বাঙালির গান শোনার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের ধারায় প্রথমে এল-পি রেকর্ড, কলের গান, তারপর ক্যাসেট (Cassette), সিডি (CD) হয়ে এখন ডিজিটালে এসে ঠেকেছে। ইউটিউব (Youtube), অডিও জুকবক্স, স্পটিফাই-এর সৌজন্যে বাকি সব বাতিল। কলকাতার (Kolkata) বিখ্যাত সব রেকর্ড-ক্যাসেটের দোকানের অধিকাংশই আজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ধর্মতলা, বিডন স্ট্রিট, চৌরঙ্গী কিংবা দক্ষিণ কলকাতার ফুটপাথেই একসময় রমরম করে বিক্রি হত ঢাউস সাইজের এল পি রেকর্ড, কিংবা আরো পরে টেপ রেকর্ডারের ক্যাসেট।
শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্সের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে কোনও কোনও দোকান সেজে উঠেছে নতুন পসরায়, কোনোটায় পড়েছে তালা। কলকে ফুলের মত দেখতে বিশাল চকচকে গ্রামোফোন (Gramaphone) একদিন ঘরে ঘরে এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে শরদিন্দুবাবুও তাঁর গল্পে ‘মার্ডার উইপন’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন ‘গ্রামোফোনের পিন’। আজও হয়তো কোনো কোনো কলকাত্তাইয়া বাঙালির ঘরে রয়ে গিয়েছে সেই পিন, কিন্তু হারিয়ে গেছে গ্রামাফোনে বাজানোর ঢাউস রেকর্ড (Record) বিক্রির ঐতিহ্য।
ধর্মতলা (Dharmatala) মোড়ের কাছে মেট্রো সিনেমা (Metro Cinema) আর তার পাশেই বহু পুরনো ‘সিম্ফনি’। পোশাকি নাম ‘এম বিশ্বাস অ্যান্ড সিম্ফনি’। একসময় কলকাতার মধ্যে সবথেকে বেশি এল-পি রেকর্ড বিক্রি হত এই দোকানে। দোকানের মালিক প্রেম গুপ্তাবাবুর অবশ্য এখন মুখ ভার। বিক্রিবাট্টা নেই বলেই যে এরূপ বহিঃপ্রকাশ তা বোঝাই যায়। কথার মধ্যে বারবার সেই রাগ এবং আক্ষেপ তুলে ধরেন তিনি। তিনিই জানান, “১৯৮২ সালে প্রথম তৈরি হয়েছিল সিম্ফনি।” যদিও, যুগের হুজুগে ক্রমে ক্রমে কলকাতার ক্র্যাকোফোনি গিলে খেয়েছে এই দোকানটিকেও। ঢাউস এল-পি রেকর্ডের সম্ভারেই তখন সেজে উঠেছিল এই দোকান, কিন্তু আজ আর এখানে সিডি-রেকর্ডের সুসজ্জিত পসরা নেই। তার বদলে আধুনিক জীবনযাত্রার উপযোগী রান্নার সরঞ্জাম আর ডিজিটাল পণ্যে সেজে উঠেছে সিম্ফনি। তিনি আরও বলেন, “উপায় তো নেই পেট চালাতে এখন দোকানে এসব রাখতেই হচ্ছে।”
তখন স্মার্টফোন ছিল না, ইউটিউবের বাড়-বাড়ন্ত তখন কল্পনারও অতীত। তখনও কলকাতার গান পাগল মানুষেরা আন্তর্জালে আটকা পড়েনি। ছায়াছবির গানই হোক বা বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের নতুন অ্যালবাম গান শোনার জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হত এই রেকর্ড, সিডি কিংবা ক্যাসেটের উপর।
যদিও দোকান ঘুরে দেখলে চোখে পড়বে, স্মৃতি হিসেবে এক কোণে শোভা পায় বেগম আখতার, রবিশঙ্কর কিংবা আলাউদ্দিন খানের রেকর্ড, সিডি ইত্যাদি। জানা যায়, ১৯৮২ সালে প্রেম গুপ্তা, এম বিশ্বাস অ্যান্ড কোম্পানির কাছ থেকে এই দোকানটি কিনেছিলেন এই শর্তে যে দোকানের নাম তিনি বদল করতে পারবেন না। আগে এই দোকানে বিক্রি হত বন্দুক-কার্তুজ। প্রেম গুপ্তা সেই গান (Gun) থেকে একেবারে গানের (song) সম্ভারে বদলে ফেলেন এই দোকানকে। কেবলই বাংলা গানের সম্ভার ছিল সিম্ফনিতে। ইন্টারনেট পরিষেবার বাড়বাড়ন্তের কারণে আজ আর সেভাবে রেকর্ড বা ক্যাসেট বিক্রি হয় না এই দোকানে। তাছাড়া বাধ্য হয়ে দোকানের হাল-হকিকত কিছুটা বদলাতে হয়েছে তাঁদের। তিনি বলেন, “রেকর্ড বা সিডি-ক্যাসেট কিনতে এখানে যত না মানুষ ভিড় করেন, তার থেকে বেশি মানুষ এখন প্রেশার কুকার, ওভেন, ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রাংশ কিনতে সিম্ফনিতে আসেন।”
অন্যদিকে হেদুয়ার কাছে বিধান সরণির উপরেই ছিল আরেকটি সিডি-ক্যাসেটের দোকান – ‘মল্লিকা’। সেটিও টিমটিম করছে ডিজিটাল দৌরাত্ম্যের জমানায়। দোকানের বর্তমান কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, “একসময় এই দোকানের খ্যাতি ছিল শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র সহ বিখ্যাত থিয়েটার-ব্যক্তিত্বদের বেতার নাটকের সিডি বিক্রির জন্য। রক্তকরবী হোক বা রাজা অয়দিপাউস, টিনের তলোয়ার হোক বা ব্যারিকেড বেতার-নাটকের সিডি-ক্যাসেটের একমাত্র ঠিকানা ছিল আমাদের এই ‘মল্লিকা’। পরে আমরা আরও বহু বিখ্যাত বাংলা ছায়াছবির রেকর্ডও এখানে রাখতাম।”
তখন স্মার্টফোন ছিল না, ইউটিউবের বাড়-বাড়ন্ত তখন কল্পনারও অতীত। তখনও কলকাতার গান পাগল মানুষেরা আন্তর্জালে আটকা পড়েনি। ছায়াছবির গানই হোক বা বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের নতুন অ্যালবাম, গান শোনার জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হত এই রেকর্ড, সিডি কিংবা ক্যাসেটের উপর। ফলে এই দোকানগুলি ভালোই পসার জমাতে পেরেছিলেন।
দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউর উপর আরেকটি বিখ্যাত দোকান ‘দ্য মেলোডি’। একসময় এখানেই ভিড় করতেন কলকাতার বহু নামী-দামী সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। বেশিরভাগেরই পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের মিলনক্ষেত্র ছিল এই মেলোডি। কিন্তু আজ আর সেই চাঁদের হাট নেই। আশি-নব্বইয়ের মেলোডির মূর্ছনা যে দোকানকে জীবন্ত করে রাখতো এতদিন, তা আজ আর নেই।
সর্বোপরি গান শোনার ধরনও বদলেছে, বদলেছে সরঞ্জামও। টেপ রেকর্ডারের উপর আর নির্ভর করতে হয় না সঙ্গীতপ্রেমীদের, ইউটিউবে নির্দিষ্ট গানের নাম লিখে খুঁজলেই সঙ্গে সঙ্গে হাতের মুঠোয় সেই গান। গ্রামোফোনে আর বাজে না বড়ো বড়ো রেকর্ড। তাই মেলোডিতেও সাজানো ক্যাসেটের ভিতরে রেখে দেওয়া হয় পেন ড্রাইভ, তাতেই ভরা থাকে কাঙ্ক্ষিত হাজার খানেক গান। বেশিরভাগ দোকানদারদের মতে, এখন মিউজিক কোম্পানিগুলি বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিতে সিডির বদলে পেনড্রাইভে গান ভরেই বাজারে ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। অস্তিত্বের সংগ্রামে টিকে থাকতে নতুন যুগের বার্তাকে গ্রহণ করেছে মেলোডি। কিন্তু একই কারণে ক্রেতার অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে মিউজিক ওয়ার্ল্ড। কলকাতার লেনিন সরণির উপর ওয়েলিংটন স্ট্রিট ক্রসিং থেকে শিয়ালদার দিকে একটু এগোলেই আগে চোখে পড়তো সারে সারে দোকান আর তাতে জ্বলজ্বল করছে কালো বড়ো বড়ো সেই রেকর্ড যার পোশাকি নাম লং প্লেয়িং রেকর্ড বা এল-পি রেকর্ড। বহু বিখ্যাত হিন্দি ছবির গানের রেকর্ড আজও সেসব দোকানদারদের সংগ্রহে রয়েছে। পুরোনো বইয়ের মত পুরোনো রেকর্ডও এখানে বিক্রি হয়। ব্যবসার রমরমা না থাকলেও মরা হাতি সোয়া লাখ। রেকর্ড সংগ্রাহকদের ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে আজও বহু পুরোনো দুর্লভ রেকর্ড হাতবদল হয়ে চলে আসে এই চত্বরে আর তার খোঁজেই ঢুঁ মারেন বহু সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ। ফুটপাথের উপরেই এইসব দোকান। রেকর্ড-ক্যাসেটের বিক্রি দিয়ে সংসার চলে না, তাই বাধ্য হয়েই পাশে খুলতে হয়েছে গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির দপ্তর। কিন্তু ঐতিহ্যকে ছেড়ে দেননি তাঁরা, হারিয়ে যেতে দেননি কলের গানের কলকাতাকে।
©সিমন রায়
বঙ্গদর্শন