অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ

অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ (১৮৭৭- ১০ই এপ্রিল, ১৯৪০) বাঙালি সম্পাদক, শিক্ষক ও পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। তার পৈতৃক পদবী ঘোষ হলেও কাশীতে সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করে ‘বিদ্যাভূষণ’ উপাধি লাভ করেন। তিনি দেশী বিদেশী মোট ২৬টি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন।
অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ ‘ভারতবর্ষ’ মাসিক পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক সহ ‘বাণী’, ‘ইন্ডিয়ান একাডেমি’, ‘পঞ্চপুষ্প’ প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও ‘বিশ্বকোষ’-এর ২য় সংস্করণের ১ম ও ২য় খন্ড সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি বিডন স্ট্রিটের নামী ঘোষ পরিবারের (আদতে ঘোষ মজুমদার বাড়ির) ছেলে। তবে এও তেমন প্রচারিত নয়। কলকাতা-জীবনের আদ্যযুগে তিনি বিডন স্ট্রিটের ৫২/২ নম্বরের বাসিন্দা হলেও, বহু বার ঠিকানা বদল করেছেন। তাঁর বাবা উদয়চন্দ্র ঘোষ মজুমদার আদতে এখনকার উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটির বাসিন্দা ছিলেন। মা যাদুমণি দেবীর তিনি দ্বিতীয় পুত্র, আগে-পিছে দুই ভাই চণ্ডীচরণ ও বীরেন্দ্রনাথ, সহোদরার সংখ্যা তিন। অমূল্যচরণের জন্ম ওই বিডন স্ট্রিটের ঠিকানাতেই, পড়াশোনার শুরু কেশব অ্যাকাডেমিতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৮৮ সালের প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন এই স্কুল থেকেই, পাশ করেন দ্বিতীয় বিভাগে। সিলেবাসের পড়াশোনা তাঁর ভাল লাগত না, বাইরের বই-ই বেশি পড়তেন। স্কুলে পড়ার সময়েই তাঁর চৈতন্য লাইব্রেরির বেশির ভাগ বই পড়া শেষ হয়ে গিয়েছিল।

বিদ্যালয় শেষে কলেজে। পাশের পাড়াতেই এখনকার স্কটিশ চার্চ কলেজ, তখন নাম ছিল জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ় ইনস্টিটিউশন। ভর্তি হলেন এফএ ক্লাসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেন্ট জ়েভিয়ার্সে ভর্তি হয়েছিলেন, ছেলে হিসেবে নিন্দের ছিলেন না, তবু কলেজের ডিগ্রি পাননি, কারণ ওই বাইরের লেখাপড়ার টান! আঠেরো বছর বয়সে অমূল্যচরণও পড়াশোনা নিয়ে এমন কাণ্ড করে বসলেন যে পড়াশোনা শিকেয় উঠল। চৈতন্য লাইব্রেরির প্রায় সব বই যাঁর পড়া, তাঁর যদি শিরঃপীড়া না হয় তো কার হবে! অক্ষয়কুমার দত্ত— বিদ্যাসাগরের বয়সি— তাঁরও তো ওই রোগ, পড়াশোনা। তবে তাঁর একটা মজা ছিল। মাথাব্যথা যত বাড়ে, পড়াশোনার বহরও সেই অনুপাতে বেড়ে যেত।

মাসকয়েক পরে বাঁধাধরা বিদ্যাচর্চায় ইতি। অমূল্যচরণ বরং সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য ভাল ভাবে রপ্ত করার জন্য কাশী চলে গেলেন। সেখানে কাশী-নরেশের চতুষ্পাঠীতে পড়ে, তাঁর বিখ্যাত উপাধিটি অর্জন করলেন, হয়ে উঠলেন ‘বিদ্যাভূষণ মশাই’। কলকাতায় ফিরে এলেন জ্ঞানের খিদে বহু পরিমাণে বাড়িয়ে। একের পর এক ভাষা শিখতে লাগলেন। শুধু কি শেখা? শেখাতেও লাগলেন। বাড়িতে শেখান, শেখানোর জন্য ইস্কুলও করেন। সাধারণ ছেলেদের মধ্যে থেকে বাছাই করে এক অসাধারণ স্কুল— ভাষা শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল। আরও জানতে-চিনতে এবং কাজে লাগাতে চান যাঁরা, তাঁদের জন্য খুললেন কলকাতায় প্রথম অনুবাদের স্কুল— ‘ট্রানস্লেটিং ব্যুরো’— ১৮৯৭ সালে। তাঁর বয়স তখন আঠেরো! স্কুলটা ছিল সেই পুরনো কেশব অ্যাকাডেমির বাড়িতেই। অমূল্যভূষণের স্কুলে কাজ হত ভারতের ভাষা আর ভারতে চলিত ভাষা— বাংলা, সংস্কৃত, ওড়িয়া, তামিল, হিন্দি, তেলুগু, উর্দু, আরবি, ফারসি, অসমিয়া নিয়ে। এ ছাড়া ছিল ইংরেজি, গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি, পর্তুগিজ, জার্মান, এমনকি পালি ও প্রাকৃতও। আরও কয়েকটা ভাষা জানতেন, সব মিলিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ছাব্বিশে। হরিনাথ দে মশাই জানতেন চৌত্রিশটি ভাষা। তাঁর পরেই তালিকায় সম্ভবত দ্বিতীয় অমূল্যচরণ।
এই সব ভাষা পড়ানোর জন্য ওই কেশব অ্যাকাডেমিতেই তাঁর গ্রিক ভাষার শিক্ষক এডওয়ার্ডের নামে অমূল্যচরণ ‘এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন’ নামে একটা আলাদা স্কুলই খুলেছিলেন। এতে উপার্জন বেড়ে গিয়েছিল। দরিদ্র পরিবারের সন্তান অমূল্যচরণ হঠাৎ রোজগারের আর একটা সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলেন। কোহেন নামে এক সাহেব এর-ওর কাছে জানতে পেরেছিলেন, অমূল্যচরণ সংস্কৃত ভাষার জাহাজ। নিজের ছেলেকে ভাল করে সংস্কৃত শেখাতে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে তাঁকে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করলেন সাহেব। বাবার ছিল সামান্য কেরানির চাকরি, সহোদর দুই ভাই স্কুলের গণ্ডিও পেরোননি! সেই বংশের ছেলে বিদ্যাভূষণ কিনা পঞ্চাশ টাকা পাচ্ছেন মাসে! সঙ্গে চিঠি, বইপত্র অনুবাদ করে ও করিয়ে ট্রান্সলেটিং ব্যুরো থেকেও রোজগার।

বই কেনা আর ভাষা শেখানোর কাজেই অর্থ ব্যয় করেন। বিয়ে করেছিলেন যাঁকে উনিশ বছর বয়সে, সেই সুহাসিনী দেবী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে মারা যান। তত দিনে বাবাও মারা গিয়েছেন। সংসার চালায় কে, তাঁর তো বিদ্যাচর্চাতেই সময় যায়। কোলের ছেলেকে মানুষই বা করে কে? কয়েক মাস পরে তাই আবার বিয়ে করলেন— সরসীবালাকে। পাঁচ পুত্র আর তিন কন্যার জন্ম দিলেন তিনি। সংসার চলে আপন গতিতে। অমূল্যভূষণ ক্রমে বড় মেয়ে হেমলতার বিয়ে দিলেন তাঁর একদা-সহকর্মী, ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের পুত্র অজয়কুমারের সঙ্গে।
সংসার ও দায়দায়িত্ব, দুই-ই বেড়ে চলল ক্রমশ। বড় ভগ্নীপতি মারা যেতে বড়দিদি তাঁর সাতটি সন্তানকে নিয়ে ভাইয়ের সংসারে এলেন। বালবিধবা মেজদি বিধবা হওয়া ইস্তক আগেই এসেছিলেন। পিতা প্রয়াত, দাদা সামান্য বেতনের কর্মী। বিরাট সংসারের বিপুল বোঝা অমূল্যচরণের ঘাড়েই। এই গুরুভারও ভুলে থাকেন, সময় কেটে যায় ভাষা শিক্ষা ও শিক্ষণে, বই লেখা, পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রবন্ধ রচনায়, নানান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগে।
তাঁর রচিত গ্রন্থ :
• শ্রীকৃষ্ণ বিলাস
• জৈন জাতক
• শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত
• সরস্বতী
• উদ্ভিদ অভিধান
• বঙ্গীয় মহাকোষ

অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ ১৯৪০ সালের ১০ই এপ্রিল পরলোকগমন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.