প্রতিরোধ-ঘড়ি! বেলা গড়ানোর সঙ্গে শরীরের ভিতর সেই ঘড়ির কাঁটাও ঘুরছে। মানবদেহে খেলছে ইমিউনিটির (Immunity) জোয়ার-ভাটা! সূর্যোদয়ের সঙ্গে প্রবল দাপটে মাঠে নামলেও সূর্যাস্তের সময় প্রতিরোধের জোর বেশ ফিকে। মানে, সকালের দিকে রোগজীবাণুর সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা বেশি থাকছে। সন্ধের পর প্রতিরোধ ক্ষমতার পরাক্রম কমছে। বেড়ে যাচ্ছে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা। টানা চার বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে একযোগে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন তিন-তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। যে তথ্য ভ্যাকসিন গবেষকদের জুগিয়েছে নতুন ভাবনার খোরাক। কারণ, ইমিউনিটি ক্লকের তথ্য মানলে ভোরে ভ্যাকসিন (Vaccine) দিলেই তা সবচেয়ে বেশি কার্যকর হওয়া উচিত।
আয়ারল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেন, মেনুথ ইউনিভার্সিটি এবং স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগো। এই তিনটি বিশ্ববরেণ্য প্রতিষ্ঠান একযোগে ৩ লক্ষ ২৯ হাজার মানুষের উপর সমীক্ষা চালিয়েছে। তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, প্রদাহ তৈরির বিষয়টি নজরে রাখা হয়েছে। দেখা হয়েছে, ইমিউনিটির দৈনিক পরিবর্তন বা সার্কাডিয়ান চেঞ্জেস ও সিজনাল চেঞ্জেস বা মরশুমি পরিবর্তন। পরীক্ষায় উঠে এসেছে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। সকালের দিকে মানবদেহে ইমিউনিটি বেশি থাকে। সন্ধের পর কমে যায়। অর্থাৎ সকালে জোয়ার। বিকেলে ভাটা শুরু।
ইমিউনিটির প্রাবল্য মাপতে গবেষণায় নিউট্রোফিল, লিম্ফোসাইট, মনোসাইটের মতো রক্তকোষের সঙ্গে যুক্ত অনাক্রমতা কোষগুলির সক্রিয়তা দেখা হয়েছে। সেই সঙ্গে দেখা হয়েছে প্রদাহের মাত্রাও। প্যারামিটার হিসাবে সি রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন (সিআরপি)—কে মার্কার হিসাবে দেখা হয়েছে। গবেষকদের পর্যবেক্ষণ, গরমকালে
ইমিউনিটির মাত্রা বেশি থাকে। তাই এই সময় মার্টিপল স্ক্লেরোসিসের মতো অটো ইমিউন ডিজিসের প্রবণতাও বাড়ে। শীতে ফ্লু জাতীয় সরদি—কাশি বেড়ে যায়, ইমিউনিটির প্রাবল্য কমে যায় বলে। ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল বায়োলজি’—র ইমনিউনিটি বিশেষজ্ঞ ডা. দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ইমিউনিটির এই তত্ত্ব নতুন নয়। বহু দেশে এই কারনেই সকালে নিউট্রোফিল ডোনেশন হয়। আগেও অনেক গবেষণায় ইমিউনিটির নিয়ে এমন তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু বড় আকারে গবেষণা এই প্রথম। আসলে, ইমিউনিটি কোষগুলিতে যে ক্লক জিন থাকে তা বিশেষ সময়ে বেশি প্রোটিন তৈরি করে। জেট ল্যাগের পিছনেও এই জিনের হাত রয়েছে।
গবেষকরা প্রথমে ইঁদুরের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। পরে ৩ লক্ষ ২৯ হাজার মানুষের রক্তের নমুনা নিয়ে চলে পরীক্ষা। গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি ‘বায়োমেডিক্যাল আর্কাইভ’—এ প্রকাশিত হয়। জার্নালটি উদ্ধৃত করে কলকাতার ইমিউনোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার জানান, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা। এই ইমিউনিটির জোয়ার-ভাঁটার সঙ্গে খাবার-দাবার, কায়িক পরিশ্রম, জীবনশৈলির সরাসরি কোনও সম্পর্কের হদিশ মেলেনি। গবেষণার স্বার্থে ইনফ্লামেটরি মার্কার (সিআরপি, ডি ডাইমার) ও লিম্ফোসাইট, মনোসাইট, নিউট্রোফিলের মতো রক্তকোষের পরিমাণ ও সক্রিয়তা মাপা হয়েছে। মাপা হয়েছে রক্তকোষের অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষমতাও। গবেষণাপত্রটি নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকরা। কারণ, এই স্টাডি শুধুমাত্র গ্রেট ব্রিটেনের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অন্য উপমহাদেশ ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পরীক্ষা হওয়া উচিত। এমনই পর্যবেক্ষণ সিদ্ধার্থবাবুর।