পৌষের শেষ থেকে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় জেরবার বঙ্গজীবন। হাঁচি, কাশি, জ্বর, সর্দিতে নাস্তানাবুদ শহরের বাসিন্দাদের অনেকেই। সঙ্গে হাজির পেটের সমস্যাও। বেশি করে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে বয়স্ক ও শ্বাসের সমস্যায় ভোগা রোগীদের নিয়ে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বার বার আবহাওয়ার পরিবর্তন হতে থাকলে এই ভোগান্তিও চলবে। এই মুহূর্তে যেমন কিছুটা ঠান্ডা থাকলেও পূর্বাভাস বলছে, কাল, শনিবার থেকেই বাড়তে পারে তাপমাত্রা। তাই সতর্কতাই হল এখন বাঁচার একমাত্র পথ।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার জেরেই জ্বর, সর্দি, কাশিতে ভোগা রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাঁরা আরও জানাচ্ছেন, ঠান্ডার মরসুমে এমনিতেই ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ মাথাচাড়া দেয়। তার সঙ্গে শহরের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে। যার ফলে শিশু থেকে বয়স্কদের অনেকেই জ্বর এবং টানা শুকনো কাশির প্রকোপে ভুগছেন। রাতে ঘুমনোর সময়ে সেই কাশির দমক আরও বাড়ছে। কাশির সিরাপ বা অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ওষুধেও সহজে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই জানাচ্ছেন, শীতের শুষ্ক মরসুমে ও শীতল আবহাওয়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কমে যায়। আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন হলে ভাইরাস ও ব্যাক্টিরিয়ার বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়। এই দুইয়ের প্রভাবেই ঠান্ডার মরসুমে সংক্রমণ অনেক গুণ বাড়ে। অনির্বাণ বলছেন, “ঠান্ডার কারণে বন্ধ ঘর বা বদ্ধ জায়গায়, যেখানে একসঙ্গে অনেক লোকের সমাগম ঘটে, সেখানে জীবাণু খুব দ্রুত এক জনের থেকে অন্য জনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।”
বক্ষরোগ চিকিৎসক অনির্বাণ নিয়োগী জানাচ্ছেন, ঠান্ডা থেকে তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেলে গলায় বসে থাকা ভাইরাসগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন শ্বাসনালির উপরিভাগে সংক্রমণ ঘটে। তাঁর কথায়, “প্রতি বছরই শীতে এই সমস্যা দেখা যায়। তবে এ বছর খুব ঘন ঘন আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে। পারদ যত দ্রুত ওঠানামা করবে, ততই ভাইরাস সক্রিয় হয়ে সংক্রমণ ঘটাবে। সেই ভাইরাসের দোসর হয়েছে কলকাতার দূষণ। এই জোড়া ফলায় বিভিন্ন অসুখেরই এ বার বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার মনে করাচ্ছেন, করোনা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। তাই সর্দি-কাশির প্রকোপ যে হারে বাড়ছে, তাতে ভয় থেকেই যায়। ঠান্ডার এই মরসুমে বয়স্কদের পাশাপাশি হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের ক্ষেত্রেও বিশেষ সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলছেন তিনি।
অ্যাজ়মা, সিওপিডি এবং হার্ট ফেলিয়োরের রোগীদের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ খুব বিপজ্জনক। কারণ, প্রথমে শ্বাসনালির উপরিভাগে থাকলেও, খুব দ্রুত সংক্রমণ ফুসফুসে চলে যায়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। চলতি মরসুমে বয়স্কদের পাশাপাশি ভাইরাসঘটিত ও অ্যালার্জির সংক্রমণে কাবু হচ্ছে খুদেরাও। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের শিশুরোগ চিকিৎসক দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী বলেন, “এই মরসুমে ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যাডেনো, রাইনো, রেসপিরেটরি সিনসিশিয়াল ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত হয়। শিশুরা একটি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পরে আবার অন্য একটিতে সংক্রমিত হচ্ছে।” চলতি মরসুমে ভাইরাসের হানায় শ্বাসনালির সংক্রমণের সঙ্গে পেটের সমস্যা কিংবা শুধু পেটের গোলমালও দেখা যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন শিশুরোগ চিকিৎসক অগ্নিমিতা গিরি সরকার। তাঁর কথায়, “আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় শিশুদের ত্বকের সমস্যা ও খুশকির প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
অগ্নিমিতা অবশ্য এ-ও জানাচ্ছেন, ঠান্ডার মরসুমে ছোটদের একটাই মোটা জামা বা জ্যাকেট পরিয়ে রাখা স্বাস্থ্যকর নয়। বরং কয়েকটি স্তরে জামা বা অন্য কিছু পরানোর কথা বলছেন তিনি। যাতে প্রয়োজন মতো সেগুলি খুলে ফেলা যায় এবং আবার পরানো যায়। অগ্নিমিতার কথায়, “জামার দু’টি স্তরের মাঝে যে বাতাস ঠেসে থাকে, সেটি তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে রাখে। কিন্তু একটাই মোটা জ্যাকেট, সোয়েটার পরিয়ে রাখলে ঘামে ভিজে শরীর খারাপের আশঙ্কা তৈরি হয়।”