রাজ্যের উদ্বেগজনক ডেঙ্গি পরিস্থিতির মধ্যে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে নিম্নচাপের টানা বৃষ্টি। ফলে, দু’সপ্তাহ আগে কলকাতা পুর এলাকায় ১২৭৬ জন ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা গত সপ্তাহে বেড়ে হয়েছে ১৩৬৭। তবে টানা বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় মশাবাহিত এই রোগের প্রকোপ এ বার কমতে পারে বলে অনুমান চিকিৎসকদের। যদিও শহর ও শহরতলির সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে এখনও চিকিৎসাধীন অনেক ডেঙ্গি রোগী।
রাজ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত ডেঙ্গি আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৫০ হাজার পেরিয়েছে। মারা গিয়েছেন ৬২ জনের মতো। বেসরকারি সূত্রে এই পরিসংখ্যান মিললেও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর কার্যত মুখে কুলুপ এঁটে আছে। যদিও প্রায় প্রতিদিনই রাজ্যে এক বা একাধিক জনের যে ডেঙ্গিতে মৃত্যু ঘটছে, তাঁদের বেশির ভাগই সরকারি হাসপাতালের রোগী।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের বাস্তব চিত্র বলছে, ডেঙ্গি পরিস্থিতি এখন স্থিতাবস্থায়। কোথাও রোগী ভর্তি সামান্য কমেছে, কোথাও একই রকম। যেমন, কামারহাটির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম প্রধান জানালেন, এখন সেখানে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গি রোগী ২৩ জন। তার মধ্যে চার জন বাচ্চা। এক জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। অধ্যক্ষ বলেন, ‘‘নতুন রোগী ভর্তির সংখ্যা কমেছে। ২৩ জনের মধ্যে নতুন পাঁচ জন। আগে সেটাই বেশি ছিল।’’
এখনই রোগী ভর্তি একেবারে কমে গিয়েছে, এমনটা বলতে চান না পিয়ারলেস হাসপাতালের কর্তা, চিকিৎসক সুদীপ্ত মিত্র। তাঁর কথায়, ‘‘রোগী ভর্তি কমার প্রবণতার প্রাথমিক পর্ব শুরু হয়েছে। গত বারের প্রবণতা দেখে বলা যায়, নভেম্বর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা কমার সম্ভাবনা রয়েছে।’’ বৃহস্পতিবার সেখানে চিকিৎসাধীন রোগী ছিলেন ৩৭ জন। কেউ সঙ্কটজনক নন।
যদিও ডেঙ্গিতে সঙ্কটজনক হতে খুব বেশি সময় লাগে না এবং দ্রুত সঙ্কটজনক হওয়ার প্রবণতায় এ বারে পাল্লা ভারী, জানাচ্ছেন বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের চিকিৎসক কৌশিক চৌধুরী। তিনি জানাচ্ছেন, রক্তচাপ ও কথাবার্তা স্বাভাবিক দেখে কোনও ডেঙ্গি রোগীকে সঙ্কটজনক নয় বলে মনে হতেই পারে। ফলে পেটে ব্যথা, বমি বা প্রস্রাব কমে যাওয়াকে তেমন আমল দেওয়া হচ্ছে না। এতেই ঝুঁকি বাড়ছে। আচমকাই রোগী শকে চলে যাচ্ছেন। কৌশিক বলেন, ‘‘অন্য রোগে শকে যেতে দিনকয়েক সময় লাগে। কিন্তু ডেঙ্গিতে উপসর্গ দেখা দেওয়ার তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে রোগী মারাত্মক সঙ্কটজনক হয়ে পড়ছেন।’’
এ দিন বেলেঘাটা আইডি-তে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ৬০। যাঁদের মধ্যে দু’জন আছেন ক্রিটিক্যাল কেয়ারে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অন্য জায়গা থেকে রেফার হয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেশি। তবে আগামী সাত দিন বৃষ্টি না হলে আক্রান্তের সংখ্যা কমবে বলেই মত চিকিৎসকদের। এ বারে সঙ্কটজনক রোগীদের হৃৎপিণ্ডের সমস্যা বেশি মাত্রায় মিলছে বলেই জানান এম আর বাঙুর হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ারের চিকিৎসক শুভব্রত পাল। ওই হাসপাতালের সিসিইউ-তে তিন জন ভর্তি রয়েছেন। যাঁদের কারও হৃৎস্পন্দন অত্যধিক বেশি, কারও কম। তবে আগের থেকে সঙ্কটজনক রোগী কমেছে বলেই জানান চিকিৎসকেরা।
হাওড়ার নারায়ণা হাসপাতালে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১০ জন ভর্তি রয়েছেন। কর্তৃপক্ষের দাবি, এক সপ্তাহ আগেও দৈনিক ৪-৫ জন ভর্তি হচ্ছিলেন। এখন দুইয়ে নেমে এসেছে। আইএলএস হাসপাতালের তিনটি শাখা মিলিয়ে সপ্তাহ তিনেক আগে ৪০ জন ডেঙ্গি রোগী ছিলেন, এখন সংখ্যাটি ১০। একই রকম ভাবে চলতি সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা কম বলে জানাচ্ছেন বেলঘরিয়ার জ়েনিথ হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার পার্থপ্রতিম শেঠ। সেখানে ২০ জন চিকিৎসাধীন। ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আইসিইউ-তে তিন জন এবং জেনারেল ওয়ার্ডে ১০ জন চিকিৎসাধীন ছিল। চলতি সপ্তাহে সেখানে রোগীর সংখ্যা স্থিতিশীল বলেই জানান চিকিৎসক প্রভাসপ্রসূন গিরি।
তবে, পুজোর মধ্যে আর যদি বৃষ্টি না হয়, তা হলে ডেঙ্গির লেখচিত্র নিম্নমুখী হওয়ার প্রবণতা শুরুর কথা বলছেন পতঙ্গবিদ অমিয়কুমার হাটি। তিনি বলেন, ‘‘এখন একটা স্থিতাবস্থা চলছে। পরবর্তী পরিস্থিতি নির্ভর করছে বৃষ্টির উপরে। বৃষ্টি না হলে নভেম্বরের মাঝামাঝির মধ্যে ডেঙ্গি পুরোপুরি চলে যাবে।’’