অবয়ব তিনি আসলেই কি অভিনয় করেন নাকি জীবন তুলে ধরেন! সদা হাস্যোজ্জ্বল এক দীপ্ত প্রতীভা। আজকের দিনে আমরা দেখি সেলিব্রিটি তকমা আর উত্তম কুমার ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কাঙ্ক্ষিত অভিনেতা। আবার তিনি জনমানুষের কতখানি কাছের তিনি তা আজ শুনে কারও কাছে অবিশ্বাস্যও মনে হয়।
জনপ্রিয়তার এই তকমার বাইরে মনে হলেও তিনি ছিলেন ভীষণ কোমল হৃদয়ের প্রচন্ড বিনয়ী এবং আন্তরিক। একাধারে মেধাবী, প্রজ্ঞাবান, বিনয়ী, কোমল হৃদয় এবং দুর্দান্ত প্রতিভাবান এই অভিনেতা এতো বিখ্যাত হওয়া সত্বেও শ্যুটিং ইউনিটের অতি সাধারণ কর্মীরও দেখভাল করতেন। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য তার ত্যাগ ছিল অবর্ণনীয়। চলচ্চিত্র থেকে উপার্জন করা সমস্ত অর্থ ফের বিনিয়োগ করেছেন চলচ্চিত্রেই। চলচ্চিত্র প্রযোজনায় তার প্রযোজিত বহু চলচ্চিত্র ফ্লপ তকমা পাওয়ার পরও ফের টাকা ঢালতে দ্বিধা বোধ করেননি।
এমনও বহুবার হয়েছে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে বড় পারিশ্রমিকে যুক্ত হয়েছিলেন কিন্তু অর্থের সংকুলান না হওয়ায় পরিচালক চলচ্চিত্রের কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। তখন উত্তম কুমার নিজের পারিশ্রমিক কেটে নিজের গাঁট থেকে পয়সা দিয়েছেন যেন চলচ্চিত্রটা অর্থের অভাবে পড়ে না থাকে। চলচ্চিত্রের শুটিং বন্ধ না হয়ে যায়। চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষের কল্যানে আজীবন কাজ করেছেন। কোনো শিল্পী থেকে শুরু করে ফিল্ম ইউনিটের সাধারণ টি বয় পর্যন্ত তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হতো। তিনি যেমন‌ ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক তেমনি ছিলেন জীবনেরও মহানায়ক। তেমনই কয়েকটি ঘটনা উত্তম কুমারের জীবনের।
সেবার ‘যদুবংশ’ চলচ্চিত্রের শুটিং চলছিলো। শট দিতে গিয়ে উত্তমকুমারের হঠাৎ খেয়াল হলো, উপর থেকে একটা আলো পড়ার কথা ছিল কিন্তু সেটা জ্বলেনি। জ্বালানোর কথা যার, সেই লাইটম্যানের নাম কালী। কালী মন খারাপ করে বসে আছেন। শট দেয়া শেষ হলে উত্তমকুমার মেকআপ রুমে ডাকলেন কালীকে। কালী তো ভয়ে কুঁকড়ে গেছেন রীতিমতো। উত্তম কুমার আজ নিশ্চয়ই বকাবকি করবেন। কাছে যেতেই উত্তমকুমার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ”কী রে, কিছু হয়েছে?’ প্রশ্ন শুনে কেঁদে ফেললেন কালী। ফের উত্তম জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোকে আজ বেশ আনমনা মনে হলো!’
কালী উত্তরে বললেন, ‘মেয়ের বিয়ের ঠিক হয়েছে দাদা। টাকা জোগাড় করতে পারিনি। সেই চিন্তায় আসলে বারবার ভুল হচ্ছিলো। আর কখনও এমন ভুল হবে না।’ ঠিক পরদিনই বাড়িতে ডেকে কালীর হাতে একটি খামে টাকা দিয়েছিলেন উত্তম কুমার।

‘জীবনমৃত্যু’ চলচ্চিত্রের শুটিং হচ্ছে। চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনেতা অভিনেত্রী উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবী। তাদের বিশ্রামের জন্য ঠিক করা হয়েছে সরকারি ডাকবাংলো। উত্তমকুমার এসে সরকারি ডাকবাংলোতে অন্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের না দেখে প্রযোজককে বললেন, ‘না না, শুধু আমরা কেন! এখানেই সবাই থাকুক।” কিন্তু তাতে তো বহু খরচ। প্রযোজক সেই কথা বদলে নানা কথা বলছেন। হঠাৎ উত্তম কুমার বলে উঠলেন, ‘তাহলে আমায় ছেড়ে দিন। আমি এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করবো না। যেখানে শিল্পী বলতে কেবল প্রধান চরিত্রকে ধরা হয় সেখানে মনে হয় না আমার অভিনয় করা উচিত।’ উত্তম কুমারের এই কথাতেই কাজ হলো। প্রযোজক সবার জন্য ব্যবস্থা করলেন। দুপুরের খাবারও সবাই একসঙ্গে খেলেন।

‘সাগরিকা’ চলচ্চিত্রের সময়ের কথা। চলচ্চিত্রের কিছুদিন শুটিং হওয়ার পর খবর এলো প্রযোজক ভীষণ অসুস্থ। টাকার অভাবে শুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। এদিকে তখন পরিচালক সরোজ দে’র মাথায় হাত। একদিকে সুচিত্রা সেনের শিডিউল পাওয়াই ভীষণ দুরূহ। পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্রদের নিয়ে চলচ্চিত্রের কাজ অনেকটুকু এগিয়েছে। শেষে বাধ্য হয়েই চলচ্চিত্রের পরিচালক সরোজ দে উত্তমকুমারকে ধরলেন। উত্তমকুমার বললেন, ‘কাজ বন্ধ করবে না। শুটিং চলবে। তোমাকে ৩০ হাজার টাকা দিচ্ছি, তুমি শুটিং চালিয়ে নিবে।’ উত্তমকুমার টাকা দিলেন যেদিন পরদিনই প্রযোজক শুনেই বললেন ‘এটা কি করে হয়! আমাকে একবার বললেও তো হতো।’ পরে অবশ্য উত্তম কুমারের সেই টাকা লাগেনি। কিন্তু উত্তমকুমারের ওই ভরসা আজীবন স্মরণ করে গেছেন চলচ্চিত্রের পরিচালক। সাগরিকা চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পর সুপার হিট হয়েছিলো।
অভিনেত্রী মণি শ্রীমাণি তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলে ঠিক এমন। সেবার হঠাৎই মেয়ের বিয়ে ঠিক হলো অভিনয় শিল্পী মণি শ্রীমণির। এদিকে হাতে টাকা পয়সা নেই মণি শ্রীমণির। চলচ্চিত্রের অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই ভাবছেন চাঁদা তুলে টাকার জোগাড় করবেন। কিন্তু এভাবে করলে নিজের কাছে খারাপ লাগবে মণি শ্রীমণির। এদিকে তখনো উত্তম কুমার বিষয়টি জানেন না। উত্তম কুমারের ভাই তরুণ কুমার শুনেই রাতে উত্তম কুমারকে বললেন সব‌। এরপর উত্তম কুমার প্রস্তাব দিলেন কলকাতার বিশ্বরূপা রঙ্গমঞ্চে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার। কিন্তু সেখানে যতো টাকা টিকিট বিক্রি করে আয় হবে সব মণি শ্রীমণিকে দেয়া হবে। কেউ পারিশ্রমিকও নেবেন না। সেই অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন উত্তম কুমার। অনুষ্ঠানে যতো টাকা উঠলো সে টাকা যথেষ্ট ছিল না। আর তাই উত্তম কুমার অনুষ্ঠান শেষে খামে ভরে টাকা পাঠালেন মণি শ্রীমণিকে। সঙ্গে অনুরোধ কেউ যেন টের না পায়।
সেবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। তো উত্তম কুমার ভাইকে নিয়ে সে দাওয়াতে যাচ্ছেন। পথিমধ্যে তার মনে হলো একটি জিনিস তো তিনি ভুল করেছেন। রাজ্যপালের বাড়ির সামনে থেকে গাড়ি ঘোরাতে বললেন ড্রাইভারকে। পাশে তরুণ কুমার বললেন, ‘তোমার হুঁশ থাকে না। কিছু ফেলে এসেছো নিশ্চয়ই। আমি আগেই জানতাম।’ জবাবে উত্তম কুমার বললেন, একবার টালিগঞ্জে যেতে হবে। জরুরি প্রয়োজন। তৎক্ষণাৎ গাড়ি ঘুরে টালিগঞ্জ চলে গেল। এবার যদি আপনাকে একটা প্রশ্ন করি ওইদিন রাতে গাড়ি ঘুরিয়ে কথায় গিয়েছিলেন উত্তম কুমার? কী এমন ভীষণ প্রয়োজন ছিল তার? উত্তরটা অকল্পনীয় মনে হতে পারে। রাজ্যপালের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে রাজ্যপালের বাড়ির সামনে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে তিনি গিয়েছিলেন সেই লাইটম্যান কালীর বাড়িতে কালীর মেয়ের বিয়ে খেতে।
উত্তম কুমারের লিপসিংয়ে আমরা চলচ্চিত্রে আসলে যার গান শুনি তিনি কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাদের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক ছিল সবসময়। কিন্তু শেষদিকে খানিকটা ভাঙন ধরেছিলো সম্পর্কে। কেউই আর এগিয়ে আসেননি তেমন। তবে উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর চলচ্চিত্রের গান গাইতে গিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘উত্তম চলে যেতে আমার গানের মুখটাই চলে গেল।” ওর মতো তো আর কেউ পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পারবে না!’
উত্তম কুমারের কতোটা জনপ্রিয়তা ছিল তা আজকের দিনে বসে কল্পনা করা যাবে না। বিশেষ করে পত্রিকা অফিসে প্রতিদিন হাজার হাজার চিঠি আর শত শত ফোন আসতো উত্তম কুমারের সাথে শুধু একবার কথা বলিয়ে দেয়ার জন্য। একটাবার যেন তাদের চিঠির উত্তর দেন উত্তম কুমার। জন্মদিনে চিঠির সংখ্যা কোনো কোনো বছর লাখ খানেকও হতো।

The Daily Star Bangla
সাহসিকতা • সততা • সাংবাদিকতা
আজকের সংবাদ
কিছু লোক সারাক্ষণ আমাদের দোষ-খুঁত ধরার চেষ্টায় থাকে: প্রধানমন্ত্রী বহির্নোঙর থেকে ভোজ্যতেল পাচারের অভিযোগ আ. লীগ নেতার বিরুদ্ধে বিচারের দাবি নিয়ে পালিত হলো শামসুন নাহার হলের নিপীড়ন দিবস ‘লোডশেডিংয়ের মতো জোড়াতালি দিয়ে জ্বালানি সংকটের সমাধান হবে না’ মাঙ্কিপক্স: সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি ডব্লিউএইচওর ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, গ্রেপ্তার ১ যেমন ছিল গত সপ্তাহের শেয়ারবাজার চবিতে যৌন নিপীড়ন: অভিযুক্ত ২ ছাত্রকে আজীবন বহিষ্কার শরীয়তপুরে সেতু ভেঙে যান চলাচল বন্ধ, আটকা ৩ শতাধিক গাড়ি হিলি চেকপোস্টে ভারতীয় নাগরিকের ব্যাগে পাওয়া গেল ৫ লাখ টাকা প্রতিবাদী গানে চতুর্থ দিনে চবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মধ্যরাতে শেষ হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা, ইলিশ ধরতে প্রস্তুত জেলেরা ‘হাওয়া’ দিয়ে সিলেটে যাত্রা শুরু করছে সিনেপ্লেক্স বোনকে উত্ত্যক্ত, বিচার চাওয়ায় ৩ ভাইকে কুপিয়ে জখম রিয়াল মাদ্রিদকে হারানোর প্রত্যাশায় পেদ্রিকিছু লোক সারাক্ষণ আমাদের দোষ-খুঁত ধরার চেষ্টায় থাকে: প্রধানমন্ত্রী বহির্নোঙর থেকে ভোজ্যতেল পাচারের অভিযোগ আ. লীগ নেতার বিরুদ্ধে বিচারের দাবি নিয়ে পালিত হলো শামসুন নাহার হলের নিপীড়ন দিবস ‘লোডশেডিংয়ের মতো জোড়াতালি দিয়ে জ্বালানি সংকটের সমাধান হবে না’ মাঙ্কিপক্স: সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি ডব্লিউএইচওর ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, গ্রেপ্তার ১ যেমন ছিল গত সপ্তাহের শেয়ারবাজার চবিতে যৌন নিপীড়ন: অভিযুক্ত ২ ছাত্রকে আজীবন বহিষ্কার শরীয়তপুরে সেতু ভেঙে যান চলাচল বন্ধ, আটকা ৩ শতাধিক গাড়ি হিলি চেকপোস্টে ভারতীয় নাগরিকের ব্যাগে পাওয়া গেল ৫ লাখ টাকা প্রতিবাদী গানে চতুর্থ দিনে চবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মধ্যরাতে শেষ হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা, ইলিশ ধরতে প্রস্তুত জেলেরা ‘হাওয়া’ দিয়ে সিলেটে যাত্রা শুরু করছে সিনেপ্লেক্স বোনকে উত্ত্যক্ত, বিচার চাওয়ায় ৩ ভাইকে কুপিয়ে জখম রিয়াল মাদ্রিদকে হারানোর প্রত্যাশায় পেদ্রি

টিভি ও সিনেমা
চলচ্চিত্র ও জীবনের মহানায়ক উত্তম কুমার

আহমাদ ইশতিয়াক
শনিবার, জুলাই ২৪, ২০২১ ০৫:২২ অপরাহ্ন

উত্তম কুমার। ছবি: সংগৃহীত
উত্তম কুমার। নামটা শুনলেই চোখে ভাসে এক অবয়ব তিনি আসলেই কি অভিনয় করেন নাকি জীবন তুলে ধরেন! সদা হাস্যোজ্জ্বল এক দীপ্ত প্রতীভা। আজকের দিনে আমরা দেখি সেলিব্রিটি তকমা আর উত্তম কুমার ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কাঙ্ক্ষিত অভিনেতা। আবার তিনি জনমানুষের কতখানি কাছের তিনি তা আজ শুনে কারও কাছে অবিশ্বাস্যও মনে হয়।
জনপ্রিয়তার এই তকমার বাইরে মনে হলেও তিনি ছিলেন ভীষণ কোমল হৃদয়ের প্রচন্ড বিনয়ী এবং আন্তরিক। একাধারে মেধাবী, প্রজ্ঞাবান, বিনয়ী, কোমল হৃদয় এবং দুর্দান্ত প্রতিভাবান এই অভিনেতা এতো বিখ্যাত হওয়া সত্বেও শ্যুটিং ইউনিটের অতি সাধারণ কর্মীরও দেখভাল করতেন। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য তার ত্যাগ ছিল অবর্ণনীয়। চলচ্চিত্র থেকে উপার্জন করা সমস্ত অর্থ ফের বিনিয়োগ করেছেন চলচ্চিত্রেই। চলচ্চিত্র প্রযোজনায় তার প্রযোজিত বহু চলচ্চিত্র ফ্লপ তকমা পাওয়ার পরও ফের টাকা ঢালতে দ্বিধা বোধ করেননি।
এমনও বহুবার হয়েছে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে বড় পারিশ্রমিকে যুক্ত হয়েছিলেন কিন্তু অর্থের সংকুলান না হওয়ায় পরিচালক চলচ্চিত্রের কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। তখন উত্তম কুমার নিজের পারিশ্রমিক কেটে নিজের গাঁট থেকে পয়সা দিয়েছেন যেন চলচ্চিত্রটা অর্থের অভাবে পড়ে না থাকে। চলচ্চিত্রের শুটিং বন্ধ না হয়ে যায়। চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষের কল্যানে আজীবন কাজ করেছেন। কোনো শিল্পী থেকে শুরু করে ফিল্ম ইউনিটের সাধারণ টি বয় পর্যন্ত তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হতো। তিনি যেমন‌ ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক তেমনি ছিলেন জীবনেরও মহানায়ক। তেমনই কয়েকটি ঘটনা উত্তম কুমারের জীবনের।
সেবার ‘যদুবংশ’ চলচ্চিত্রের শুটিং চলছিলো। শট দিতে গিয়ে উত্তমকুমারের হঠাৎ খেয়াল হলো, উপর থেকে একটা আলো পড়ার কথা ছিল কিন্তু সেটা জ্বলেনি। জ্বালানোর কথা যার, সেই লাইটম্যানের নাম কালী। কালী মন খারাপ করে বসে আছেন। শট দেয়া শেষ হলে উত্তমকুমার মেকআপ রুমে ডাকলেন কালীকে। কালী তো ভয়ে কুঁকড়ে গেছেন রীতিমতো। উত্তম কুমার আজ নিশ্চয়ই বকাবকি করবেন। কাছে যেতেই উত্তমকুমার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ”কী রে, কিছু হয়েছে?’ প্রশ্ন শুনে কেঁদে ফেললেন কালী। ফের উত্তম জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোকে আজ বেশ আনমনা মনে হলো!’
কালী উত্তরে বললেন, ‘মেয়ের বিয়ের ঠিক হয়েছে দাদা। টাকা জোগাড় করতে পারিনি। সেই চিন্তায় আসলে বারবার ভুল হচ্ছিলো। আর কখনও এমন ভুল হবে না।’ ঠিক পরদিনই বাড়িতে ডেকে কালীর হাতে একটি খামে টাকা দিয়েছিলেন উত্তম কুমার।

জীবন মৃত্যু চলচ্চিত্রের এক দৃশ্যে সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমার।

‘জীবনমৃত্যু’ চলচ্চিত্রের শুটিং হচ্ছে। চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনেতা অভিনেত্রী উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবী। তাদের বিশ্রামের জন্য ঠিক করা হয়েছে সরকারি ডাকবাংলো। উত্তমকুমার এসে সরকারি ডাকবাংলোতে অন্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের না দেখে প্রযোজককে বললেন, ‘না না, শুধু আমরা কেন! এখানেই সবাই থাকুক।” কিন্তু তাতে তো বহু খরচ। প্রযোজক সেই কথা বদলে নানা কথা বলছেন। হঠাৎ উত্তম কুমার বলে উঠলেন, ‘তাহলে আমায় ছেড়ে দিন। আমি এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করবো না। যেখানে শিল্পী বলতে কেবল প্রধান চরিত্রকে ধরা হয় সেখানে মনে হয় না আমার অভিনয় করা উচিত।’ উত্তম কুমারের এই কথাতেই কাজ হলো। প্রযোজক সবার জন্য ব্যবস্থা করলেন। দুপুরের খাবারও সবাই একসঙ্গে খেলেন।

সাগরিকা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন।

‘সাগরিকা’ চলচ্চিত্রের সময়ের কথা। চলচ্চিত্রের কিছুদিন শুটিং হওয়ার পর খবর এলো প্রযোজক ভীষণ অসুস্থ। টাকার অভাবে শুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। এদিকে তখন পরিচালক সরোজ দে’র মাথায় হাত। একদিকে সুচিত্রা সেনের শিডিউল পাওয়াই ভীষণ দুরূহ। পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্রদের নিয়ে চলচ্চিত্রের কাজ অনেকটুকু এগিয়েছে। শেষে বাধ্য হয়েই চলচ্চিত্রের পরিচালক সরোজ দে উত্তমকুমারকে ধরলেন। উত্তমকুমার বললেন, ‘কাজ বন্ধ করবে না। শুটিং চলবে। তোমাকে ৩০ হাজার টাকা দিচ্ছি, তুমি শুটিং চালিয়ে নিবে।’ উত্তমকুমার টাকা দিলেন যেদিন পরদিনই প্রযোজক শুনেই বললেন ‘এটা কি করে হয়! আমাকে একবার বললেও তো হতো।’ পরে অবশ্য উত্তম কুমারের সেই টাকা লাগেনি। কিন্তু উত্তমকুমারের ওই ভরসা আজীবন স্মরণ করে গেছেন চলচ্চিত্রের পরিচালক। সাগরিকা চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পর সুপার হিট হয়েছিলো।
অভিনেত্রী মণি শ্রীমাণি তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলে ঠিক এমন। সেবার হঠাৎই মেয়ের বিয়ে ঠিক হলো অভিনয় শিল্পী মণি শ্রীমণির। এদিকে হাতে টাকা পয়সা নেই মণি শ্রীমণির। চলচ্চিত্রের অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই ভাবছেন চাঁদা তুলে টাকার জোগাড় করবেন। কিন্তু এভাবে করলে নিজের কাছে খারাপ লাগবে মণি শ্রীমণির। এদিকে তখনো উত্তম কুমার বিষয়টি জানেন না। উত্তম কুমারের ভাই তরুণ কুমার শুনেই রাতে উত্তম কুমারকে বললেন সব‌। এরপর উত্তম কুমার প্রস্তাব দিলেন কলকাতার বিশ্বরূপা রঙ্গমঞ্চে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার। কিন্তু সেখানে যতো টাকা টিকিট বিক্রি করে আয় হবে সব মণি শ্রীমণিকে দেয়া হবে। কেউ পারিশ্রমিকও নেবেন না। সেই অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন উত্তম কুমার। অনুষ্ঠানে যতো টাকা উঠলো সে টাকা যথেষ্ট ছিল না। আর তাই উত্তম কুমার অনুষ্ঠান শেষে খামে ভরে টাকা পাঠালেন মণি শ্রীমণিকে। সঙ্গে অনুরোধ কেউ যেন টের না পায়।
সেবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। তো উত্তম কুমার ভাইকে নিয়ে সে দাওয়াতে যাচ্ছেন। পথিমধ্যে তার মনে হলো একটি জিনিস তো তিনি ভুল করেছেন। রাজ্যপালের বাড়ির সামনে থেকে গাড়ি ঘোরাতে বললেন ড্রাইভারকে। পাশে তরুণ কুমার বললেন, ‘তোমার হুঁশ থাকে না। কিছু ফেলে এসেছো নিশ্চয়ই। আমি আগেই জানতাম।’ জবাবে উত্তম কুমার বললেন, একবার টালিগঞ্জে যেতে হবে। জরুরি প্রয়োজন। তৎক্ষণাৎ গাড়ি ঘুরে টালিগঞ্জ চলে গেল। এবার যদি আপনাকে একটা প্রশ্ন করি ওইদিন রাতে গাড়ি ঘুরিয়ে কথায় গিয়েছিলেন উত্তম কুমার? কী এমন ভীষণ প্রয়োজন ছিল তার? উত্তরটা অকল্পনীয় মনে হতে পারে। রাজ্যপালের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে রাজ্যপালের বাড়ির সামনে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে তিনি গিয়েছিলেন সেই লাইটম্যান কালীর বাড়িতে কালীর মেয়ের বিয়ে খেতে।
উত্তম কুমারের লিপসিংয়ে আমরা চলচ্চিত্রে আসলে যার গান শুনি তিনি কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাদের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক ছিল সবসময়। কিন্তু শেষদিকে খানিকটা ভাঙন ধরেছিলো সম্পর্কে। কেউই আর এগিয়ে আসেননি তেমন। তবে উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর চলচ্চিত্রের গান গাইতে গিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘উত্তম চলে যেতে আমার গানের মুখটাই চলে গেল।” ওর মতো তো আর কেউ পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পারবে না!’
উত্তম কুমারের কতোটা জনপ্রিয়তা ছিল তা আজকের দিনে বসে কল্পনা করা যাবে না। বিশেষ করে পত্রিকা অফিসে প্রতিদিন হাজার হাজার চিঠি আর শত শত ফোন আসতো উত্তম কুমারের সাথে শুধু একবার কথা বলিয়ে দেয়ার জন্য। একটাবার যেন তাদের চিঠির উত্তর দেন উত্তম কুমার। জন্মদিনে চিঠির সংখ্যা কোনো কোনো বছর লাখ খানেকও হতো। উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর এক নারী পত্রিকা অফিসে উত্তম কুমারকে নিয়ে এক চিঠিতে লিখেছিলেন ‘উত্তমের মৃত্যুতে আমি বিধবা হলাম।’ উত্তমকুমারের চলচ্চিত্রের তালিকায় চোখ বুলালে আরেকটা ব্যাপার মনে হয়, কতো বিচিত্র ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেছেন। আবার সময়ের সঙ্গে দারুণভাবে পাল্টেও নিয়েছেন তিনি নিজেকে। শেষদিকে নায়কের ভূমিকা ছেড়ে অভিনয় করেছেন অসামান্য সব চরিত্রে।
উত্তম কুমার যে কতোটা বিনয়ী তা অবর্ণনীয়। একজন প্রধান চরিত্রের অভিনয় শিল্পী থেকে প্রোডাকশন বয়ের সঙ্গেও তার দারুণ সম্পর্ক ছিলো। যা আজকের দিনে মাঝেমাঝে কল্পনাও করা যায়না। সমাজ সচেতন, চিন্তাশীল, অথচ প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছিলেন তিনি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত চলচ্চিত্র প্রাণ। উত্তম কুমারের আত্মজীবনী ‘আমার আমি’ পড়লে বোঝা যায় চলচ্চিত্রের প্রতি কতোটা ত্যাগী ও আত্মপ্রাণ ছিলেন। আত্মজীবনীতে উত্তম কুমার লিখেছিলেন, ‘চলচ্চিত্র আমাকে এতোটা দিয়েছে, আমি দিবো না চলচ্চিত্র শিল্পকে।’ বাংলা চলচ্চিত্রে যদি কোনো ব্যক্তির আর্থিক ও সামগ্রিকভাবে অবদানের কথা আসে তবে তিনি নিঃসন্দেহে উত্তম কুমারই হবেন। তাইতো তিনি মহানায়ক। একই সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের, আবার জীবনেরও।
আজ মহানায়ক উত্তম কুমারের চলে যাওয়ার দিন। প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই মহানায়কের প্রতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.