চারণকবি মুকুন্দদাস

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশের মানুষকে একসূত্রে গাঁথতে, দেশের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালাতে ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার প্রেরণা জোগাতে যেসব চারণ কবিরা গান গেয়ে ও যাত্রাভিনয় করে স্থানে স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন তাঁদের মধ্যে প্রথমেই যাঁর নাম স্মরণে আসে তিনি হলেন মুকুন্দ দাস।
অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার বানরী গ্রামে ১৮৭৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুকুন্দ দাস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গুরুদয়াল দে এবং মাতার নাম শ্যামাসুন্দরী দেবী। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর দে এবং ডাক নাম ছিল যজ্ঞা। তাঁর যখন সাত বছর বয়স তাঁরা সপরিবারে বরিশালে চলে আসেন।
বরিশালে এসে এখানকার বরিশা জেলা স্কুল ও পরে অশ্বিনীকুমার দত্তের প্রতিষ্ঠিত বি এম স্কুলে (ব্রজমোহন বিদ্যালয়) ভর্তি হন। ভর্তি তো হলেন কিন্তু পড়াশুনায় তাঁর কিছুতেই মন লাগত না৷ কিশোর যজ্ঞেশ্বর স্বভাবে অত্যন্ত দুরন্ত ছিলেন। মাছ ধরা, প্রতিবেশী সমবয়সীদের সাথে সারাদিন হৈ হৈ করে ঘুরে বেড়ানো এই সব নিয়েই তাঁর সারাদিন কাটত। কিন্তু এই যজ্ঞেশ্বরের স্বভাবে আমূল পরিবর্তন আসে তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট বিটসন্ বেল সাহেবের সংস্পর্শে। অষ্টম শ্রেণীর পর যজ্ঞেশ্বর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে যোগদান করেন বীরেশ্বর দত্তের কীর্তন দলে৷
বীরেশ্বর দত্ত ছিলেন তৎকালীন বরিশালের খ্যাতনামা কীর্তনীয়া৷ বীরেশ্বর দত্তের মৃত্যুর পর যজ্ঞেশ্বর নিজের কীর্তন দল গঠন করেন। যজ্ঞেশ্বরের লেখাপড়ায় মতি না থাকলেও গানের গলা ছিল অসাধারণ। বরিশালে থাকাকালীন একদা বৈষ্ণব সন্ন্যাসী রসনন্দ ঠাকুর যজ্ঞেশ্বরের গলায় হরিসংকীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হয়ে যান৷ যজ্ঞেশ্বরে গুণমুগ্ধ রসনন্দ তাঁকে দীক্ষা দিয়ে তাঁর নাম রাখেন মুকুন্দ দাস। সঙ্গীত চর্চা তাঁকে ক্রমশই সমৃদ্ধ করতে থাকে। মাত্র উনিশ বছর বয়সে মুকুন্দ দাস ‘সাধন-সঙ্গীত’ নামে একশখানি গান সমৃদ্ধ একটি বই লেখেন। তিনি ‘বরিশাল হিতৈষী’ পত্রিকায়তেও লিখতেন।
যজ্ঞেশ্বর অশ্বিনীকুমার দত্তের মন্ত্র শিষ্য ছিলেন। অশ্বিনীকুমার দত্তের সংস্পর্শে এসে মুকুন্দ দাস রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তাঁর আগ্রহে মুকুন্দ দাস ‘মাতৃপূজা’ নামে একটি নাটক রচনা করেন। এই নাটকের প্রথম প্রকাশ্য যাত্রাভিনয় হয় দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীতে নবগ্রামে । ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় মুকুন্দ দাস একের পর এক গান, কবিতা ও নাটক রচনা করে বাঙালীর জাতীয় জীবনে স্বদেশপ্রেম সঞ্চার করেন। বরিশালের বিভিন্ন স্থান, নোয়াখালী, ত্রিপুরাতেও তিনি দেশাত্মবোধক নাটক মঞ্চস্থ করে আসেন। তাঁর ক্রমবর্ধমান স্বদেশী নাটক ও জনমানসে তার বিপুল প্রভাব ব্রিটিশ সরকারের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাজদ্রোহের অপরাধে তাঁকে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ সরকার। বিচারে তাঁকে তিন বছর সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয় এবং ‘মাতৃপূজা’ নাটকটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে । কাজী নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ চারণ কবি মুকুন্দ দাসকে যথাক্রমে ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে’ ও ‘চারন-সম্রাট মুকুন্দ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে তিনি অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে নাটক প্রদর্শন করেন৷ ১৯২১ সালে (১৩২৮ বঙ্গাব্দে) মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনে বিদেশী পণ্য বর্জনের মন্ত্রে বাঁধলেন একের পর এক গান যার মধ্যে কালজয়ী গান ‘ছেড়ে দেও কাঁচের চুড়ি বঙ্গনারী’ চিরস্মরণীয়। ১৯২৩ সালের কাছাকাছি সময়ে তাঁর ‘মাতৃপূজা’ নাটকটি ব্রিটিশ সরকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মুকুন্দ দাস কিন্তু এতে ভেঙে পড়েননি। তিনি সামাজিক ও দেশাত্মবোধক নাটক রচনা করতে থাকেন। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার উদ্যোগী হয়ে তাঁর সমস্ত নাটক নিষিদ্ধ করে দেয়।

মুকুন্দ দাস যে সমস্ত গান, নাটক রচনা করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মাতৃপূজা’, ‘সমাজ’, ‘আদর্শ’, ‘পল্লীসেবা’, ‘সাথী’, ‘কর্মক্ষেত্র’, ‘ব্রহ্মচারিণী’, ‘পথ’ ইত্যাদি ৷
ব্রিটিশ সরকার তাঁর সমস্ত নাটক নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে মুকুন্দ দাস কেবল গানের উপর নজর দেন৷ চারণ কবি মুকুন্দ দাস গানের মাধ্যমে তাঁর কাজ করে যেতে থাকেন৷ ১৯৩৪ সালের ১৮ মে একটি গানের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে গভীর নিদ্রার মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.