এক ভয়াবহ সংকট এবং বিপদের ভিতর দিয়ে এখন সমগ্র মানব সমাজ চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্বব্যাপী এই ভয়াবহতার মুখোমুখি মানব সমাজকে হতে হয়নি। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশ থেকে প্রাচ্যের উন্নয়নশীল দেশ-এই সংকট সকলকেই দিশাহারা করেছে। এবং যা আরো বেশি করে ভাবিত করে তুলেছে সকলকে, তা হল এই সংকট থেকে মুক্তির উপায়টি কী? বলতে গেলে এবার মানব সমাজকে অজানা অচেনা এক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ পরস্পর পরস্পরকে চিনত। এবার প্রতিপক্ষটিকেই চেনা যাচ্ছে না। যে বা যারা করোনা নামক এই মারণ ভাইরাসটি আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞানের অপব্যবহার ঘটিয়ে, তারা কার্যত সমগ্র মানব সমাজের বিরুদ্ধে এক বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার ঘোষণা করেছে। কাদের অবিমৃষ্যকারিতা মানব সমাজকে এই সংকটের মুখে ঠেলে দিল-ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই তার বিচার করবে এবং সেদিন ন্যায়ের দণ্ড নেমে আসবে তাদের ওপর। তার আগে আমাদের ভাবতে হবে এই সংকটের সময় আমাদের অর্থাৎ নাগরিক সমাজের কর্তব্যটি ঠিক কী? কোন পথে আমরা চলব? রাষ্ট্রের জন্য দেশের জন্য কোন কাজটি আমরা করব? সংকটকে কোন পথে জয় করব আমরা? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়/ দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা/ দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।’ বিপদ অবশ্যই আমাদের গৃহে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু এই বিপদে যদি শুধুই ভীত এবং সন্ত্রস্ত হয়ে থাকি, যদি ভয় এবং শোক আমাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে, তবে সে বিপদ থেকে উত্তরণের পথ কোথায় খুঁজে পাব? রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঈশ্বরের কাছে বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রার্থনা করেননি। বরং প্রার্থনা করেছেন বিপদ যেন ভীত করে না তোলে তাঁকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মুক্ত করো ভয়, আপন মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়।’ ভয়মুক্ত এক চিত্তের কথাই বলেছেন কবি।
বাংলা ১৪২৭ এর প্রথম বছরটিতে অবশ্যই আমাদের কিছু সংকল্প এবার গ্রহণ করতে হবে। প্রথম সংকল্পটি অবশ্যই ভয়কে জয় করার সংকল্প। ভয়কে কীভাবে দুর্জয় সাহসের সঙ্গে জয় করতে হয়, তার নিদর্শন বহু আগেই রেখে গিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯৮ এবং ১৮৯৯- পরপর এই দুবছর কলকাতা শহরে প্লেগের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের সময় স্বামীজীর নির্দেশে ভগিনী নিবেদিতার নেতৃত্বে রামকৃষ্ণ মিশন যেভাবে সেবা ও ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল-তা ভয়কে জয় করার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবেই ইতিহাসে লেখা থাকবে। ১৮৯৮ সালে প্লেগের ত্রাণ ও সেবাকার্যে যখন অর্থের অভাব দেখা গিয়েছিল তখন এমনকি বেলুড় মঠের ভূমি বেচে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন স্বামীজী। ১৮৯৮ থেকে ১৮৯৯ সালে প্লেগ আরো ভয়াবহ আকার নেয় কলকাতায়। স্বামীজী সেবার তাঁর আমেরিকা যাত্রা বাতিল করে কলকাতায় থেকে গিয়েছিলেন। স্বামীজীর নির্দেশে রামকৃষ্ণ মিশন প্লেগ মোকাবিলায় একটি কমিটি গঠন করেছিল। নিবেদিতা এবং স্বামী সদানন্দের নেতৃত্বে ত্রাণ এবং সেবকার্য সংঘটিত হয়েছিল। সে সময় দলে দলে মানুষ কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছিলেন। এমনকী কলকাতার সম্ভ্রান্ত পরিবাররাও কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। নিবেদিতার শুভানুধ্যায়ীরা নিবেদিতাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু যাননি নিবেদিতা। স্বামীজীর নির্দেশে ভয়কে জয় করে আর্ত এবং পীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সেদিন।
এই প্লেগের সেবাকার্যের ভিতর দিয়েই আরো একটি কাজ সম্পাদন করেছিলেন স্বামীজী। স্বামীজীর নির্দেশে ১৮৯৯ সালে কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে ‘প্লেগ এবং ছাত্রসমাজ’ বিষয়ক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এই সময় স্বামীজী এবং নিবেদিতা উভয়েই বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য তরুণ সমাজকে যথেষ্ট উদ্দীপিত করে এবং ছাত্র যুবকরা প্লেগের ত্রাণ এবং সেবাকার্যে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসে। দেশের কাজে ছাত্র এবং যুবসমাজকে এভাবে একাত্ম করে তোলায় স্বামীজীর উদ্দেশ্য ছিল একটিই। তা হল- ভারতবর্ষকে একটি নেশন হিসেবে গড়ে তোলা।
এখন প্রশ্ন হল, নেশনের সংজ্ঞাটি কী? লেখন বলতে আমরা ঠিক কী বুঝব? এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ খুব সুন্দর বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের কথায়, নেশন অর্থে একটুকরো মানচিত্র নয়। কিছু পাহাড়, পর্বত, নদী, অরণ্য বা জনপদের সমাহারও নয়। নেশন অর্থে সচেতন, কর্তব্যপরায়ণ, নিষ্ঠাবান নাগরিক সমাজ যারা আত্মস্বার্থের পরিবর্তে দেশের স্বার্থকে, দশের স্বার্থকে প্রধান বলে বিবেচনা করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি সহ সমগ্র ইয়োরোপ নেশনের পরিচয় দিয়েছে। এমনকী ইজরায়েলও দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে নেশন গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু আমরা? স্বাধীনতার পর সাতটি দশক পার হয়ে গেছে। আমরা কি পেরেছি ভারতবর্ষকে একটি প্রকৃত নেশন হিসেবে গড়ে তুলতে? বলতে দুঃখ হয়, কিন্তু এটাই বাস্তব যে ভারতকে প্রকৃত নেশন হিসেবে গড়ে তুলতে বাধা এসেছে আমাদের ঘরের ভিতর থেকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সমস্ত কালোবাজারিকে তিনি ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাবেন। সে প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করতে পারেননি। বরং যত দিন গেল, দেখা গেল, দেশ বা দশের স্বার্থ অপেক্ষা আত্মস্বার্থই আমাদের কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়ালো। নেশন গড়ার ইচ্ছাটিকে দূরে ঠেলে সরিয়ে রেখে আমরা তোষণের এবং স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতিতে মনোনিবেশ করলাম। ভারতের ঐতিহ্য এবং পরস্পরকে অগ্রাহ্য করে আওয়াজ উঠল- ‘ভারত তেরি টুকরে হোগি।’ ভারত মাতার নামে জয়ধ্বনি দেবার বদলে একদল গুরুর নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি দেওয়া শুরু হল। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের ঘরের ভিতর থেকেই নেশন গড়ার প্রক্রিয়ায় অন্তরায় সৃষ্টি করা শুরু হল।
আজ যখন এখন ভয়াবহ সংকট এবং বিপদের ভিতর দিয়ে ভারতকেও যেতে হচ্ছে, তখনো দেখা গেল, এই সংকটের মুহূর্তে ভারতকে নেশন হিসেবে গড়ে তোলায় কারো কারো যথেষ্ট অনীহা। মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন যে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করার আহ্বান যখন দেন প্রধানমন্ত্রী, তখন আমাদের এই দেশে অন্নে-জলে প্রতিপালিত হয়ে ওঠা একটি শ্রেণী তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপে বিদ্ধ করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পারস্পরিক সংহতি এবং ঐক্যবদ্ধতা যখন প্রকাশ করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী, তার বিরোধিতা করতেও সচেষ্ট হয়ে ওঠে এরা। নির্লজ্জ তোষণের রাজনীতির কারণে সরকারের সমস্তরকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়ার প্রয়াসও এই সংকটের সময় প্রকট হয়ে ওঠে। নেশন হিসাবে ভারতবর্ষকে গড়ে তোলার পথে এগুলিই আমাদের সবথেকে বড় অন্তরায়।
তবু পুরোটাই অন্ধকার নয়। ভারতের আকাশে এখন রূপালী আলোর রেখাও দেখা যাচ্ছে। বিরোধিতাকে উপেক্ষা করেই দেশের গরিষ্ঠ অংশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর আবেদনে সাড়া দিয়ে এই যুদ্ধে সংহতি এবং ঐক্যবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছে। নেশন হিসেবে ভারতকে গড়ে তোলার এটিই হয়তো আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সংকট এবং বিপদকে তুচ্ছ করে নেশন হিসাবে ভারতবর্ষকে গড়ে তুলবই-এই হোক এই নববর্ষে আমাদের সংকল্প।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত