কলকাতার কথা বলতেই আমার মনে পড়ে যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্মৃতির শহর’ কবিতা গুচ্ছের কথা। কারণ কলকাতাকে আমি সত্যিই স্মৃতির শহরই বলব।
খুব ছোটবেলা থেকে আমার অভ্যাস ছিল হেঁটে শহর দেখা। সেই যে শঙ্খবাবু লিখেছিলেন, ‘এ কলকাতার মধ্যে আছে অরেকটা কলকাতা। হেঁটে দেখতে শিখুন’। আমি সেই ছোটবেলা থেকে এই মাঝবয়েস পর্যন্ত হেঁটে দেখছি এবং শিখছিও।
একটি শহর এত মানুষজন, কংক্রিট, যানবাহন, এই সব কিছুকে আত্মসাৎ করে, সংমিশ্রণ করে কী ভাবে বেঁচে থাকতে পারে। বেড়ে উঠতে পারে। তা চমকের পর চমক লাগায়।
কলকাতার ক্ষেত্রে আমি প্রথম যেটা বুঝতে পারি তা হল শহরের সঙ্গে সংলাপে যাওয়া যায় না। আমার ধারণা ছিল যে শহর কেবলই থাকার জায়গা। শহর বলে তো আসলে কিছু নেই। শহর মানে বাড়ি, শহর মানে দোকান, শহর মানে মানুষ, শহর মানে ট্রেন, যাতায়াত সব কিছু। শহর তো শুধুই একটি জনপদ।
অনেক সন্ধেয় আমি কলকাতার বিভিন্ন খ্যাত এবং বহু অখ্যাত রাস্তা ধরে শুধু মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়েছি। স্কুলে পড়াকালীন আমার একটি নেশা ছিল। যে রাস্তা আমি চিনি না সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চেনা রাস্তায় গিয়ে ওঠা। আরও একটি নেশা ছিল, যেখান থেকে বাস ছাড়ে সেখান থেকে বাসে উঠে শেষ স্টপেজে গিয়ে নামা। সেখানে গিয়ে নেমে ঘুরে ফিরে আবার একটি বাস ধরে চেনা জায়গায় ফিরে আসা। কয়েক বছর আগে পর্যন্তও এই নেশা জারি ছিল। যাওয়া আসা করতে গিয়ে বুঝেছি কলকাতার নিজস্ব এক প্রাণ আছে। বলার মতো নিজস্ব কথা আছে। শুধু শহরের সঙ্গে গল্প করেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। প্রেমে পড়া যায়। দুঃখে তার কোলের কাছে গিয়ে চুপ করে বসে থাকা যায়। কলকাতার মধ্যে আছে সেই আশ্রয়। যখন আমার সামনে সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, কারও কাছে যাওয়ার থাকে না, তখন আমি কলকাতার কাছে যাই। কলকাতা আমাকে কখনও ফিরিয়ে দেয় না।
আমার কাছে কলকাতা মানে কবিতাও। আমার বহু কবিতা কলকাতার রাস্তায় লেখা। আমার দু’একটি বই আছে যার সব কবিতাই কলকাতার কোনও না কোনও রাস্তায় লেখা। অনেক দিন এ রকম হয়েছে যে কর্মক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এমন একটি ট্রাম বা বাসে চেপে বসেছি যেগুলি অনেক পথ ঘুরে তার পরে আমার বাড়ির পথ ধরবে। আমি কখনও চাইতাম না এবং এখনও চাই না যে রাস্তা ফুরিয়ে যাক। এই উঠলাম আর এই নেমে গেলাম তা হলে আর রাস্তার মজা কী হল!
ফলে আমি সব চাইতে দীর্ঘ রুটের কোনও বাস-ট্রাম ধরতাম। যাতে অনেক ক্ষণ জানলার ধারে বসার সুযোগ পাই। জানলার ধার ঘেঁষে বসে শহর দেখার ফাঁকেই প্রচুর কবিতা আমার মাথায় এসেছে। মজার ব্যাপার আমি হয়তো কলেজ স্ট্রিট থেকে বাসে উঠেছি ভেঙে ভেঙে গড়িয়া যাব বলে। হঠাৎ করেই নেমে পড়লাম পার্ক স্ট্রিটে। ময়দানে ঢুকে কোনও একটি বেঞ্চিতে বসলাম। তখন হয়তো মাথার মধ্যে অনেকগুলি কবিতার লাইন ঘুরছে। কলম তো পকেটেই থাকত। কোনও ভাবে একটি কাগজ জোগাড় করে সেই লাইনগুলি লিখে রাখতাম। বুঝতে পারতাম একটি কবিতা তৈরি হচ্ছে।
আবার একটি বাসে উঠলাম যার জানলার ধার ফাঁকা। বালিগঞ্জে নেমে সার্কুলার রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। কোথাও একটি ফাঁক রক পেয়ে বসে মাথায় ঘুরতে থাকা আরও চারটে লাইন লিখে ফেললাম। এ ভাবেই কলকাতা আমাকে কবিতা দিয়েছে।
কলকাতার কাছে আমার ঋণ অসীম। আমাদের এখানে অভাব, অভিযোগ, আক্ষেপ, অভিমান সব কিছুই আছে। আমরা তো তেমন দেশে থাকি না, যেখানে সারা ক্ষণ তৃপ্ত থাকা যায়। তবু পৃথিবীর যে শহরেই যাই না কেন সাত দিন পর কলকাতার জন্য মন কেমন করতে শুরু করে। সে জায়গা থেকেই বুঝতে পারি কলকাতা কেবল কোনও শহর নয়। কলকাতা আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। যার কাছে বারবার ফিরে আসতে ভাল লাগে।
কলকাতা তো প্রেমের শহর বটেই। সেই অর্থে দেখতে গেলে যেখানে মানুষ আছেন সেটাই প্রেমের শহর। কিন্তু আমার মনে হয় যে, কলকাতার সঙ্গে প্রেম আছে আমার। খুবই অলীক একটি প্রেম। শহর তো সেই ভাবে স্পর্শযোগ্যতা তৈরি করে না। তার অনেক স্তর আছে। একটি বড় শহরের যা হয়। সব মিলিয়ে কলকাতা আমার প্রেমিকা। তার প্রেমে আমি প্রতি দিন পড়ি। ফলে কলকাতার সঙ্গে আমার প্রেম দিবস কিন্তু ৩৬৫ দিন। কলকাতার সঙ্গে রোজ আমার নতুন নতুন প্রেম হয়। আমার লেখা যদি কেউ অনুসরণ করেন বিশেষ করে আমার কবিতা, তা হলে বুঝতে পারবেন অনেক কবিতা কলকাতাকে নিয়েই লেখা। আমি পাঠকদের কাছ থেকে এই অভিযোগও পেয়েছি যে আপনার কবিতায় বড্ড বেশি কলকাতা শহর। এর থেকে বোঝা যায় যে, একটি শহরের প্রতি ঠিক কতটা দুর্বলতা থাকলে তার কথা বারবার কবিতায় ফিরে আসতে পারে।
কলকাতা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন, আধুনিক এবং বৃহৎ শহর। কলকাতার শিল্প সংস্কৃতির ইতিহাস গর্ব করার মতো ইতিহাস। এ শহরে শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রের রথী-মহারথীরা জন্মেছেন, থেকেছেন, কাজ করে গিয়েছেন। অথচ তাঁদের কাজ, তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা এ শহরে সব ক্ষেত্রে হয়নি। যে ভাবে আমরা রবীন্দ্রনাথকে পাই, গিরিশ ঘোষকে কি আমরা একই ভাবে পাই? সেই ভাবে কি আমরা সুকুমার রায়কে পাই? পাই না। আসলে আমাদের দৈনিক হাজারও চাওয়া পাওয়ার ভিড়ে শিল্প সংরক্ষণ যেন কিছুটা বিলাসিতাই। আমি যখনই বাইরের শহরগুলিতে গিয়েছি বিশেষত ইউরোপে, আমি দেখেছি কী নিপুণ উৎসাহে এক জন শিল্পীর, এক জন চিন্তকের, এক জন সাহিত্যিকের প্রতিটি কাজ এমনকি, তাঁদের ব্যবহার্য জিনিস তাঁরা সংরক্ষণ করে রেখেছেন। আমরা টিকিট কেটে তা দেখেছি। আমার মনে হয় আমাদের শহরে এমন অনেক মানুষ বিশ্বমানের সাংস্কৃতিক কাজ করে গিয়েছেন। তাঁদের কাজ, ভাবনা-চিন্তা সংরক্ষণের যদি ব্যবস্থা হয়, তা হলে আমি এই শহরের এক জন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আরও খুশি হব।