বাইরে মৃত্যু দেখছি আর ভিতরে ইউভানের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি, আমি মা হলাম: শুভশ্রী


ইউভান এখন নীচে গেল। আমার ছোট্ট ইউভান। মা হওয়ার সব সুখ ও দু’হাত ভরে আমায় দিয়েছে। ওকে দেখে আমার মা তো এখন বলে, “আমার ছোট্ট পুটু আবার মা হয়ে গেল! ভাবাই যায় না!” মনে আছে আমার, আমি অন্তঃসত্ত্বা শুনে মা যে কী খুশি হয়েছিল!

এখন লিখতে বসে মনে পড়ছে কোন এক ছোটবেলার কথা, আমি তখন থেকেই বড় হয়ে মা হতে চেয়েছিলাম। ভাবলে হয়ত অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু এটাই সত্যি। ডিসকভারি চ্যানেলে যখন দেখাত কী ভাবে একটা বাচ্চার জন্ম হয়, আমি হাঁ করে দেখতাম। মা হওয়ার ইচ্ছে নিজের মধ্যে ধারণ করতে করতে আমি বড় হলাম। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এক অদ্ভুত ইচ্ছে জাগল মনে। ইচ্ছে তো ছিল অভিনেত্রী হওয়ার। যখন প্রথম বাড়িতে জানিয়েছিলাম সবাই আঁতকে উঠেছিল। বলেছিল, “তোর মাথার ঠিক আছে তো?” একজন মানুষ শুধু আমার সঙ্গে ছিল। আমার মা। আমার অভিনেত্রী হওয়ার শুরুর দিকে মা সকলের সঙ্গে একা লড়েছিল।AdvertisementAdvertisementমা হওয়ার ইচ্ছে নিজের মধ্যে ধারণ করতে করতে আমি বড় হলাম।

মা হওয়ার ইচ্ছে নিজের মধ্যে ধারণ করতে করতে আমি বড় হলাম।


আমাদের বর্ধমানের পরিবার খুব শিক্ষিত পরিবার। কেউ পড়ানোর দিকে, কেউ আইনের পথে হেঁটেছে। আমাকেও ওই পথেই যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমার মা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, আমি অভিনয় করতে চাই। আমাকে যেন সেটাই করতে দেওয়া হয়। তাই-ই হল। মায়ের অন্য রকম ভাবনা আমায় অন্য ভাবে জগৎ দেখতে শিখিয়েছিল।

একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। আমরা বনেদি পরিবারের মেয়ে, তখন বাইরে পড়তে যেতে হলেও কেউ সঙ্গে যেত। আমি মা-কে বলেছিলাম, ” মা আমি স্কুটি নিয়ে পড়তে যাব। পারব না?” মা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, নিজের জমানো পয়সায় মা আমায় স্কুটি কিনে দিয়েছিল। বাবাকে অবধি বলেনি। মা-ই শিখিয়েছিল, জীবনে ঝড় না হলে শান্তির আলো দেখতে পাব না।সত্যিই এমন শাশুড়ি ভাগ্য করে মেলে।

সত্যিই এমন শাশুড়ি ভাগ্য করে মেলে।


কত কম বয়সে ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছি! জীবনে অনেক ঝড় বাদলের রাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। লড়াই করেছি বলেই এত ইতিবাচক মন নিয়ে থাকি।

রাজের সঙ্গে যে দিন প্রথম মায়ের দেখা হল, সে দিন মায়ের রাজকে খুব পছন্দ হয়েছিল। হবে নাই বা কেন! রাজের মতো অমন ভাল ছেলে, অমন ব্যক্তিত্ব… যে কোনও মানুষ প্রেমে পড়তে বাধ্য।

আমাদের বিয়ে হল। শ্বশুরবাড়ি এসে আর এক মা-কে পেলাম। কোনও দিন আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিলেন না। বললেই বলবেন, ” আমার ছেলেকে কি আমি রান্নাঘরে যেতে বলি? তা হলে তোমায় কেন বলব? তার উপর তুমি নিজের বাড়ি ছেড়ে এসেছ। বরাবর জানবে, তুমি এই বাড়ির সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি যাকে আমি আমার ছেলের থেকেও অনেক বেশি যত্নে রাখতে চাই।”

সত্যিই এমন শাশুড়ি ভাগ্য করে মেলে।আমাদের বর্ধমানের পরিবার খুব শিক্ষিত পরিবার।

আমাদের বর্ধমানের পরিবার খুব শিক্ষিত পরিবার।


এর পর ইউভান এল। আমি অনেক দেরিতে জেনেছিলাম, আমি অন্তঃসত্ত্বা। জীবনের সব আনন্দ একদিনেই যেন পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই ছোটবেলার স্বপ্ন সত্যি হল। আমার মতো করে, খুব সুন্দর করে মা হতে চাই আমি। সেই অতিমারির সময় ইউভান আমার শরীরে মিশে গিয়েছিল। বাইরে মৃত্যু দেখছি আর ভিতরে ইউভানের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি!

এখানেও আমার মায়ের অন্য রকম ভাবনা দেখলাম।

বাচ্চা হওয়ার পরে অন্য মায়েরা কী বলে? একটু আরাম করে থাকতে। কাজ না করতে। আমার মা ঠিক তার উল্টো। ইউভান হতেই মা বলল, আমি যেন দ্রুত কাজে যোগ দিই। খুব দ্রুত শরীর ঠিক করে কাজে মন দিই।

কাজ তো করবই। কিন্তু ইউভান সব কিছুর আগে। ও খুব চিনেছে আমায়। মা-কে ওর চাই-ই। ও আমায় মাতৃত্বের যে অনুভব দিয়েছে, তা চিরকালের। তাই বলে আমি ইউভানকে আঁকড়ে ধরে থাকব, এমন নয়। আমি চাই, ও সকলের মধ্যে বড় হোক। ওর দিদি, পিসি, মাসি– সকলকে চিনুক।
কখনও ওর ঘুমন্ত চোখে, কখনও ওর জেগে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে বলি, ইউভান তুমি এই মৃত্যু উপত্যকায় জীবন্ত প্রাণ। তুমি আমাদের মতো শৈশব পেলে না। জানলে না মাঠের গন্ধ, আকাশে ঘুড়ি ওড়া মুক্তির কথা। একসঙ্গে বসে হুল্লোড় করা…

হবে ইউভান, সব হবে।

দেখ, তোমার মা তোমাকে জল, হাওয়া আর বৃষ্টির মধ্যেই বড় করে তুলবে। যা ইচ্ছে হবে, বড় হয়ে তা-ই হবে তুমি। তোমার হয়ে আমি স্বপ্ন দেখব না। কিছু ভেবেও রাখব না।

তুমি নিজেই আলো হয়ে পৃথিবীকে আলিঙ্গন করবে।

সেই দিন আসছে ইউভান…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.