করোনা সংক্রমণ (Covid Wave) এখন সেইভাবে বাড়েনি ভারতে। সংক্রমণের হারও তলানিতে। চিনে করোনার-ঝড় লন্ডভন্ড করছে, লাখে লাখে প্রাণহানি করছে, কিন্তু ভারত সেখানে অনেকটাই সুরক্ষিত। এ দেশে চিনের ওমিক্রন ও অন্য কিছু প্রজাতি ঢুকলেও আক্রান্তের সংখ্যা হাতে গোনা।
নতুন করে করোনার কোনও ঢেউ (Covid Wave) আর আসেনি। চিনের পরিস্থিতি দেখে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল যে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ এদেশেও আসতে পারে কিনা। কিন্তু দেখা গেল, চিনে নতুন করোনা আছড়ে পড়লেও ভারতে তার সিকিভাগ প্রভাবও দেখা যায়নি। ঢেউ তো অনেক দূরের কথা!
চিনের মতো পরিস্থিতি কেন হল না ভারতে?
দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, চিনে করোনার (Corona) বিস্ফোরণ শুরু হয়েছে, তবে ভারতের অতটা ভয় নেই। কারণ চিনের মতো পরিস্থিতি ভারতে তৈরি হবে না। কারণ ভারতীদের মধ্যে হাইব্রিড ইমিউনিটি (Hybrid Immunity) বা মিশ্র রোগ প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে যা করোনার যে কোনও প্রজাতিকে রুখে দিতে সক্ষম।
তাছাড়া টিকাকরণ খুব ভাল ভাবে হয়েছে ভারতে। তাছাড়া মানুষজনের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে গেছে অ্যান্টিবডি তৈরির কারণে। একদিকে যেমন ভ্যাকসিনের ডোজে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে শরীরে, তেমনিই, করোনার নানা প্রজাতিই সংক্রমণ (Covid Wave) ছড়িয়েছে ভারতে, সেই থেকেও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এই কারণেই হাইব্রিড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গেছে।
করোনা-ঝড় ছাড়খাড় করে দিচ্ছে চিনকে, ভারত কীভাবে এতটা সুরক্ষিত তার ব্যাখ্যা দিলেন ভাইরোলজিস্টরা।
১) ওমিক্রনের ঢেউ আগেও এসেছে ভারতে
ওমিক্রনের উপপ্রজাতি (Sub-Variant) বিএফ.৭ (Omicron BF.7)-এর জন্যই চিনে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাছাড়া এখন করোনার ‘ক্রাকেন’ প্রজাতিও তাণ্ডব করছে চিনে। লাখ লাখ সংক্রমণ হচ্ছে একদিনে। ওমিক্রনের এই প্রজাতি চিনে নতুন হলেও, ভারতে নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওমিক্রনের ঢেউ (Covid Wave) আগেই দেখে নিয়েছে ভারতবাসী। গত বছর ডিসেম্বরেই ওমিক্রনের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল এ দেশে। বহু মানুষ ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে সেরেও উঠেছিলেন। সেই সময় ওমিক্রনের দুই উপপ্রজাতি বিএ৪ ও বিএ৫-এর কারণে চতুর্থ ঢেউ এসেছিল ভারতে। তাছাড়া বিএ১ ও বিএ২ উপপ্রজাতিও ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, ভারতে ওমিক্রনের মোট পাঁচটি উপপ্রজাতি (Omicron) ধরা পড়েছে -বিএ.১, বিএ.২, বিএ.৩, বিএ৪ ও বিএ৫। নতুন সেইসব প্রজাতিতে অন্তত ৩০টি মিউটেশন হয়েছে বলে মনে করা হয়েছিল। যার মধ্যে স্পাইক প্রোটিনেই (s) ৩০ বার অ্যামাইনো অ্যাসিডের কোড বদলে গেছিল। সেই রূপ পরিবর্তিত ওমিক্রনের সঙ্গে লড়াই করে ভারতীয়রা অনেক বেশি প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ওমিক্রনের বিরোধী অ্যান্টিবডিও রয়েছে ভারতীয়দের শরীরে। কাজেই নতুন ওমিক্রন তেমনভাবে থাবা বসাতে পারবে না বলেই মত বিজ্ঞানীদের।
২) টিকাকরণে ভারত চিনের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে
চিনের টিকাকরণ সেভাবে হয়নি। চিনের দুই ভ্যাকসিন সেভাবে করোনা নিকেশ করতে পারেনি বলেও অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু ভারতের ভ্যাকসিন অনেক বেশি কার্যকরী হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে টিকাকরণ কর্মসূচী শুরু হয় ভারতে। দফায় দফায় বয়স্ক, কোভিড ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী-আশাকর্মী থেকে শুরু করে কমবয়সি, শিশু অবধি সকলকেই ভ্যাকসিন দুটি ডোজ দেওয়া হয়েছে নিয়ম মেনে। এমনকি বুস্টারও চালু হয়ে গেছিল এ বছরের গোড়া থেকেই। কোভ্যাক্সিন, কোভিশিল্ড দিয়ে শুরু করে পরে রাশিয়ার স্পুটনিক ভি সহ একগুচ্ছ বিদেশি ভ্যাকসিনও দেওয়া হয়েছে ভারতে। তাই ভারতীয়রা অনেক আগে থেকেই কোভিড ভ্যাকসিন দ্বারা সুরক্ষিত। চিনে যেখানে বেশিরভাগ মানুষই ভ্যাকসিন নেননি।
৩) করোনা গা সওয়া হয়ে গেছে, হাইব্রিড-ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে ভারতীয়দের
ভারতীদের মধ্যে হাইব্রিড ইমিউনিটি (Hybrid Immunity) বা মিশ্র রোগ প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে যা করোনার যে কোনও প্রজাতিকে রুখে দিতে সক্ষম। এর কারণ হল, টিকাকরণ খুব ভাল ভাবে হয়েছে ভারতে। তাছাড়া মানুষজনের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে গেছে অ্যান্টিবডি তৈরির কারণে।
চিনের সরকার ‘জ়িরো কোভিড’ নীতিতে মানুষকে ঘরবন্দি রাখার কৌশল নিয়েছিল। তার ফলে জনতাকে করোনার বিভিন্ন প্রজাতির সঙ্গে যুঝতে হয়নি। তাই সেখানে লোকজনের শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তিও কম। এতদিনে নিয়মকানুনের রাশ আলগা হওয়ায়, মানুষজন মেলামেশা বাড়িয়েছে। ফলে সংক্রমণ আবারও বাড়তে শুরু করেছে।
অন্য দিকে, ভারতে লকডাউন ওঠার পরেই সব কিছু খুলে দেয় সরকার। এর ফলে বিভিন্ন সময়ে করোনার নানা প্রজাতির মুখোমুখি হতে হয়েছে মানুষজনকে। সংক্রমণ হয়েছে, আবার সেরেও গেছে। সেই সঙ্গে টিকাকরণ চলেছে। তাই একদিকে যেমন ভারতীয়রা করোনার বিভিন্ন প্রজাতির বিরুদ্ধে নিজস্ব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে, তেমনই ভ্যাকসিনের কারণেও সেই প্রতিরোধ শক্তি আরও বেড়েছে। এটাই হল হাইব্রিড ইমিউনিটি, যে কারণে সংক্রমণের ভয় তুলনামূলকভাবে কম।