ভাবছিলাম অভিধানে সংযম শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা ঠিক কি আছে

লকডাউন বেড়েছে প্রায় আরো দিন পনেরো, যদিও তাতে শিথীলতাও এসেছে বেশ খানিকটা। সাধারণের জন্য যানবাহন পরিষেবা চালু না হলেও কলকাতার অলিগলিতে অটোর তিন চাকা গড়াতে শুরু করেছে অল্পবিস্তর৷ যাদবপুরে দাঁড়িয়েছিলাম মুকুন্দপুর যাওয়ার জন্য। ভ্যাক্সিনের স্লট পেয়েছি মেডিকায় এক বন্ধুর অফিসিয়াল সোর্সে৷ কিন্তু প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটেও যখন ভাগ্যে অটোর শিকে ছিঁড়ল না বাধ্য হয়ে র‍্যাপিডোদেবের শরণাপন্ন হতে হল। অনেকটাই দেরী হয়ে যাওয়ার কারণে আমিই ছেলেটাকে বললাম, ” ভাই তাড়াতাড়ি চালাও”। ছেলেটা ভালই চালাচ্ছিল কিন্তু সন্তোষপুর লেকের কাছে টার্ন নেওয়ার সময়ই এক ছোটখাটো বিপত্তি হল। একটা লাল আই-টেনের ডান দিকের লুকিং গ্লাসটা গেল ভেঙে।

স্বভাবতই গাড়ির চালক নেমে এলেন। ঘটনার মোড় এখানেই। গাড়ী থেকে যে নেমে এল সে চালক না বরং চালিকা, আর বিবরণে হঠাৎ করে ‘এলেন’ থেকে ‘এল’ লিখছি এই কারণে যে কখনও আমিই তার কাছে “আপনি” সম্বোধিত হতাম। শুকনো ঝামেলার পাঠ চুকিয়ে ওরই গাড়িতে উঠলাম মেডিকা যাওয়ার জন্য। চরম অস্বস্তি বোধ করছিলাম। বছর পাঁচেক আগে যে ছোটো মেয়েটাকে পড়াতাম তার সাথে আজকের পাশে বসা মেয়েটার বিস্তর ফারাক৷ সমাজের ভ্রুকুটি বরাবর সব কিছুতেই এগিয়ে আসে, তাকে যদি পাত্তা নাও দিই তাও সাহস আর মানসিক দ্বন্দ্বের বেড়া টপকানোটা যে বেশ কঠিন তা বলাই বাহুল্য।

মেডিকায় আমাকে ড্রপ করে দিয়ে ও জিজ্ঞাসা করল, ” স্যার আপনি ফিরবেন কিভাবে?”। আমি সহজভাবেই বললাম, ” যেভাবে এসেছি”। এতটা বেফাঁস মন্তব্য যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি আনবে ভাবিনি। আমার বলার উদ্দেশ্য ছিল র‍্যাপিডোতেই ফিরব। কিন্তু ও হেসে বলল, ” ওকে স্যার। দাঁড়ান আমি পার্ক করে আসছি”। আমি কিছু বলার আগেই ও পার্কিং লটের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে দিল। আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে কোনো দরকার নেই, কিন্তু সে কোনো কথা শোনারই পাত্রী নয়। ও বলল, ” আমার কোনও কাজ নেই তেমন। মামারবাড়ি যাচ্ছিলাম। বাবা-মা আগেই চলে গেছে ষষ্ঠীর অকেশানে। আমি যাব নাই বলেছিলাম। ফাইনালি শর্ত দিয়েছিলাম যে আই-টেনটা আমায় নিয়ে যেতে দিলে তবেই আমি যাব “। আমি বললাম, ” তাহলে এবার তো চিটিং হয়ে যাচ্ছে এটা। ঠিক না”। ও এবার বিরক্ত হয়েই বলল, ” স্যার আপনি না এখনো একই রয়ে গেছেন”।

হসপিটালে ফাইনাল রেজিস্ট্রেশান করিয়ে ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসলাম দুজনে পাশাপাশি। হাজারো উপন্যাস আর বাস্তবের কঠিন সত্য তখন তোলপাড় করছে আমার মন আর মস্তিষ্ককে। কোথাও লোকসমাজের রক্তচক্ষু আর কোথাও বা হীনন্মন্যতা আমায় কুরে কুরে খেতে শুরু করেছে। নীরবতা ভাঙল ওরই স্বরে, ” স্যার এখনও পড়াচ্ছেন?”। উত্তর দিলাম, ” না।”। ও আবারও নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে লাগল। আর আমিও অত্যন্ত অভদ্রতার সাথে কোনোটা ঘাড় নেড়ে কোনোটা বা শুধু হ্যাঁ-না বলে এড়িয়ে যেতে থাকলাম। যাকে আমার ধন্যবাদ জানানোর কথা তাকে অবজ্ঞা করার কারণটা আমি নিজের কাছেই স্পষ্ট করে দিতে পারছিলাম না।

প্রাইভেট হসপিটাল। কাজেই বেশিক্ষণ ওয়েট করতে হয়নি। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে বললাম, ” তুমি চলে যাও, আমার কাজ আছে”। ও অবাক হয়ে বলল, ” হঠাৎ আবার কি কাজ এসে গেল? চলুন আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসি।” আমি বললাম, ” না থাক তার দরকার হবে না”। আমি জানতাম যে অভদ্রতাটা আমি করে চলেছি তার কারণটা বাইশ বছরের বায়োটেকনোলজির স্টুডেন্টের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। ও শেষটায় একাই চলে গেল।

আমি অটো স্ট্যান্ডের কাছে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। ধোঁয়াটা বুকের পাঁজরকে ঝাঁঝরা করে দিয়েই বেরোচ্ছিল। ভাবছিলাম অভিধানে সংযম শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা ঠিক কি আছে।

বি.দ্রঃ ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম।
” ছাত্রীদের পাত্রী বানানো জামাইদের জামাইষষ্ঠীর শুভেচ্ছা”।
ফালতু কয়েক মিনিট সময় নষ্ট করানোর জন্য দুঃখিত।

— রূপম চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.