মোবাইলে রিংটোন।
(হাঁপাতে হাঁপাতে) শুচিস্মিতা: কেএএএএ– মা? কী করছিলাম? আর বল কেন? এই সাত সকালে কত্থক নৃত্য প্রাকটিস্ করছিলাম। নাহ্, একটুও ফাজলামো নয় গো মা। এখানে সবাই সব সময় সিরিয়াস। আমি যদি ফাজলামো করি তবে হয় আমার দীপান্তর….আরে না না… দীপান্তর হলে এই সাত সকালে ছেলেকে রেডি করে খাইয়ে দাইয়ে টিফিনবক্সে টিফিন ভরে টানতে টানতে কে নিয়ে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে আসবে? তারপর এসেই দম ফেলারও ফুরসৎ হবে না। তোমার সোহাগের জামাইয়ের অফিস যাওয়ার স্যুট-বুট-টাই, ভাত, টিফিন ঠিক সময় যোগান দেবার খিদমদ কে করবে মা? তারপর শাশুড়িমাতার এ হুকুম, সে হুকুম। অতএব সারা সকালটাই আমার কত্থক প্রাকটিস চলে গো মা।
ও’রম বলছি কেন? জানি তো তুমি খুব খুশি হবে নিজের মেয়ে এত পারফেক্ট এত কর্তব্যপরায়ণ এত কাজের হয়ে উঠেছে জেনে। এটাই তো তুমি চেয়েছিলে মা। তোমার তো গর্ব হবার কথা। কারণ কুটুমস্বজন আত্মীয় পরিজন একবাক্যে তোমার এ্যাকাউন্টে এর পুরো ক্রেডিট ডাউনলোড করে দিচ্ছে। সবার মুখে এক কথা, “এই হল মায়ের শিক্ষা। কী সুন্দর তৈরি করেছে মেয়েকে।”
আজ আমি মিলিয়ে নিচ্ছি মা, কেন বিয়ের পরের দিন বিদায় লগ্নে বার বার করে বলেছ, “দেখিস শ্বশুরবাড়িতে যেন আমার মুখ পোড়াস না।” শুধু তাই নয়, সেদিন আমার সদ্য গজিয়ে ওঠা সমাজ নির্দেশিত গার্জিয়ান অর্থাৎ আমার নব্য পতিদেবতার দুটো হাত ধরে কী করুণ আকুতি জানিয়েছিলে – তোমার মেয়ের ভুলত্রুটি যেন শুধরে ক্ষমাঘেন্না করে দেয়। আমি তখন বিহ্বল হয়ে শুনছিলাম কথাগুলি। তাহলে কী দাঁড়াল মা? এক শাসনের গন্ডি থেকে বেরিয়ে আরেক শাসনের খাঁচায় ঢুকে পরার পরোয়ানা ধরিয়েছিলে তো? জীবন মানে মুক্তি নয়, একের পরে আর এক অবরুদ্ধতা ! শাসন থেকে শোষণে।
আঃ মা, তুমি খেপে যাচ্ছ কেন? জানি জানি তোমার জামাই অমন অমানুষ নয় যে আমায় তথাকথিত শোষন করে। একেবারেই তা নয়। কিন্তু আমার চরিত্রের সুকোমল বৃত্তিগুলি, ছোট ছোট সুখানুভূতিগুলি সব আজ কেন মরে গেছে মা? ওরা তো অঙ্কুরিত হবার পথই পেল না। কখনও কাজ করতে করতে ‘ফুলের জলসায়…..’ গুনগুনিয়ে উঠলে এরা বলে, “গান! আঃ, এলেন যেন সুচিত্রা মিত্র।” কাজের ফাঁকে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে দেখলে এরা বলাবলি করে “শিক্ষিত বউ তার শিক্ষা ফলাচ্ছে”। অথচ ঈশ্বরের অসীম দয়ায় আমার এই অমূল্য মানব জনম। মুক্ত জীবন আমারও প্রাপ্য ছিল! আমাকে কেন্দ্র করে তোমাদের পসরা সেজে উঠল। নাম যশ খ্যাতি প্রাপ্তির পসরা। বেশ বেশ।
আচ্ছা মা, কখনও তুমি আমার কথা ভেবেছিলে? সত্যি করে বলতো আমি কি কেবল তোমার মেয়ে আর তোমার জামাইয়ের স্ত্রী? ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমার কোন পৃথক অস্তিত্ব নেই? কেবল সর্বদা তোমাদের গর্বিত করার সামগ্রী আমি? এই বিশ্বে আমার নিজের, একান্ত নিজস্ব কোন আইডেনটিটি নেই? আমার মনের ভিতর একটা আকাশ আছে। সেখানে ইচ্ছেগুলো ডানা ঝাপটায়। তুমি কি জান সকালে ঘুম ভেঙে আমার এক কাপ গরম চা খেতে খেতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ইচ্ছে করে। কী ভীষণ ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে গাইতে– ‘আমি অকৃতি অধম বলেও তো মোরে কম করে কিছু দাওনি’। (সুর লাগিয়ে)
শ্বশুরবাড়িতে সঠিক সময়ে সবাইকে সঠিক জিনিসটি সাপ্লাই দিতে না পারলে মনে হয় এই বুঝি আমাকে ফাঁসির কাঠগড়ায় তোলা হবে। এই বুঝি তোমাকে নালিশ জানাবে অথবা বলবে, ‘বাপের বাড়ি থেকে কিছুই শিখে আসনি?’ পরে পরে বুঝেছি ফাঁসিতে ওরা চড়াবে না। কারণ তাহলে ওদের গ্রেট লস্। এই যে ওরা বসে খাচ্ছে সবাই, সেটা তো আর হবে না।
কী বলছ, কী? শোনা যাচ্ছে না। আর বল কেন? টাওয়ার ফেলইওর….হ্যাঁ হ্যাঁ….পাচ্ছি পাচ্ছি…. এবার….বল কী বলছিলে? কী? মুখে মুখে কথা বলব না। সবসময় নরম হয়ে থাকব? হা হা হা…তাইতো আছি মা। তোমার সুনাম, ভালো মা হওয়ার খ্যাতি আমি অক্ষুণ্ণ রাখব তা আমার যত কষ্টই হোক। (কান্নাভেজা কন্ঠস্বর)
মা, তোমার সারেন্ডারিং এ্যাটিটিউড আমার গলায় ফাঁস হয়ে সেঁটে আছে। কেন তুমি এত ভয় পাও মা? আমার মনে আছে ছোটবেলায় আমার গানের মাস্টার আমাকে গান শিখিয়ে চলে গেলে পড়ে থাকা হারমোনিয়ামটার দিকে তুমি কেমন ফ্যালফ্যাল করে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকতে। সুপ্রভা সরকারের কাছে বিয়ের আগে তুমি নজরুলগীতির তালিম নিতে। সেকথা বাবা থেকে আরম্ভ করে সবাই জানত। কিন্তু কখনও তোমার জন্যে হারমোনিয়াম বেরুত না। একদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে পাশে তোমাকে না পেয়ে চারিদিক তাকিয়ে দেখি তুমি একা জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছ দূরে, আকাশ পানে চেয়ে। আমি ছুট্টে গিয়ে তোমার আঁচল টানতে তোমার সম্বিত ফিরেছিল। তুমি আকাশের শেষরাতের মরা চাঁদটাকে দেখিয়ে বলেছিলে, “দ্যাখ দ্যাখ খুকু, কালো মেঘ এসে কেমন জ্যোৎস্না ঢেকে দিল।” ঘুম চোখে শোনা তোমার ওই কথা তখন কি আর বুঝেছি? যত বড় হয়েছি তত ও কথার তাৎপর্য বুঝেছি। কালো মেঘেরা অমনি হয়।
আচ্ছা মা, আমার কাঁচের চুড়িগুলি সব গুছোনো আছে ঠিক যেমনটি রেখে এসেছি? সরি মা। আমি তো গুছোতাম না। আমি এলোমেলো করে রাখতাম সব। আমার কানের দুল পায়ের নূপুর কোথায় যে কখন পড়ে থাকত তার ঠিক নেই। তুমি গজ্ গজ্ করতে করতে আবার সব ঠিকঠাক করে রাখতে। হি হি। আমি তখন কখনও এক কোঁচড় টাটকা ফুল আবার কখনও বা ঝড়ে কুড়িয়ে পাওয়া আমগুলি দেখিয়ে তোমাকে ভোলাতাম। তুমিও ভুলতে। কারণ ছোটবেলা তুমিও ঝড় থামলেই আমবাগানে ছুট্টে চলে যেতে আম কুড়োতে। তুমিই তো বলেছিলে সেকথা।
আচ্ছা মা সেই কোঁকড়া ঝাঁকা চুলের ফুচকাওয়ালা ছেলেটা এখনো বসে মোড়ের মাথায়? ফুচকা খেতে গিয়ে বন্ধুরা মিলে ওকে কত না নাকানি চোবানি খাওয়াতাম। কাউন্টিং এ বারবার গুলিয়ে দিতাম। ও যত বলতো তিনটে করে হয়ে গেল — আমরা সমস্বরে বলতাম, এ্যাই তুই একদম ভুলভাল গুণবি না। এই সবে দুটো করে হল। পরে আবার ফাউ দে ফাউ দে করে ওর মাথা খারাপ করে দিতাম। তুমি মাঝে মাঝে ওর হাতে অকারণ টাকা গুঁজে দিয়ে ওর লোকসান পুষিয়ে দিতে। মেয়ে আর তার বন্ধুদের এরকম ছেলেমানুষী বাঁদরামোয় কী সুন্দর প্রশ্রয় ছিল তোমার। অন্যসময় মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাতে, ওরকম কি করতে আছে? ও কত গরীব।
কে বলেছিল তোমায় এত আহ্লাদ দিতে? জান, মেয়েদের অত আহ্লাদ দিতে নেই। বলতো মা, অত আদর দিয়ে কেন বড় করেছ? ছোট থেকেই বড় মাছের মুড়ো সব সময় আমার। কোথাও বাসে করে বেড়াতে গেলে জানালার ধারে আমিই বসব। এত প্রশ্রয় পেতাম। এই নিয়ে দাদাও আমার সঙ্গে পেরে উঠত না। সুযোগ পেলেই এক রাম চিমটি কাটত আমাকে। আমি তারস্বরে কেঁদে উঠতাম। যতক্ষণ না ওকে সবাই বকছে ততক্ষণ আমি থামতামই না। তারপরই সবার আড়ালে খোশমেজাজে হাত তালি দিয়ে ওকে খেপাতাম, বেশ হয়েছে বেশ হয়েছে, কেমন বকা খওয়ালাম। আর কাটবি চিমটি? ও সে সব হজম করে নিত। আমাকে ও কী ভালোই বাসতো। বলির আগে পাঁঠাকে যেমন স্নান করিয়ে তেল সিঁদূর মাখায় আমাকে তোমাদের আহ্লাদ দেবার বহর ছিল অনেকটা সের’ম।
হ্যাঁ হ্যাঁ মা, এরা আমায় খেতে পরতে দেয়। ও নিয়ে তুমি ভেব না। কথা? হ্যাঁ সবাই আমার সঙ্গে কথাও বলে। চা দাও, জল দাও, ভাত বাড়ো – এগুলো কি কথা নয়? বলে তো, সবাই বলে এর’ম কথা। জানো মা, সেদিন আমার পুঁচকে ছেলেটা, তোমার আদরের নাতি নীল গো — খাবার টেবিলে এসে বসেই বলছে, “ কী যে কর না বুঝি না। ভাত বাড়তে এত দেরি!” সত্যি বলছি মা, সেদিন আমার মন ভরে গেছিল। বাপের সুপুত্তুর চোখের সামনে বড় হতে দেখব একটু একটু করে। একি আমার কম প্রাপ্তি বল? কী আনন্দ আমার!ঠিক তিন দিন আগে, মাথায় কী ভূত চাপল কে জানে। শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “মা আজ তুমি আমায় ভাত বেড়ে দেবে। আজ আমার নিয়ে খেতে ইচ্ছেই করছে না।” আসলে সেদিন আমার খুব তোমাকে মনে পড়ছিল যে মা । তাই তো অমন বললুম। কী কান্ডই না ঘটল তারপর। উনি বললেন, “আমি কি তোমার দাসীবাঁদী? কোন লাটের বেটি এলে শুনি।” রাতে তার ছেলে অফিস থেকে এলে উনি কেঁদে পড়লেন। বললেন, “বাবা, আমাকে দুটো খাওয়াস তাই এই লাঞ্ছনা?” সব শুনেটুনে উনি আমাকে বললেন, “ন্যাকামো। বয়সটা কি কমছে দিন দিন?”
সেদিন আমি সত্যি বড় হলাম। তুমি বিশ্বাস করো মা, তারপর থেকে আর একদিনও আমি কোনো ন্যাকামো করি না। আজকাল আমি এখানে ভালই আছি। খুব ভাল আছি। শার্সি ঘেরা জানালায় রোদ এসে ধাক্কা খায়। বাতাস মাথা কুটে ফিরে যায়। ওরা আমাকে ছুঁতে পায় না। মাগো, আমার শিশুবেলা আমার কিশোরবেলা আমার এক্কাদোক্কা আমার পুতুল পুতুল খেলা সব ছাড়িয়ে আমি এখন বড় — মস্ত বড় হয়ে গেছি মা । আমি তোমার গড়া পুতুল সেজে বেশ আছি। কলের পুতুল। তুমি আমার জন্যে ভেব না। একদম ভেবো না।।
স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়