স্যার, আপনাকে অভিক রায় ডেকেছেন। ফ্লোরের পিয়ন এসে দাঁড়ায়।
- কে অভিক রায়? অনির্বাণের আজ প্রথম দিন নতুন অফিসে, ড্রয়িংহলে বসে একটু নিজের বইপত্র গুছিয়ে রাখছে, এমন সময় পিয়ন এসেছে।
- আজ্ঞে সামনের চেম্বারে উনি বসেন। মালিকের ভাগ্নে।
গেল তাহলে। এনার কাছেও কি ইন্টারভিউ দিতে হবে? ভিতরটা গুড় গুড় করে ওঠে। কেমন লোক হবে কে জানে? পাশের টেবিলে বসা ছেলেটি বলে – বেশি কিছু বলবেন না। শুধু শুনবেন। যান দেখে আসুন উনি কি বলেন। লোক খারাপ না।
ঢুকতেই অনির্বাণ দেখে অন্তত ছয় ফুট কয়েক ইঞ্চি লম্বা একটা মধ্যবয়সী মানুষ টেবিলের ওপারে বসে আছে। ফরসা টিকলো নাক, এক মাথা কালো চুল পিছন দিকে উল্টানো। মুখে একটা পাইপ। এককথায় খাঁটি বাংলা সাহেব। গলাটাও বেশ ভারিক্কি। গলায় টাই, চেয়ারের পিছনে কোটটা ঝুলছে। চেম্বারে এদেরকেই মানায়। পিছনের তাকে অগুনতি মোটা মোটা বই। টেবিলে গাদা-গুচ্ছের বই, কোড, খাতা, খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছিলেন। অনির্বাণ দরজা ঠেলে ঢোকাতে সব থামিয়ে একগাল হাসি ঝুলিয়ে সাহেবি কায়দায় হাত বাড়িয়ে দিলেন – অভিক রায়। ওয়েলকাম টু আওয়ার অফিস। বসুন বসুন।
অনির্বাণ বসে পড়ে। চেহারায় আর উপস্থিতিতে একটা প্রছন্ন আভিজাত্য। দেখে বুঝতে পারে খুব গম্ভীর কোন সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। আলাপ হয়। অভিক রায় হাল্কা হেসে বলেন – কেমন লাগছে? তেমন কিছু নয় ,আপনি আজ জয়েন করেছেন শুনলাম, তাই স্রেফ আলাপ করার জন্যে। এর আগে কোথায় ছিলেন?
সব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই চারিদিকে। অনির্বাণ উত্তর দেয় – নিশ্চয়ই আপনিও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার?
অভিক রায় একটু ঘার বাঁকিয়ে বলে – ঠিক ধরেছেন। খাসা বিষয় কিন্তু। জানেন ত এ হল মাদার অফ ইঞ্জিনিয়ারিং?
মাথা নাড়ে অনির্বাণ।
- এত নতুন নতুন কোম্পানি থাকতে এইখানে কি ভেবে?
অনির্বাণ বলে – অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল এখানে জয়েন করবার। শুনেছি প্রচুর শেখবার আছে এখানে। আপনাদের লাইব্রেরিটা দেখলাম। দারুণ কালেকশন।
- হ্যাঁ। সেটা ঠিক। ওনার মুখটা কঠিন হয়ে যায়। – জানবেন, সব জানবেন, এসেছেন যখন। মালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
- না। শুনেছি উনি এখানে নেই।
- কিছুদিন যাক। এখন বাইরে গেছেন আসলে দেখা হবে।
মুখটা কাছে এনে বলে – ভীষণ কৃপণ লোক মশায়। মাইনে বাড়াতেই চায়না। বলে হাসতে থাকেন – ঠাট্টা করছিলাম। কিন্তু দেখবেন এরা সব সময় আপনাকে ভয়ে আর টেনশনে রাখবে।
– কী রকম? অবাক হয়। – ভয় কেন? কীসের ভয়? অনির্বাণ কিছুটা আশ্চর্য হয়। মালিকের সঙ্গে দেখা হয়নি কিন্তু শুনেছে উনি তো ভালই লোক।
– দেখবেন দেখবেন। ড্রয়িং ছাড়ার তাড়া, এস্টিমেশনের তাড়া, ডিজাইন এর তাড়া, সবাই দেখবেন দৌড়াচ্ছে। না হলেই আর বছরে মাইনে বাড়বেনা। কেউ সব সময় আপনার কাজ খেয়াল করে যাচ্ছে। কেমন ভাবে করছে আপনি জানেন না। বাইরে থেকে অনেক কিছু মনে হয়।
অনির্বাণ অবাক হয় – তাই নাকি?
রাগ প্রকাশ করে ফ্যালেন – বুঝলেন, অনেকদিন তো আছি। আমাকে কেউ চিনল না। জানেন তো আপনাদের মালিক আমার মামা হন। উঠে পড়ে হাঁটতে থাকেন ঘরের মধ্যে। – এই মামাই আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আমার লাইফ বরবাদ করে দিল।
অনির্বাণ কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অভিক রায় একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। ভীষণ অস্থির। ঘরে চোখ বোলাতে বোলাতে অনির্বাণ দেখে ক্রিকেটের প্যাড, গ্লাভস পড়ে আছে। কথা ঘোরাবার জন্যে বলে – এগুলো এখানে? আপনি কি রেগুলার ক্রিকেট খেলেন?
অভিক ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসেন। একটা স্নেহের হাসি হাসে অভিক রায় – তাই মনে হচ্ছে বুঝি? ওটা হচ্ছে প্রোটেকশনের জন্যে। ক্রিকেটের জন্যে নয়।
- কী রকম?
- জানেন ত মানুষ যা কিছু কাজ করে তার পিছনে কোথাও না কোথাও একটা ভয় কাজ করে? স্রেফ ভয়ে মশাই, ভয়ে।
কাকে ভয়, কীসের ভয় অনির্বাণ বোঝেনা।
এবার রহস্য ভাঙেন – মোটর সাইকেল কিনেছি মশায় বাড়ি আসা যাওয়ার জন্যে।
- তার সঙ্গে ক্রিকেটের এগুলো? ঠিক বুঝতে পারলাম না।
- বোঝেন নি ত? বাড়িতে অফিসে সবাই বলেছে এতে খুব রিস্ক রাস্তাঘাটে। খুব অ্যাকসিডেন্ট হয়। ব্যাস ভেবে বার করে ফেললাম উপায়। আমাকে কাত করা অত সোজা নয়।
কে ওনাকে কাত করতে চায়? নতুন অফিসে এসে কি মুশকিল হল?
অনির্বাণ আস্তে করে জিজ্ঞাসা করে – কী রকম? কে কাত করবে আপনাকে?
- অনেক শত্রু মশাই। কাউকে বিশ্বাস করা মুশকিল। না, না, আপনাকে বলছি না। কী করেছি জানেন? বলুন দেখি?
- দেখুন আমি কেমন করে জানব। আপনিই বলুন।
সাদা খাতার পাতায় হিজিবিজি কাটতে কাটতে বলেন – হু! হু! একজন ড্রাইভার রেখেছি। সে চালায় আর আমি হেলমেট, প্যাড আর গ্লাভস পরে পিছনে। একদম নিশিন্ত। বলুন কেমন দিয়েছি? – মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন অভিক রায়। – কেন বলুন ত? সেই ভয়। অ্যাকসিডেন্টের ভয়। আঘাত লাগার ভয়। এখন আর আমার ভয় নেই। আয় কত অ্যাকসিডেন্ট হবি।
- আর আপনার ড্রাইভার কিছু লাগিয়ে দিলে?
- হেলমেট, প্যাড আর গ্লাভস এইগুলিই বাঁচিয়ে দেবে তখন।
অনির্বাণ চেয়ে থাকে লোকটাকে দেখেই ভয় লাগতে থাকে। একি স্বাভাবিক আচরণ? কে জানে? হঠাৎ মনে পড়ে ফ্লোর ম্যানেজার আসতে বলেছিল। উঠে পড়ে। – আজ আসি পরে দেখা হবে।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ আসুন। নিজেই উঠে এগিয়ে দেয়। পরে কথা হবে।
সময় যায়। আস্তে আস্তে অনির্বাণ বুঝতে পারে অভিক রায়কে। অফিসে কোন কাজই করেন না। সবাই মালিকের ভাগ্নে বলে একটু দূরে দূরে থাকে। কাজও দিতে চায়না। মাঝে মাঝে ওনার ডিপ্রেশন হয় তখন মানুষটা ভীষণ গম্ভীর হয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে কারণে অকারণে রেগে যান। আর রাগটা ওনার মামার ওপরই বেশি। কিন্তু সবাই বলে ওনার মামা ওনাকে আর ছোট বোনকে ভীষণই ভালবাসেন। এইরকম লোককে কে রাখবে? তাই উনি এখানেই এনে রেখেছেন নিজের চোখের সামনে। ডিপ্রেশনের সময় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। বেশি বাড়াবাড়ি হলে সামাল দিতে নাকি মামাই চেষ্টা করেন। কিন্তু মানুষটা অদ্ভুত। একটা অদ্ভুত জগতে থাকেন। অফিস এর লোকেরা বলাবলি করে অনির্বাণ কে অভিক রায়ের খুব পছন্দ।
অভিক রায়ের দৃষ্টি ঘোলাটে হলেই অনির্বাণের মুশকিল। যখন তখন নতুন নতুন বুদ্ধি নিয়ে হাজির হবেন। এই সেদিন, বস দিনের শুরুতে বলে গেছে আজ প্লান্ট রোডের ড্রয়িং ছাড়তেই হবে যে করেই হোক। সবে ড্রয়িং খুলে বসেছে অনির্বাণ, অনেক কিছু কাজ বাকি, কী করে যাবে আজ ড্রয়িং কে জানে? সামনে এ্যানুয়াল ইনক্রিমেন্ট, আজ ড্রয়িং না গেলে গেল সব মানসন্মান। মালিকের ভাগ্নে বলে কথা। তারপর আবার মানসিক দিকে মাঝে মাঝেই আবার গণ্ডগোলের। শুধু অনির্বাণকে উনি পছন্দ করেন বলে যত নতুন নতুন চিন্তা ভাবনাগুলো ওকেই বলেন। মাঝেমাঝে যখন উদ্বেলিত হয় মন, যখন মনে হয় ওনাকে কেউ চাইছে না; যখন ঘুম কম হয়, ঘুমের ওষুধ খেতে হয়, তখন মাঝে মাঝেই সামান্য কারণেই রেগে ওঠেন। অফিসের বেশিরভাগ লোকে তখন এড়িয়েই চলতে পছন্দ করে। ঠিক এমনি এক অভিশপ্ত দিনেই সকাল বেলা দরজা খুলে যায়।
- আসতে পারি? চেম্বারের দরজায় অভিক রায়ের হাসি হাসি মুখ।
- আসুন, আসুন। মনে ভয় ঘনাতে থাকে অনির্বাণের। আবার কি গল্প নিয়ে এল কে জানে।
- বুঝলেন? – বলে হাতের সিগারেট বাক্সটা টেবিলের ওপর রেখে অদ্ভুত ঘোলাটে দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর হেসে বললেন –কী ভাবে আসেন?
এই রহস্য বোঝা মুশকিল। – মানে? কোথায়? অফিস? বাসে।
অভিক মুচকি হাসে। – মাথায় একটা দারুণ প্ল্যান এসেছে। আপনাকে বলতে পারি যদি কথা দেন আপনি এখুনি কাউকে না বলবেন না। যদিও রিপোর্ট জমা হলে অবশ্য লোকে জানবেই।
অনির্বাণ বুঝতে পারেনা এবার আবার কি প্ল্যান নিয়ে এলেন।ডিপ্রেশনের রোগী, মাথায় নানা রকম উদ্ভাবনী প্ল্যান নিয়ে ঘোরেন। যারা চাকরি করে এখানে তাদের সময় করে ওনার কথা শুনতে হয়। না শুনলে চাকরির ভয়। উনি কিছু করেন না কিন্তু অন্যদের অফিসের কাজ ঠিক সময় না করলে বিপদ।
মুখে বলে – বলুন, বলুন। আমি আর কাকে বলব?
- এই ধরুন শহীদ মিনার, ওই ইন্সপিরেশন টাওয়ার, সাউথ-সিটি টাওয়ার, হাইল্যান্ড টাওয়ার, আরও আছে। এগুলোকে বুঝলেন শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকলেই তো হবে না।
- কী করতে চান? ছুঁড়ে দ্যায় অনির্বাণ।
এইবার খোলসা করে – এই যে আপনারা এত কষ্ট করে দক্ষিণ থেকে উত্তর যাতায়াত করেন, এর একটা সহজ সুন্দর উপায় বার করেছি বাস ট্রাম কে বাদ দিয়ে।
- সে কী ? চমৎকৃত অনির্বাণ নড়েচড়ে বসে। – শুনি শুনি।
- এই উঁচু উঁচু বাড়ীগুলো কে কাজে লাগিয়ে যাতায়াতের একটা আকাশপথ বার করেছি।
- বলেন কি মশায়? কী ভাবে?
- সে আবার কোন যান্ত্রিক সাহায্য ছাড়াই। এইটুকু বলেই কেমন দিয়েছি দেখ মতন একটা অপার্থিব দৃষ্টি মেলে ধরে আঙ্গুল দিয়ে টরেটক্কা করে টেবিল বাজাতে থাকেন অভিক রায়।
- বলেন কি? তাহলে এত তেল খরচা, এত পরিবেশ দূষণ, এমন কি এই ঝুলে ঝুলে বাসে ট্রামে যাওয়া সব শেষ?
- অফিস যাওয়াটা মশাই হবে কেবল্ কারে বেড়াতে যাওয়ার মত নির্মল বাতাস খেতে খেতে।
অনির্বাণ এবার আর থাকতে পারেনা। – রহস্য করবেন না মশাই। জানি আপনি অনেক কিছু ভাবতে পারেন যা আমরা পারিনা। তাই বলে এই রকম? করেছেন কি? করতে পারলে ত মশাই নোবেল আপনার পকেটে। এই শতকের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। শুনি শুনি খুলে বলুন দেখি।
মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন অভিক রায়। – একটা রিপোর্ট আকারে জমা দেব সরকারের ঘরে। তার আগে শুধু আপনাকেই বললাম।
- একটু খুলে।
- এই ধরুন কপিকল দেখেছেন? তেমনি আপনি শহরের বিভিন্ন উঁচু বাড়ীর ছাদে উঠবেন একটা বাকেটে করে আর উল্টো দিকে আরেক দিকে আরেকটা বাকেটে লোকে নামবে ছাদ থেকে মাটিতে। শুধু নামার দিকের বাকেটটা একটু বেশি ভারি হবে। নামার ওজনই নীচের বাকেট কে ওপরে ঠেলে তুলবে। বলুন বুদ্ধিটা কেমন?
- আর তারপর?
- এই ছাদ থেকে দুরের অন্য টাওয়ারের নিচে গিয়ে কেবল্ কার গিয়ে নামিয়ে লোক পৌঁছে দেবে উত্তর থেকে দক্ষিণে বাস। কোন মোটর নেই, কোন বিদ্যুতের ব্যবহার নেই, যান্ত্রিক সুবিধা শুধু দিয়ে যাতায়াত ওঠা পড়া।
অনির্বাণ রূপকথার জগতে পৌঁছে যায় বলে – তাহলে শুরুতে প্রথম বাকেট উঠবে কী করে?
- উঠবে, উঠবে বন্ধু। – মুচকি হেসে অভিক অনির্বাণের কাঁধে হাত রাখেন। – হয় কিছু লোক একবারের জন্যে লিফটে করে ওপরে গিয়ে চেন এর ওপরদিকে ওজন বাড়িয়ে নেমে আসবে আর অন্য দিকের বাকেটকে ওপরে তুলে দেবে আর সেখান থেকে নিজেদের ইচ্ছে মত দিকে কেবল কারে চড়ে চলে যেতে পারবেন। আমি দু একটা স্কেচও করেছি সুন্দর করে বোঝানোর জন্যে।
অনির্বাণ দুহাতে হাততালি দিয়ে ওঠে। – এত সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। তাহলে বাস ট্রাম ত রায়মশাই লাগবেই না। কি বলেন?
অভিক রায় – কিছুটা গম্ভীর হয়ে যান। ঠিকই বলেছেন। এরপর ভাবছি মাটিতে অনেক গাছপালা লাগিয়ে সবুজায়ন করে শহরটা বাঁচানোর চেষ্টা করব।
অনির্বাণ অভিক রায়ের বুদ্ধির তারিফ না করে পারেন না। আজকের দিনটা যখন গেছেই তখন একটু খুঁচিয়ে তোলে অভিক রায়কে। – চিড়িয়াখানার পশুদের তাহলে ময়দানের মাঠে ছেড়ে দিলে কেমন হয়? ওরাও হেসে খেলে চড়ে বেড়াতে পারে। আগামী প্রজন্ম জঙ্গল সাফারি করতে পারবে। আর কেবল কারে করে যেতে যেতে নীচে সব জীবজন্তু দেখতে দেখতে মানুষ যাবে। বলুন কেমন জমে যাবে?
অভিক রায় একটু সন্দিগ্ধ দৃষ্টি তে অনির্বাণ কে দেখেন। একটু গম্ভীর হয়ে যান। বলেন – বলছেন যখন ভেবে দেখি। সেরকম হলে দ্বিতীয় পর্যায় রিপোর্টে জমা দেবার সময় ভাবব। চলি বুঝলেন, আমার নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। মুখের সামনে পড়ে থাকা চুল গুলো আঙুল দিয়ে সরাতে সরাতে উঠে পড়েন আর বসেন না, অনির্বাণ ছাড়া পেয়ে ড্রয়িং দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
দুদিন অভিক রায়ের দেখা নেই অফিসে। আবার একদিন দরজা খুলে যায় – আসতে পারি? ঢুকেই চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকেন। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন – বলুন তো আপনার কখনো মনে হয়েছে আপনাকে কেউ অনুসরণ করছে?
- ড্রয়িং থেকে মাথা তুলে অনির্বাণ হাসে – না তো। সেরকম কোনদিন তো মনে হয়নি। কেন বলুন ত?
- আমার ত মনে হচ্ছে সব সময়ে।
ব্যাপারটা একটু গম্ভীর মনে হয়। – একটু খুলে বলবেন? কেউ কি আপনাকে ফলো করছে?
অভিক বলে – আমি কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় বলছি। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা। কিছুদিন যাবদ রাস্তায়, দোকানে বেরোলেই মাঝে মাঝে পিছন ঘুরে দেখি। মনে হয় সবসময় আমার কেউ পিছু নিয়েছে।
- আপনি তাকে দেখেছেন কখনো ?
- না।
- একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
- বলুন।
- কেন আপনাকে ফলো করবে কেউ? এটা ভেবেছেন কি? কী স্বার্থ তার?
চোখের কোনে কালি, ঘোলাটে চাহনি, একটা চাপা গর্ব মুখে। – এখনো বোঝেন নি? রিপোর্ট মশাই, ওটা হাতিয়ে নেবার জন্যে?
- কোন রিপোর্ট?
মাথা ঝাঁকাতে থাকে অভিক রায়। – ঈশ এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলবে? ওই যে বলেছিলাম আপনাকে আমার কলকাতার আগামী দিনের যানবাহন নিয়ে চিন্তাধারাটা? রোজ বাড়ী ফিরে আলমারি খুলে একবার দেখে নেই আছে কিনা? চুরি যাবার খুব সম্ভাবনা।
অনির্বাণ ভাবতে থাকে – সর্বনাশ! এবার বোধহয় অসুস্থতাটা বেশীই হয়েছে। ওকে কেন কেউ ফলো করবে?
- আর কয়েকদিন পরেই জমা দেব। মনে হয় আপনি ছাড়া আর কেউ ব্যাপারটা জানতে পেরেছে। আপনি কাউকে বলেছেন নাকি? ওটার জন্যে যে কেউ লড়ে যাবে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন অভিক রায়।
অনির্বাণের গলা শুকিয়ে আসে, তুতলে যায়। বলে – আমি তো কাউকে কিছু বলিনি। – কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঠাণ্ডা ঘরেও ভিতরের জামা ভিজে ওঠে।
কিছুটা সময়ের জন্যে চোখের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস এসেই আবার মিলিয়ে যায়। অভিক রায় গলা নামিয়ে মুখ এগিয়ে বলে – আপনিও সাবধানে থাকবেন। উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে ফিরে আসে। কাউকে বলবেন না। চারিদিকে খেয়াল রাখবেন। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখবেন। আমার ধারনা কারুর উপস্থিতি টের পাবেন।
আপাতত বাড়ি খালি। রাখী ওর মেয়ে ঝিনুক কে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। ড্রাইভারও দেশে গেছে। অফিস যেতে একটা উবের ডেকে নেয় অনির্বাণ। ওদের কাছে টাকা গচ্ছিত আছে পকেট থেকে টাকা দিতে হয়না। অফিসে এসে বাড়ির ট্যাক্স, মেয়ের স্কুলের এর ফিস, ইলেকট্রিক বিল দিয়েছে। প্রথম বেলা কেটে যায় শুধু মিটিং করে। দুপুরে অর্ডার করে খাবার আনিয়েছে। সন্ধ্যে বেলা বেরিয়ে প্রথমে রাখীর ওষুধ, তারপর মানস এর সঙ্গে দেখা কফি শপে বসে আড্ডা, তারপর উবের ডেকে বাড়ি ফিরে আসে। রাত্রে খেতে বসে মনে হয় দিনকাল কত এগিয়ে গেছে। আজকাল টাকা পয়সা না থাকলেও দিব্যি সারাদিনের কাজকর্ম করে বাড়ি ফিরে আসা যায়। যেমন আজ মানিব্যাগটা রাখতে গিয়ে মনে হল আজ পকেট থেকে কোন ক্যাশ দিতেই হয়নি।
রাখী ফোন করে – খেয়েছ? কোথায় কী রাখা আছে বলে দেয়। রাখী অন্য কথায় যায়। – অ্যাই শোন বাবা বলছে ব্যাঙ্কের সব পাসওয়ার্ড গুলো পালটে ফেলো।
চমকে ওঠে, সে কী? কেন? সেতো ভীষণ ব্যাপার। পরে করা যাবে এখন। তাড়া আছে কি? রাখীর বাবা পুলিশে চাকরি করেন। খবর রাখেন অনেক কিছু।
রাখী বলে – জান আজ আমাকে একটা অভূত ফোন এসেছিল। প্রথমে বলে সে ব্যাংক থেকে বলছে। তারপর বলছে আমাদের যে স্টেট-ব্যাংক এর এটি-এম কার্ড আছে সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওরা সেটা চালু করবে তাই পাসওয়ার্ডটা দিতে হবে।
- এ্যাঁ! তারপর তুমি কি বললে?
- আরে আমাদের তো স্টেট-ব্যাংকের এটি-এম কার্ডই নেই। যেই বললাম ওটা আমাদের নেই সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল। তাই বাবা বলছিল যেহেতু সব জয়েন্ট একাউন্ট তাই পালটে ফেলাই ভাল। আর জানি তো এরকম কিছু আজেবাজে লোক পাসওয়ার্ড জেনে টাকা তুলে নিচ্ছে।
অনির্বাণ একটু নিশিন্ত হয়। বলে – যাক বাঁচালে। এরপর এরকম ফোন এলে আমাকে ফোন করতে বোলো।
- বাবা বলছিল আমাদের সামনের দাসবাবুর এইভাবে অনেক টাকা মার গেছে। শেষে ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে বাঁচে।
– ঠিক আছে আমি ব্যাংকেরটা আমি আজই পালটে দেব। রাখীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে খেয়ে উঠে মোবাইলটা নিয়ে বসে। মেল-বক্সে দিকে তাকিয়ে দেখে অনেক প্রাইভেট মেল এসে রয়েছে। প্রথমটা উবেরের সকালে অফিস যাবার রসিদ, পরেরটা মেয়ের স্কুলের মাইনে জমা দেবার রসিদ, তারপর খাবারের, ওষুধের, কফির এবং আবার বাড়ি ফেরার উবেরের রসিদ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় তাহলে রসিদ গুলো থেকে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে সকালে কখন ও কোথায় কখন গেছে, কোথা থেকে কী খেয়েছে, কোথা থেকে ওষুধ কিনেছে, কী কিনেছে, কোথা থেকে কফি খেয়েছে, কখন বাড়ি ফিরেছে। তাহলে তো মোবাইল সার্ভারের ঘরে ওর সারাদিনের গতিবিধি লুকিয়ে আছে, ওর ব্যাংকের ডিটেইল লুকিয়ে আছে। বুকের মধ্যে হঠাৎ ঠাণ্ডা শিরশিরানি অনুভব হয়। এরপর মনের অন্য দরজা খুলে যায় তাহলে তো ওর ব্যাংক একাউন্টও কারুর কাছে খোলা খাতার মত। যে ওর এক নবের আঁচড়ে টাকা এখান থেকে ওখানে পাঠিয়ে দিচ্ছে সে নিশ্চয় ওর জমানো টাকার ফিক্সড ডিপোজিট আর মিউচুয়াল ফান্ডের সব হদিস জানে। জানবে ত বটেই, মনে পড়ে মিউচুয়াল ফান্ডের মাসিক জমানো তো ওর অজান্তেই কেটে নেয় ব্যাঙ্ক। ব্যাংক থেকে সার্ভার হয়ে তার কাছে মেসেজ আসে। অনেকেই তার একাউন্ট দেখতে পায়। তাহলে যে কোনো দিন একাউন্ট খালি হয়ে গেলে কাকে ধরবে অনির্বাণ?
গলা শুকিয়ে আসে। ঠাণ্ডা ঘরের মধ্যেই কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। অনেকদিন থেকেই তো এই ভাবে চলছে। কোনদিন তো এমন করে মনে হয়নি। খালি বাড়িতে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগতে থাকে। এদিক ওদিক অনির্বাণ তাকাতে থাকে। পাশের ঘরে মনে হয় কেউ ঘোরাঘুরি করছে। তাহলে তো ওর চলাফেরা, কেনা কাটা, খাওয়াদাওয়া, সবই কারুর নজরে এর মধ্যে আছে? কে সে? যে সব দেখছে দূর থেকে মেঘনাদের মত!
অভিক রায়ের কথা মনে পরে যায়। কেউ আপনাকে ফলো করছে। যার হাত থেকে আমাদের মুক্তি নেই। লুকোবার কিছু নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে, বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অনির্বাণ জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। মনে হতে থাকে দূরে ফুটপাতে কেউ যেন দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে।
কল্যান সেনগুপ্ত