয়ের সিঁথিতে পরিয়ে দিতে বলেছিলেন কিশলয়কে। এলিজার একটু আপত্তি ছিল সিঁদুরে। কালীঘাট মন্দিরে যত্রতত্র জঞ্জালপূর্ণ পরিবেশে একটু নাক সিঁটকেছিল। তারপর সেখানকার সিঁদুর? যদি ইনফেকশান হয় তার সুডৌল স্কিনে?
এলিজার খুব অস্বস্তি হয়েছিল সেবার। কিশলয়ের ঠাকুরদার বাড়িটা বেশ পুরোণ। উত্তর কলকাতার বনেদীপাড়া যদিও। কিন্তু তার দাম কিশলয়ের বন্ধুবান্ধবরা দিলেও বিদেশ যাবার পর থেকে তার নিজেরো কেমন যেন একটা নাকসিঁটকোনো ভাব ঐ বাড়িটার প্রতি। এলিজার আগমনে সেই অস্বস্তিটা যেন আরো প্রকট হতে লাগল। তাদের খাবার টেবিলটা কেতাদুরস্ত নয়। বসবার ঘরের পর্দাগুলো কেমন যেন রংগচটে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মান্ধাতার আমলের সেই স্টীলের থালাবাটি গ্লাস। অঞ্জনা কিন্তু ছেলেবৌয়ের যত্নের ত্রুটি রাখেননি সেবার। ঐ বাড়িতেই যত্ন করে তাদের পাতে তুলে দিয়েছেন নিজের হাতে রান্না করা বিশেষ বিশেষ পদগুলি। নতুন বৌমাটি খাবার সময়ে রা’টি কাড়েনি। ঠারেঠোরে বুঝিয়েছে বাঙালী খাবার তার খুব ভাল লেগেছে। একটিমাত্র ছেলের বৌয়ের আহ্লাদে মানসবাবুও খুশি হয়েছেন। রাতেরবেলায় অঞ্জনাকে কাছে টেনে নিয়ে ফিশফিশ করে বলেছেন, কি গো কেমন বুঝছো?
বুদ্ধিমতী অঞ্জনা বলেছেন, কী আবার বুঝব? বৌ তো আমাদের দুদিনের অতিথি। থাকবে তো কপোতকপোতী আলাদা। বুঝতাম শ্বশুরের ঘর করছে তবেই সার্টিফিকেট দিতাম।
পুত্রপ্রেমে অন্ধ মানসবাবু বলেছিলে, আহা! কিশু আমাদের একমাত্র ছেলে। ওর বৌ তো আমাদের মেয়েই গো অঞ্জু।
অঞ্জনা তার স্বামীর কথার খেই ধরেই বলেছিলেন, কিশু কি আমার কিছু কম গো? তবে যাই বলো আর তাই বলো বাপু, তোমার বৌমার সংগে দুটো কথা কয়ে সুখ নেই। তার কথা আমি না পারি বুঝতে আর না পারি তার সংগে ইংরেজীতে ফ্যাটফ্যাট করে দুটো কথা কইতে।
রাতে এলিজার ঘুমোতে কষ্ট হয়েছে। যা গরম এখানে! কিশুর ঘর আবার তিনতলায়। সারাদিনের রোদে তেতে থাকে ছাদ। যদিও দক্ষিণখোলা তবুও প্যাচপ্যাচে ঘামের অভ্যেসটা যে এলিজার একদম নেই। মাঝেমাঝেই সে বলে ফেলেছে, – ও মাই গোশ! কলকথা ইজ হরিবল!
বেশ কয়েকদিন নিজের বাড়িতে থাকবার পর নির্দিষ্ট দিনে ওদেশে ফিরে গেছিল কিশলয় আর এলিজা। যাবার সময় শাশুড়িকে একবার বলেওছিল ওদেশে যেতে।
সেইকথা শুনে কিশলয়ও বাপের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তোমাদের পাসপোর্ট করিয়ে রাখ। টিকিট কেটে পাঠিয়ে দেব। তোমরা ঘুরে আসবে মাসখানেকের জন্যে।
তবে ছেলে-বৌ দুজনেরি আপ্যায়ণের ভাষায় আন্তরিকতাটা যেন একটু কম।
অঞ্জনা, মানসবাবু দুজনেই তা অনুভব করলেন। দুজনেই দুগ্গা দুগ্গা বলে তাদের রওনা করে দিয়ে এ ওর মুখের দিকে চেয়ে স্থানুবত দাঁড়িয়েছিলেন কিছুক্ষণ। তারপরেই বাস্তবে ফিরে এসে মানসবাবু বলেছিলেন, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে…..আমি বাপু যাব না তাদের কাছে। তোমার ইচ্ছে হলে বোলো, সব ব্যবস্থা করে দেব।
অঞ্জনা অবিশ্যি বিদেশ যাবার আনন্দে বলে উঠেছিলেন, কেন গো? সকলেই তো যায়। একবার না হয় যাব আমরা। মানস বাবু বললেন, আমেরিকা যাওয়া কি চাড্ডিখানি কথা? কত আটঘাট বেঁধে আমাদের যেতে হবে বলো তো?
— কত সাধ ছিল নিজেরা দেখেশুনে কিশুর বৌ আনব, ঘটা করে গায়েহলুদের তত্ত্ব সাজিয়ে দেব। আইবুড়োভাত থেকে আশীর্বাদ, বৌভাত, রিসেপশান কিছুই বাদ দেবনা। কোনো শখই তো পূরণ হলনা এই জন্মে। বিদেশ যাবার সুযোগটা না হয় পূরণ করেই আসি। ওরা কেমন সংসার সাজালো দেখে আসি একটিবার। কিছুইতো নিলনা তোমার ছেলে। বৌটার জন্যে সোনার লোহা গড়িয়ে নিয়ে এলুম, সেটাও রেখে চলে গেল, বলল, তার নাকি গয়না পরতে ভাল লাগেনা।
— কেন? মায়ের জড়োয়ার ব্রেসলেট দুটো তো দিব্যি নিয়ে নিল। বলল, ওয়েষ্টার্ন আউটফিটের সঙ্গে নাকি দারুণ মানাবে এটা। পার্টিতে দেখাবে সকলকে, ইন্ডিয়াতেও কেমন কারিগর আছে দেখ। তবু ভাল, তোমার ছেলের দেশের মানটুকুনি রেখেছে আমাদের এলি।
অঞ্জনা বললেন, বারেবারে বললাম, লোহাটা পরতেই হয় আমাদের্, আমার কিশুর মঙ্গলের জন্যে। সিঁদুর না হয় এলার্জির জন্যে নাই বা পরল। আর কিশুটাও হয়েছে যেমন! বৌয়ের সম্মতিতে কিছু করতে গেলেই আমাকে ইশারা করেছে বারে বারে। বাব্বা! এর মধ্যে এত? বৌ-গত প্রাণ হয়েছে তার। আরে বাবা, একফোঁটা সিঁদুর পরেও তো দেখতে পারতি! এলার্জি হলে না হয় আর লাগাতিস না। এই বিদেশের মেয়েরা বাপু বড্ড নিজের খেয়ালে চলে। খুব স্বাধীন তারা।
— আর তোমার দেশী মেয়েরা বুঝি খুব শ্বশুর-শাশুড়ির বাধ্য আজকাল? মানসবাবু বললেন। এই নিয়ে আর ভেবোনা তো, যা কপালে ছিল হয়েছে। বেশী ভাবলে আমাদের মানসিক শান্তি নষ্ট হবে।
অঞ্জনা বললেন, তবে এলিকে বড় সুন্দর দেখতে। আমাদের কিশু তো তেমন কিছুই নয় ওর পাশে। আমরা পছন্দ করে অমন রূপে লক্ষী, গুণে সরস্বতী কি আর আনতে পারতাম? আজ মনে হচ্ছিল ব্রেসলেটের সাথে ম্যাচ করা নেকলেস আর কানের দুলাদুটো বের করে দি। তারপরেই ভাবলাম পরের বার আবার যদি সাধ দিতে হয়? তখন না হয় দেব। দেওয়া তো আর পালিয়ে যাচ্ছেনা।
–এইবার পথে এসো গিন্নি! আমার বাবা বলতেন সাহেব-মেমদের সব ভাল। সাদাচামড়ার ঐ গুণ, বুঝেছ? তুমি শাশুড়ি হয়েও অজানা, অচেনা, বিদেশিনীর গুণমুগ্ধতায় আটখানি এখন। তবু যদি বৌ তোমায় রেঁধে খাওয়াত একবেলা কিম্বা তোমার কথা রেখে ঐ নোয়াটা গলিয়ে নিত হাতে।
আত্মীয় পরিজনদের ঘটা করে ছেলের বিয়ে নিয়ে আগবাড়িয়ে কিছু বলতেও গেলেন না অঞ্জনা আর মানস বাবু। বিদেশে থাকে। কেউ জিগ্যেস করলে বলে দেবেন সে ওখানেই বিয়ে করেছে। আর যেমন সব আত্মীয় স্বজন তাঁদের। বুড়ো বুড়ি একলাটি থাকেন ঐ অত বড় বাড়িটায়। তারা সবাই যে যার মতো। দরকার ছাড়া খোঁজও নেয়না কেউ। ঐ বড়জোর বিজয়ার প্রণামটুকুনি, তাও ফোনে সারে।
তবে এবার ছেলেটা বৌ নিয়ে চলে যাবার পর অঞ্জনা আর মানসবাবু নতুন করে পুত্রস্নেহকে আবিস্কার করলেন। এদ্দিন ছেলে বিদেশে গেছে। বছরে একবার করে আসে কিন্তু এবার পাক্কা তিনবছর পর এল আর তাদের মনটাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। সব ওলটপালট হয়ে গেলে দুই প্রৌঢ়প্রৌঢ়ার।
মাত্র পনেরোটা দিন কোথা দিয়ে যে চলে গেল! ছেলেকে ঐ খাওয়াতে পারলাম না, সেই খাওয়াতে পারলামনা, বৌটাকে একবার দক্ষিণেশ্বর, বেলুড় ঘোরানো হলনা… এই আক্ষেপ কুরেকুরে খেতে লাগল তাঁকে। এটা দিতে ভুলে গেলাম, সেটা নিয়ে গেলনা বলে বলে স্বামীর মাথাটা খেয়ে নিলেন। পরক্ষণেই আবার চচ্চড়িতে পাঁচফোড়ন দিতে দিতে ভাবতে লাগলেন অঞ্জনা, কেন যে এই সময় দেশে আসা! তোদের গরমে কষ্ট হয়, বাড়িতে এসি নেই । তার ওপরে আবার মেমসাহেব বৌ। একেবারে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। মেয়েটার মশারীর মধ্যে কি কষ্টই না হল ক’টা দিন! কালীঘাটে যাবার সময় বালুচরী শাড়িটা পরেই খুলে ফেলল সে! বলল, ইটস টু হিউমিড! কান্ট ওয়ার এ হেভি সিল্ক নাও। বলে স্কার্ট-ব্লাউজ পরে চলে গেল।
জষ্ঠিমাসের দাপুটে গরমে অঞ্জনাও তো বৌ হয়ে এসেছিলেন ঐ বাড়িতে। মাথার ঘোমটা খোলার জো ছিল না তাঁর। নতুন শাড়ীতে গরমে ঘেমে চুপ্পুস হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে প্রথমদিন মনে হয়েছিল এদের বাড়িতে সারাক্ষণ কি ঘোমটা দিয়ে থাকতেই হবে? সত্যি! এখনকার মেয়েরা কত স্বাধীন। স্বাচ্ছন্দ্যে, কোনো কুন্ঠা না করেই নিজের মতামত ব্যক্ত করে ফ্যালে। তার ওপর এ আবার মেমসাহেব! আরেক কাঠি ওপরে! আর তাঁর ছেলের যা বৌ প্রীতি! পান থেকে চুন খসলে ঐ কটা দিন ঠারেঠোরে মা’কে জানিয়ে দিয়েছে। আভাসে ইঙ্গিতে বলে দিয়েছে, মা ওর ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো তুমি। শি ইজ কমপ্লিটলি ফ্রম এ ডিফারেন্ট এনভায়রনমেন্ট। অতএব মাসখানেকের মধ্যেই ঐ নতুন বৌ মানে এলিজার সবকিছু মেনে নিয়েছেন অঞ্জনা।
অবশেষে অঞ্জনা মানসবাবুকে রাজি করিয়েই ছাড়লেন। ছেলের কাছে তাঁদের একবার যেতেই হবে। পাসপোর্ট, ট্যুরিষ্ট ভিসা, টিকিট সব পর্ব একে একে মিটল। তাঁরা নির্ধারিত দিনে কিশলয়ের কাছে আমেরিকায় পৌঁছলেন। এয়ারপোর্টে নিতে এসেছিল কিশলয় আর এলিজা দুজনেই। তা দেখে প্রথমেই খুশিতে ভরে উঠল মা-বাবার মন। ছেলের গাড়িবাড়ি সব দেখে গর্বিত মা-বাবা মনে মনে বললেন, আহা, আমাদেরি তো ছেলে। তার সংসারে আমরা আসবনা তো আর কে আসবে।
ছেলে বৌ দুজনে মিলে চিকেনকারি, ভাত রেঁধে রেখেছিল। মা-বাপের খুশি সেসব দেখেশুনে আরো একধাপ বেড়ে গেল। দিনকয়েক পর ছেলে বৌ অফিসে চলে গেলে অঞ্জনা রান্নাঘর সামলাতে গেলেন। কিশুকে কতদিন নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াননি। ছেলেকে দিয়ে মাছ আনিয়েছেন। সযত্নে ঘি ভাত, মাছের কালিয়া, মালাইকারী রেঁধে রাখলেন । না জানি কী খুশিই না হবে কিশু! আর এলিও তো বাঙালী খানা বেশ পছন্দ করে।
রাতে বাড়ি এসে ডিনার টেবিলে ঘিভাত দেখে এলিজা বলল, টেরিব্ল! মা, উইল ইউ কিল আস? দ্যা ফুড ইজ এক্সট্রিমলি অয়েলি।
কিশলয় চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। মায়ের রান্নার সুখ্যাতি করা তো দূরের কথা বৌয়ের কথায় বরং সায় দিয়েই বলল, সিম্পলি ডাল, ভাত আর সবজী করে দিলেই তো পারতে। এখানে আমরা ক্যালরি হিসেব করে খাই।
অঞ্জনা আর মানসবাবু খেয়েদেয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে শুলেন বটে কিন্তু সে রাতে ঘুম এলনা তাঁদের। এখন থেকে সাবধান হলেন অঞ্জনা। সাদামাটা রাঁধাবাড়া করেন তিনি। ছেলে-বৌয়ের সংসার যে তাঁর নয়, তা বুঝিয়ে দিয়েছে এলি। কলকাতা থেকে আসবার আগে ভেবে রেখেছিলেন কতকিছু। কিছুই বাস্তবায়িত হলনা।
উইকেন্ড এলেই গাড়ি নিয়ে বাবা মা কে নিয়ে এধার ওধার বেড়াতে নিয়ে গেল কিশলয়। বেশ লাগল তখন। ঝাঁ-চকচকে শপিং মল, গ্রোসারী স্টোর্স, আকাশ, বাতাস, ঝকঝকে পথঘাট সব ভাল এখানে কিন্তু বড্ড যেন আড়ষ্টতা। সবকিছুই ভীষণ কৃত্রিম। চেনা মানুষ কিশলয়টাও পালটে গেছে। তার স্বাভাবিক অনুভূতিগুলো মরে গেছে। ছেলে বৌ দুজনার ব্যাবহারে কেমন যেন যান্ত্রিকতা। আচ্ছা এখানে সব মানুষগুলোই কি অমন মেকানিকাল ? ভাবলেন অঞ্জনা। আবার ভুলেও গেলেন পরমূহুর্তে।
পরদিন ছিল কিশলয়ের জন্মদিন। সকালবেলা উঠে নিজের মানসপুজো সেরে ছেলের মঙ্গল কামনা করে কিচেনে গিয়ে চটপট লুচি আর আলুর দম বানিয়ে ফেললেন অঞ্জনা। ওদের সারপ্রাইজ দেবেন। লুচি খেতে ছেলেটা কী যে ভালবাসে!
সেদিন সকালে উঠে নিজের শাড়িটা ভুল করে কেচে ফেলে ওদের বারান্দায় লম্বালম্বিভাবে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন অঞ্জনা। অন্যদিন ছেলেবৌ মায়ের এই অপকর্মটি দেখতে পায়না কারণ তারা অফিসে চলে যাবার পরে ঘটনাটি ঘটে। এলিজা সেদিন ঘুম থেকে উঠে হঠাত বারান্দায় গিয়ে সেই ঝোলানো শাড়িটা দেখে রেগে অগ্নিশর্মা! কিচেনে ঢুকে শাশুড়িকে যারপরনাই বকুনি দিল। তারপরেই তার চোখ পড়ল পাহাড় প্রমাণ লুচির থালায়। এদিকে সেই লুচিভাজার কারণেই স্মোক এলার্মে তার ঘুম ভেঙেছিল সেটা এই ডামাডোলে ভুলে গেছিল। এবার দুয়ে দুয়ে চার করল সে। শ্বশুরের সামনেই স্পষ্ট ফতোয়া জারি করল এলিজা। তার রান্নাঘরে যেন ভবিষ্যতে আর কিছু ভাজা না হয়। এখানে সবকিছু নিজেদের করতে হয়…সারাদিন অফিস করে এসে কিচেনে ঢুকে তৈলাক্ত কিচেনটিতে ঢুকতে মোটেও ভাল লাগবেনা…ইত্যাদি, ইত্যাদি।
জন্মদিনের ভোরটি যেন একমূহুর্তে বড় বিমর্ষ ও ম্লান হয়ে গেল। চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে প্রতিদিনের মত এসে সকলে বসলেন চা খেতে। এলিজা দিব্যি একটি একটি করে লুচি সকলের প্লেটে তুলে দিতে লাগল। নিজেও খেল তৃপ্তি করে। কিশলয় খুব খুশি হয়ে মায়ের হাতের লুচি আলুর দম খেল। তবে বৌয়ের সামনে কিছু বলতে পারলনা। শুধু একবার বলল, মা, আমার জন্মদিনে কদ্দিন বাদে তোমার হাতে লুচি খেলাম। সেই শুনে অঞ্জনার বুকটা অনেকদিন পর ভরে গেল। মায়ের প্রাণ জুড়িয়ে দিল তার কিশু। আর এলিজার কথা তিনি আর ধরেন না সেভাবে। এলিকে ভালো না বাসলে তার কিশু দুঃখ পাবে। অঞ্জনা আর মানসবাবুর আর কেউ নেই। ছেলেবৌকে চটিয়ে কী লাভ তাঁদের? নরমে গরমে চলুক এমন। বেঁচে থাক তাঁদের সম্পর্ক। আজকাল যা সব ঘটছে!
দেখতে দেখতে ভালোয় মন্দে একটা মাস অতিবাহিত হল। অঞ্জনা আর মানসবাবু ফিরে এলেন কলকাতায়। এরপর কিশলয়ের সাথে, অঞ্জনার সাথে ফোনে কথা হয়। স্কাইপ কল এ দেখতে পান দুজনেই দুজনকে। দূর থেকে এলিজাকে বড্ড আন্তরিক দেখায়। কিশুও যেন অতদূরে বড্ড সাবলীলভাবে মেশে বাবা-মায়ের সঙ্গে।
মায়ের মন ছ্যাঁত করে ওঠে। বলে ওঠেন স্বামীকে, আবার যাবে নাকি ছেলের কাছে?
মানসবাবু বলেন, নাহ্, আর নয়। দূরে থাক ওরা, ভাল থাক, বেঁচে থাক। কথায় বলে না? ‘ডিসট্যান্স মেকস হার্ট গ্রো ফন্ডার’। দূরে দূরে থাকলে রিলেশানশিপ মজবুত হয়। ওদের ওদের মত থাকতে দাও। আমরা আমাদের মত থাকি।
অঞ্জনাও বলেন, সেই ভাল। আজকাল কোথাও যাব বললেই মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। তার চেয়ে চলো আমরা দেশের মধ্যে ছোটখাটো ট্যুর করে আসি।
মানসবাবু বলেন, কিন্তু তারপর কী হবে আমাদের? অঞ্জনা বলেন, ভগবান দেখবেন আমাদের। আমরা তো স্বেচ্ছায় কিশুকে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। তখন কি আর ভেবেছিলাম আমাদের শেষ বয়সে কে দেখবে? কে আবার কাকে দ্যাখে গো? তুমি আমায় দেখবে, আমি তোমাকে দেখব। নিজেদের নিয়েই ভুলে ছিলেন তাঁরা।
এই ভাবেই বেশ চলছিল। ধীরে ধীরে অঞ্জনা আর মানসবাবু বার্ধক্যে উপনীত হলেন। ছেলের কাছে বেড়াতে যাওয়া তো দূর অস্ত বাড়ির বাইরেও বেশী বেরোন না তাঁরা। কিছুটা শারিরীক কারণে, কিছুটা অসহায়তায় জীবনের যাপনচিত্রটা বদলাতে লাগল। কিশলয় আরো বড় চাকরি করছে। এলিজা চাকরি ছেড়ে দিয়ে দুটি সন্তানের মা এখন। দেশে এসে বাবা-মায়ের দেখভাল করা বা দায়িত্ব নেবার ব্যাপারটাও মাথা থেকে নেমে গেছে তাদের।
এখন একমাত্র পুত্রকে স্বেচ্ছায় আমেরিকায় পাঠিয়ে পুত্র বিগলিত প্রাণ অঞ্জনা-মানসবাবুর মনোকষ্টের শেষ নেই। তাঁরা বছরে একবার ছেলের কাছে যাবেন যে সে উপায় নেই আর। তবুও তো সারাবছরের রসদ সংগ্রহ করে আনতেন স্মৃতির ক্যানভাসে। আর ছেলে-বউ যে আসবে সে উপায় নেই, ছোট ছোট নাতিনাতনি দুটোকেও দেখা হয়নি তাঁদের। সে এক বড় জ্বালা! একাকিত্বের বিষন্নতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বস্তাপচা টিভি সিরিয়াল, পাড়ার ক্লাব, আত্মীয়-বন্ধুর সাথে ঝালিয়ে নেওয়া সম্পর্ক… এই সব নিয়ে বার্ধক্যের বারাণসীতে কোনরকমে ছিলেন তাঁরা। তবু ছিলেন সুস্থ।
হঠাৎ চিকিত্সা-বিভ্রাটের কবলে পড়ে অঞ্জনার একটি পায়ের সব কটি আঙ্গুল একে একে বাদ দিতে হল। ছেলে একবার আসতেও পারল না। বিশেষজ্ঞের পরামর্শে বিশেষ ধরনের সিলিকোন আস্তরণ দেওয়া জুতো, ওয়াকার এসবের সাহায্যে অঞ্জনা বেঁচে রইলেন । স্বামীর সাহচর্য, আর সহমর্মিতা তাঁকে কখনই বুঝতে দেয় না পুত্রের অভাব, ও তাঁর এহেন বিপর্যয়।
অঞ্জনা অনেক বেশী পরনির্ভর এখন।
মানসবাবু ডাক্তারের নির্দেশমত অঞ্জনার কাটা পাটিতে নিয়মিত গরম-ঠাণ্ডা জলের স্পঞ্জ দেন। তারপরে মুছিয়ে নিখুঁতভাবে এলোভেরা ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ ক্রিম লাগিয়ে সবশেষে সেই বিশেষ জুতোটি পরিয়ে তার ফিতে বেঁধে দেন। পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধের অসহায়, প্রতিবন্ধী বৃদ্ধা স্ত্রীর জন্য প্রতি মূহুর্তে এরূপ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া দেখে অবাক হয় সকলে।
অঞ্জনা বলেন, আমি কত পাপ করেছি গো! রোজ রোজ তুমি আমার পদসেবা করছো! তোমাকে নীচু হয়ে প্রণাম করার ক্ষমতাও আমার নেই আর।
মানসবাবু রোজ ওষুধ লাগানোর আগে ঠাট্টা করে বলেন, দেহি পদপল্লবমুদারম্! স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়েই একথা বলে গেছেন কবি জয়দেব! আমায় একটু তোমার সেবা করতে দাও। তোমাকে পার করে দিয়ে যেন আমি যেতে পারি। আগের জন্মে অনেক পাপ করেছিলাম গো। না হলে আমার অমন ছেলে তুমি তোমার গর্ভে ধারণ করো! না হয় সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তই করে যাই এই শেষ বয়সে! আমাদের যৌথ পরিবারে তুমি অনেকের জন্যে অনেক কিছু করেছ। আমি তো চাকরি সামলাতেই ব্যস্ত ছিলাম। জীবনে কোনোদিন তো আর তোমার ছেলেটার মত বৌয়ের আঁচল ধরতে পারিনি। এখন নাহয় তোমার একটু সেবাই করি!
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়