তিক্তত্বম্ , লঘুত্বম, কফপিত্তদোষনাশিত্বম্ রুচিকারিত্বচ্ঞ
অর্থাৎ , স্বাদে তিক্ত , কফ, পিত্ত নাশক এবং রুচিকারক এবং রোগারোগ্যের ক্ষেত্রে – পাণ্ডু কামলা অর্থাৎ জন্ডিস ইত্যাদি যকৃৎ প্লীহাঘটিত যাবতীয় রোগ প্রতিষেধক ও উপশামক।
পূর্ব পর্বেই বলেছি যে এই তিক্তস্বাদের শাকটিতে সাবান জলের ন্যায় কতক গুলি ফেনিল পিচ্ছিল পদার্থ আছে। এই পদার্থকে স্যাপোনিন বলে।এর থেকে বিশিষ্ট প্রক্রিয়ার দ্বারা কতকগুলো নতুন ধরনের টাইটারপিন্ জাতীয় দ্রব্য পাওয়া গিয়েছে। বর্তমানে এই বস্তুটির মানুষের রোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে তার বিশিষ্ট উপযোগিতার ক্ষেত্র কি তার অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
এবার একটু আলোচনা করা যাক আয়ুর্বেদ দৃষ্টিভঙ্গিতে শাকসব্জি কি?
যেকোনো তরকারী মাত্রই তা শাক পর্যায় ভুক্ত। তার আবার শ্রেণী বিভাগ আছে ,যথা – পত্র, পুষ্প, ফল, নাল, কন্দ এবং সংস্বেদজ ( ছত্রাক শাক) শাক; এই ছয়টি শ্রেণীর মধ্যেই সমস্ত তরিতরকারী। এগুলি উত্তরোত্তর গুরুপাক , এর মধ্যে পত্রশাকই সর্বাপেক্ষা লঘু। তবে পূর্বাচার্যগনের মতে শাককে স্নেহাভ্যক্ত করে অর্থাৎ অল্প ঘৃত বা তৈল (তিল তৈল এখানে বলা হয়েছে) দিয়ে সন্তলন করে বা সাঁতলে খাওয়া সমীচীন। এর ফলে শাকের রুক্ষতা নষ্ট হয় এবং অবশ্যই তা হজমের পক্ষে সহায়ক।
আলোচ্য গ্রীষ্মসুন্দরক অর্থাৎ গিমা বা গিমে শাক অগ্নু্্যদ্দীপক , কোষ্ঠশুদ্ধিকারক, বিষদোষনাশক। মেজর স্টিওয়ার্ট বলেছেন এটি জ্বর ঘাতকও বটে। তাঁর পূর্বেও চরক সংহিতায় সেই কথা উল্লেখ আছে। কেবল তাই নয়। এর একটি প্রজাতির নাম হল জ্বরপাপড়া। সে সব আগের পর্বেই উল্লেখ করেছিলাম। আরো একটি গুণের কথা মেজর স্টিওয়ার্ট উল্লেখ করেছেন তাঁর গ্রন্থে , – সুপ্রাচীন কাল থেকে দক্ষিণভারতে তামিল প্রদেশে পাদকোটা অঞ্চলে চুলকানি থেকে শুরু করে নানা ধরনের চর্মরোগে এই শাক বেটে লাগানো হত।
স্বর্গত কবিরাজ হারাণচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় গিমে শাকের মূল পাঁচ থেকে ছয়টি গোলমরিচের সঙ্গে বেটে বসন্ত রোগে ব্যবহার করতেন – বিস্ফোটক গুলিকে বসানোর জন্য।
এই শাক সম্পর্কে আর একটি তথ্যঃ আছে – যাঁদের কষ্টরজঃ আছে বা ডিসমেনোরিয়া আছে, আহার্যের সঙ্গে এটি খেলে উপশম হবে। কিন্তু যাঁদের অতিস্রাবের সমস্যা আছে তাঁরা খাবেন না।
গিমে শাকের বিবিধ বড় নাশক গুন। তাই যদি কেও কালে ভদ্রেও আহার্যের সঙ্গে শাক হিসাবে বা বেসন ও চালের আটা দিয়ে ফুলুরির মত বড়া করে খেলেও কিছু না কিছু উপকার হবেই। তাছাড়া যেখানে যকৃতের ক্রিয়া মন্দীভূত , সেসব ক্ষেত্রে সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন যদি অল্প পরিমাণ গিমেকে শাক হিসাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে যকৃৎ স্বাভাবিক ক্রিয়া শুরু করে। কারন অন্ন পানের মাধ্যমেই আমাদের অন্তরাগ্নির ইন্ধন সঞ্চয় করে।তাতেই আমাদের প্রাণ ধারন সুষ্ঠু হয়। সেই চরক সংহিতার যুগ হতে এই চিকিৎসা প্রচলিত। এই অভিমত আজও স্বীকৃত এবং অপরিবর্তিত।
” বিহিত – বিধি হিতমন্নপান – প্রাণিনাং প্রাণ -সংঙ্গকানাং প্রাণকুশলাঃ।
প্রত্যক্ষ ফলদর্শনাৎ তদিন্ধনাৎ হ্যন্তরগ্নে স্থিতি স্থিতিস্তদেব
সত্ত্বমুর্জ্জয়তি তচ্ছরীরধাতু ব্যূহবল- বর্ণেন্দ্রিয়- প্রসাদকরং যথোক্তমুপসেব্যমানং বিপরীত মহিতায় সম্পদ্যতে । ” – চরক সূত্র
যেমন বটের একটি ছোট্ট বীজাঙ্কুর কালে একটি প্রাসাদকে চিড় ধরিয়ে দিতে পারে – মন্থরগতিতে ক্রিয়াশীল যকৃৎও তদনুরূপ।
চরকে বর্ণেন্দ্রিয়ের পোষক রূপে যে শরীরস্থ অর্থাৎ রস ,রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি , মজ্জা, শুক্র – এই সপ্তধাতুর যে উপকারিতার কথা উল্লেখ আছে – সেই সিদ্ধান্ত সর্ববাদীসম্মত। চরকে বলা হয়েছে , পোষকতা অন্নপানীয়েই সম্পূর্ণ বিদ্যমান। অর্থাৎ শরীরের পুষ্টি বা ধাতুরসৃষ্টির একান্ত কারকতা যদি একটি বিশেষ ভেষজে থাকে , তাকে সংকেত করেই বলা যেতে পারে #সপ্তলা। অতএব এই গ্রীষ্মসুন্দর বা গিমে শাকের পর্যায় সপ্তলা সংজ্ঞাটিও স্বার্থক নাম। তা নিঃসন্দেহ। অর্থাৎ সপ্তধাতুর পোষকতা করে বলেই এই নাম দেওয়া হয়েছে।
সপ্তধাতূন্ লাতি = দদাতি ইতি সপ্তলা।
যার জন্য চরকে এটি একটি কল্পের পরিকল্পনা। অর্থাৎ , বৈদ্যগনের অভিমত হল, মনঃপ্রিয় বর্ণ ,গন্ধ, রস ও স্পর্শ বিশিষ্ট এবং বিধিপূর্বক কল্পিত অন্নপানকে প্রাণীদের প্রাণ বলে নির্দেশ করা হয়। আর প্রত্যক্ষতঃ দেখাও যায় যে অন্নপানই প্রাণীদের অন্তরাগ্নির ইন্ধন স্বরূপ। এটিই প্রাণীদের প্রাণ ধারনের হেতু।এটি যথা বিহিত ব্যবহৃত হলে সেই অন্নপান শরীরের ধাতুসমূহের বল ও বর্ণ এবং ইন্দ্রিয়দের প্রসন্নতা সম্পাদন করে, আর বিপরীত রূপে ব্যবহৃত হলে অহিতকর হেতু হয়।
এই শাকটি সম্পর্কে উল্লিখিত বৈদিক সূক্তের একটি কথা বিশেষ প্রণিধান যোগ্য। ভাষ্যকার লিখেছেন :
সবনমসি
এই সবন শব্দের তাৎপর্য যকৃতের দূষিত অংশকে আঁচড়ে নিষ্কাশন করে দেয়।
তাছাড়াও গিমে শাকে বেশ কিছু ভালো রাসায়নিক কম্পোজিশন থাকে : যেমন – Vitamin viz. Carotene , Fatty Acid, Glucoside, Highly essential oil ইত্যাদি।
গিমে শাক কে কেন্দ্র করে বেশ কিছু লোকায়ত মুষ্টি যোগ হয় :
যেমন : চোখ উঠলে ,চোখ দিয়ে পিচুটি পড়লে , গিমে পাতা সেঁকে নিয়ে তার রস ফোঁটা ফোঁটা করে চোখে দিলে চোখের ব্যাথা কমে, পিচুটি পড়া বন্ধ হয়।
অম্ল পিত্ত রোগে যাঁদের বমি হয়, তাঁরা গিমে পাতার রস ১ চামচ এবং তার সঙ্গে আমলকি ভিজানো জল আধকাপ যদি সকালে খান তবে অচিরেই বমি করার কষ্ট দূর হবে।
সমাপ্ত
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ভারতের চিরঞ্জীব বনৌষধি