সঞ্জয় সোম

যখন কোনো বড় বিপর্যয় দেখা দেয়, বিভিন্ন মানসিকতার মানুষ তার বিভিন্নভাবে মোকাবিলা করেন। একশ্রেণীর মানুষ আছেন যাঁরা আসন্ন বিপর্যয়ের ব্যাপ্তি কি হতে পারে সেটা অনুধাবন করতে পারেন না। আর এক শ্রেণীর মানুষ আছেন যাঁরা বিপর্যয় থেকে নিজেদের ব্যক্তিগত লাভ লোকসান কি হতে পারে সেটা নিয়ে বেশি উদ্বিঘ্ন থাকেন। তৃতীয় আর এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যাঁরা ব্যাপ্তিও বুঝতে পারেন আর সামাজকে যতদূর সম্ভব সুরক্ষিত রাখতে তাঁদের কি কর্তব্য, সেটাও বুঝতে পারেন কিন্তু নিচেষ্ট হয়ে বসে থাকেন। আর চতুর্থ এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, সংখ্যায় মুষ্টিমেয়, সমস্ত বিষয়ে সচেতন, নির্ণায়ক, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ, ব্যক্তিস্বার্থহীন এবং সেবব্রতী। এঁরা ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, ফলে বিপর্যয়ের বিধ্বংসী শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়, সম্পুর্ন ধ্বংসের হাত থেকে সমাজকে বাঁচানো যায়, মানুষের ক্ষতিকে সীমাবদ্ধ করা সম্ভব হয়। এই ত্রাতারা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন, উৎসাহিত করেন, এঁদের নিঃস্বার্থ এবং নিরলস প্রয়াস মানুষের মনে বল যোগায়।

এখন আমরা রাষ্ট্রীয়স্তরে লকডাউনের তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেছি এবং ধীরে ধীরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হচ্ছে। সেই মার্চ মাসে কোভিড ১৯এর বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, আজ তা সফলতার মুখ দেখছে। ওনার প্রেরণায় এবং নির্ণায়ক ভূমিকার জন্য ভারতবর্ষের মতন এমন বিপুল এবং এত ঘনবসতিপূর্ন উন্নয়নশীল একটি দেশ সেই অচিন্তনীয় কাজ করে দেখাতে সমর্থ হলো, যা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এবং সর্বোচ্চস্তরের স্বাস্থ্যপরিষেবা প্রদানে সামর্থবান দেশগুলিও কল্পনা করতে পারলো না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যবিষয়ক অধিকাংশ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ সংস্থাগুলি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে মে মাসের মধ্যে ৬০% ভারতীয় কোভিড আক্রান্ত হবেন। কেবল একজন নির্ণায়ক মানুষ ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে তা রুখে দিলেন এবং দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবকরা তাঁদের সর্বস্ব উজাড় করে দিলেন তাঁর অনুপ্রেরণায়। এই মুহূর্তে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে মোট কোভিড আক্রান্ত মাত্র ৪৫,৩৫৬ জন এবং মোট মৃতের সংখ্যা ১৪৯০।

আজ ভারতবর্ষে একজন সাধারণ মানুষের প্রানের যে দাম আছে, চাকচিক্যসর্বস্ব পশ্চিমি দেশগুলিতে তার সিকিভাগও নেই, কম্যুনিস্ট চীনে তো নেইই। ভারতে এই মানসিকতা কিন্তু আগে ছিলনা, গরিব দেশে গরিবের প্রানের দাম না থাকাটাই দস্তুর, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এবার সেই ধারণাটাকে চুরমার করে দিলেন। ওনার মানসিকতা কিন্তু নতুন নয়, গত ছয় বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ওনার কাজের ধারা লক্ষ্য করলেই তা বোঝা যায়। ভারতের অনামা অজানা পিছিয়ে পড়া গরিব মানুষ, প্রান্তিক মানুষ, কৃষক, দিনমজুররাই হলেন ওনার সার্বজনীন নীতির কেন্দ্রবিন্দু। তাঁদের বাড়ি করে দিতে হবে, সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে, রান্নার গ্যাস জুগিয়ে দিতে হবে, বাড়িতে শৌচালয় বানিয়ে দিতে হবে, ব্যাংকের খাতা খুলে দিতে হবে, স্বাস্থ্যেবীমা করে দিতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সুলভে ঋণ পাইয়ে দিতে হবে ইত্যাদি। অর্থাৎ অজ্ঞাতকুলশীল পরিচয়হীন সেই মানুষটাকে হাত ধরে সমাজে প্রতিষ্ঠা দিয়ে বলতে হবে, “আপনি আর অনামা নন, আপনি আমাদেরই একজন, আপনার প্রানও অমূল্য মশাই”।

আমি বিপর্যয় মোকাবিলায় যে পাঁচ ধরনের মানসিকতার কথা শুরুতেই বলেছি, সারা দেশ জুড়ে আমজনতা রাজনৈতিক, ধার্মিক এবং সামাজিক স্তরে তার প্রতিফলন দেখেছেন। দেশ একদিকে দেখেছে সিপিএম-এর হত্যালীলার শিকার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা সমস্ত তিক্ততা ভুলে মানুষের স্বার্থে কেরালায় সিপিএম-এর নেতৃত্বাধীন সরকারকে রিলিফের কাজে সর্বতোভাবে সাহায্য করছেন, আবার দেখেছে উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীনবাবু মধ্যরাতে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে পিপিই ইত্যাদি পরিবহনের সমস্যা সমাধানের সাহায্য চাইছেন এবং বায়ুসেনার বিশেষ বিমানে মহারাষ্ট্র থেকে ভোরের মধ্যেই সেসব ভুবনেস্বরে উড়িয়ে আনা হচ্ছে। দেশ এও দেখেছে যে রামকৃষ্ণ মিশন এবং ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মতন সনাতন ধর্মীয় সংগঠনগুলি প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের অন্নসংস্থান করছেন, তাঁদের জাত ধর্ম পন্থ কিচ্ছু দেখছেন না।

আবার কিছু কিছু রাজ্যে দেশ এর উল্টোটাও দেখেছে। ক্রমাগত দোষারোপ, ক্রমাগত বাধাদান, ক্রমাগত মিথ্যাচার, বিপর্যয় নিজে নিজেই মিটে যাবে এমন অলীক স্বপ্ন দেখা, বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে আত্মপ্রচার, অভুক্ত মানুষের মুখ থেকে খাবার আর পকেট থেকে কেন্দ্রীয় সাহায্যের পয়সা চুরি, ক্ষুদ্র স্বার্থে গণবন্টন ব্যবস্থাকে অব্যাবস্থিত করে দেওয়া, স্বাস্থ্যকর্মীদের যথাযথ সুরক্ষার বন্দোবস্ত না করা, মানুষকে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের লাভ পেতে না দেওয়া, বিরোধ করলেই পুলিশকে দিয়ে হয়রানি, মৃতদেহের চরম অসম্মান, বিশেষ বিশেষ এলাকায় লকডাউন পালনে যথেচ্ছাচার, আরো কত কিই। পেশীশক্তির সামনে মানুষ নিরুপায় তাই মুখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন কিন্তু ভোগান্তিটা তাঁরা সহজে ভুলবেন না। আজকের দিনে এক রাজ্যের মানুষ খুব সহজেই জানতে পারেন অন্যান্য রাজ্যে তাঁর সমগোত্রীয়রা কেমন আছেন, সংবাদমাধ্যমকে বশীভূত করে আজ আর তথ্যের আদানপ্রদান আটকানো যায়না। মানুষই আসল নির্বায়ক শক্তি। চাল চাইতে গিয়ে গ্রামের যে অসহায় মহিলা পুলিশের লাঠির বাড়ি খেলেন, তিনি কিন্তু সেই অপমান সহজে ভুলবেন না। তিনিও কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছেন যে যোগীর রাজ্যে বাড়ি বাড়ি বাচ্চাদের দুধ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এই বিপর্যয় আজ নয় কাল শেষ হবে। মানুষের ক্ষোভ কিন্তু সহজে শেষ হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.