কালী-সাধক রামপ্রসাদ ইসলাম মতে সাধনা করেন নি কোনোদিন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মের পূর্বেই জীবিত ছিলেন এবং ইহলীলা সংবরণ করেছিলেন৷ তিনিই হিন্দু ধর্মের মধ্যেকার “যত মত তত পথ”-এর সৌকর্য প্রকৃতার্থে বাংলায় তুলে ধরেছিলেন। হিন্দুত্বে অন্তর্ধমীয় নানান পথ অভিন্ন বললেন তিনি এবং তার সমন্বয়ও করলেন। ভারতবর্ষের বহুধা বিভক্ত হিন্দু সমাজ সেই সময় সনাতন ধর্মের ভেতরে সমন্বয় খোঁজার দিকে অধিক মনোনিবেশ করেছিল। ভক্তি আন্দোলন ছিল তারই এক অন্যতম তাগিদ। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলায় আধ্যাত্মিক নবজাগরণ সম্পন্ন হল।

রামপ্রসাদের সময়ে বাংলায় ও ভারতে ছিল মুসলমানী শাসন। রাজার ধর্ম ছিল ইসলাম। কাজেই সমন্বয়ের তাগিদ হিন্দু সমাজেরই অনুভব করার কথা এবং সেটাই হয়েছে। রামপ্রসাদের গানে দেখা গেল, কালীকৃষ্ণে কোনো প্রভেদ তিনি দেখছেন না। অনায়াসে বলতে পারলেন, “শ্যামা হলি মা রাসবিহারী/নটবর বেশে বৃন্দাবনে।” হিন্দু ধর্মে ভেদজ্ঞান তিনি কার্যত দূর করেছিলেন। হয়তো এই ব্যাপারে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেবকেও প্রভাবিত করেছেন। রামপ্রসাদের মহাপ্রয়াণের প্রায় ষাট বছর বাদে শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব। তৎকালীন সময়ে রামপ্রসাদ তাঁর কবিত্বের স্ফূরণে দূর করতে চাইলেন শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, গাণপত্যদের বহিরঙ্গের বৈষম্য৷
“মন করোনা দ্বেষা-দ্বেষী
যদি হবিরে বৈকুন্ঠবাসী।।
আমি বেদাগম পুরাণে
করিলাম কত খোঁজ তালাসি।
ঐ যে কালী, শিব, রাম
সকল আমার এলোকেশী।”
দেখা যাচ্ছে তাঁর সঙ্গীতে শিবরূপে শিঙ্গা ধরেন, কৃষ্ণরূপে বাজান বাঁশি, রামরূপে ধরেন ধনু, কালরূপে হাতে অসি৷ তাঁর কাব্যে শ্মশানবাসিনী শ্যামা, অযোধ্যা নিবাসী রাম অথবা গোকুল নিবাসী কৃষ্ণ একাকার। শ্রীরামকৃষ্ণের “যত মত তত পথ”-এর পূর্বে হিন্দু ধর্মের মধ্যে একত্রীকরণের বীজ বাংলায় নিহিত ছিল রামপ্রসাদের কাব্যে। অষ্টাদশ শতকে বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয় রামপ্রসাদের নেতৃত্বে।

“যে গাব গাছ হইতে তিনি ভাবের ঘোরে পদ্মফুল আনিয়া মায়ের পায়ে দিয়াছিলেন, তাহা তখনও তাঁহার জীর্ণ চালার পাশেই রহিয়াছে। তখনও প্রতি বৎসর সেখানে কালীপূজা হইত।” ১৮৯৬ সালে হালিশহরে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ স্বামী অখণ্ডানন্দ মহামায়ার-দুলাল রামপ্রসাদের সাধনপীঠ দর্শন করে ‘স্মৃতি-কথা’ গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করেছিলেন। তন্ত্রাচার্য ও যোগী, পরমপূজ্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের আশীর্বাদ সঙ্গে নিয়ে শক্তির উদ্বোধনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন কুমারহট্ট-নিবাসী (বর্তমান হালিশহরের গঙ্গা তীরবর্তী জনপদ) জগন্মাতার ভাবোন্মাদ কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন।

হালিশহরের স্থান-মাহাত্ম্য কেমন ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’ রচয়িতা মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখায় পাই —
“বামদিকে হালিশহর, দক্ষিণে ত্রিবেণী।
দু’কূলের যাত্রী রবে কিছুই না শুনি।।
লক্ষ লক্ষ লোক এক ঘাটে করে স্নান।
বাস হেম তৈল ধেনু কেহ করে দান।।”
চারিদিকে কলরবের মাঝেও একটি নিরুপদ্রব নির্জনতা, আর তারই মাঝে ঘন সন্নিবিষ্ট ক্ষুদ্র-বৃহৎ বৃক্ষে পরিপূর্ণ একটি স্থান। মাঝে মাঝে এরণ্ডের বিস্তৃত জঙ্গল। অদূরেই পতিতপাবনী গঙ্গা। স্থানটিকে সাধনভজনের জন্য পছন্দ হল। এই উদ্যানের মধ্যেই পঞ্চবটি রচনা করে তার তলায় সর্প-ভেক-শশ-শৃগাল-নরমুণ্ডে পঞ্চমুণ্ডীর আসন তৈরি করে নিলেন রামপ্রসাদ। মাতৃমূর্তি নির্মাণ করে চললো পুজো-হোম-জপতপ। প্রাণ-প্রতিষ্ঠা মাত্রই সাধকের ডাকে মূর্তিমতী হলেন প্রাণময়ী। ভক্তের উদ্বোধনে উদ্বোধিতা ক্ষেমঙ্করী। অভয়ার অভয়পদে সঁপে সঙ্গীত সাধনায় আদ্যাশক্তির স্বরূপ মানুষের চৈতন্যে প্রথিত করলেন। রচিত হল সাধনমার্গের উচ্চতম সঙ্গীত। একশো বছর পরেও তা প্রাসঙ্গিক রয়েছিল পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে। কথামৃতে তার উল্লেখ আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ রামপ্রাসাদী গান গাইতেন। সেই শাক্তসঙ্গীত আজও সমান প্রাসঙ্গিক। পরমহংস যোগানন্দজীও এই সঙ্গীতে ছিলেন আপ্লুত। ভগিনী নিবেদিতা রামপ্রসাদীকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন।

রামপ্রসাদী গানের অন্যতম চমক —
“মন রে কৃষিকাজ জান না |
এমন মানব জনম রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা ||
কালী নামে দেওরে বেড়া, ফসলে তছরুপ হবে না |
সে যে মুক্তকেশীর (মন রে আমার) শক্ত বেড়া তার কাছেতে যম ঘেঁষে না ||”
রাষ্ট্র জীবনে, সমাজ জীবনে কখনো কখনো বেড়া বাঁধতে হয়। ভারত নামক রাষ্ট্রেও বেড়া দেওয়া দরকার। কারণ ভারতবর্ষ বৃহৎ অর্থে একটি মালঞ্চ। বেড়া লাগে ফসলের ক্ষেতেও। বেড়া না দিলে ফসল বাঁচে না। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, “আগে দিয়ে বেড়া/তবে ধরো গাছের গোড়া।” পতিত জমি পুনরুদ্ধারের কথা পাওয়া যাচ্ছে গানের কলিতে৷ জীবন-মালঞ্চের কথা বলেছেন কবি৷ এবং সসীম থেকেই অসীমে চলে গেছেন। গানটি আমাদের সবাইকে দুঃখহারিণী মায়ের চরণ-কমলের অধিকার দিয়েছে, হয়তো কৃষিবিজ্ঞানের সমস্ত ছাত্র-গবেষক-অধ্যাপকদেরও দিয়েছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে গুরুশিষ্য পরম্পরা কী হবে, হয়তো তাও ঠিক করে দিয়েছেন রামপ্রসাদ।
“গুরু বপন করেছেন বীজ, ভক্তি করি তায় সেঁচ না |
তবে একা যদি না পারিস মন, রামপ্রসাদ কে ডেকে নে না ||”
হ্যাঁ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের খুবই কাছে এই পুণ্যশ্লোকের কালীমন্দির, আমাদের অনুক্ষণ পজিটিভ ভাইব্রেশনে অনুরণন করে৷ আমরা কি হালিশহরে গঙ্গার ধারে তাঁর ওই অমূল্য জীবনের স্রোত বইতে দেখেছি? না হলে অতি অবশ্যই যেতে হবে হালিশহর স্টেশন থেকে রিক্সার চড়ে রামপ্রাসাদ ভিটায়। সেখানে স্বয়ং ভক্তবৎসল ভগবতী সাড়া দিয়েছিলেন প্রগাঢ় ভক্তিবলের কাছে। আনুমানিক ১৭১৮ বা ১৭২৩ থেকে ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে তাঁর ইহকাল যাপন। পাশেই ‘চৈতন্য ডোবা’, শ্রী চৈতন্য-স্মৃতিধন্য পুষ্করিণী, যেখানে স্বয়ং চৈতন্যদেব তাঁর পরমারাধ্য গুরুদেব বৈষ্ণব-সাধক ঈশ্বরপুরীর জন্মস্থানে এসে পবিত্র মাটি নিজ বস্ত্রে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ভক্তেরা মৃত্তিকা নিতে নিতে হয়ে উঠলো একটি ডোবা। অর্থাৎ হালিশহর একাধারে বৈষ্ণবপীঠ, আরেক দিকে শাক্তপীঠ।

রামপ্রসাদের কবিত্বময় প্রকাশ তথা কাব্য-বীণার অঙ্কুরোদগমে প্রারম্ভিক অনুপ্রেরণায় ছিলেন কলকাতা নিবাসী জমিদার দুর্গাচরণ মিত্র। সেটা আনুমানিক অষ্টাদশ শতকের চারের দশক। পিতার মৃত্যুর পর সংসার প্রতিপালন করতে অভাবী রামপ্রসাদকে জমিদারীর সেরেস্তায় মাসিক ত্রিশ টাকা মাইনের চাকরি নিতে হল। গোমস্তা-কেরানীদের মধ্যে তাঁর কাজ। কাজের ফাঁকে হিসেবের খাতায় শূন্যস্থান ভরিয়ে ফেললেন নামগানের টেক্সট লিখে। একদিন তা ধরে ফেললেন উচ্চ আধিকারিক। তিনি খাতার ‘হিজিবিজি’ লেখার নিদর্শন সমেত জমিদারের কাছে নালিশ জানালেন। পাতায় পাতায় অমৃতোপম সঙ্গীতের খসড়া পড়ে মুগ্ধ জমিদার! শাসন করতে তলব করতেই হল তাঁকে। রামপ্রসাদ নির্বিকার। খাতায় তিনি লিখছেন মহামায়ার বিশ্ব জমিদারির কথা। ক্ষেমঙ্করীর খাস তালুকের প্রজা হয়ে তিনি তাঁরই খাজাঞ্চি হতে চান। জানিয়েও দেন ভাণ্ডার লুটতে তিনি কোষাধ্যক্ষ হতে চান না, পদের লোভ তার নেই, আছে মোক্ষপদের প্রার্থনা —
“আমায় দাও মা তবিলদারি
আমি নিমকহারাম নই, শঙ্করী।
পদরত্ন ভাণ্ডার সবাই লুটে, ইহা আমি সইতে নারি
ভাঁড়ার জিম্মা যার কাছে মা, সে যে ভোলা ত্রিপুরারি
শিব আশুতোষ, স্বভাবদাতা, তবু জিম্মা রাখ তাঁরি।
আমি বিনা মাহিনার চাকর, শুধু চরণ ধূলার অধিকারী।”
রাশভারি জমিদারের অন্তঃকরণ কেঁদে উঠলো। জিজ্ঞেস করলেন, এ রচনা কার?
যখন নিশ্চিত হলেন; বুঝলেন মায়ার জগতে রামপ্রসাদের আকুতি কিসের জন্য! সে অর্থ নয়, কাম নয়, যশ নয়; বরং জগন্মাতার চরণতলের আকাঙ্ক্ষায়, লীলাময়ীর লীলাখেলায় সঙ্গী হতে তিনি পাগল। এবং তারই অভিব্যক্তি হিসেবের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন তিনি। নিত্যের মাঝে অনিত্যের সন্ধানী এক ভক্ত সন্তান। বুঝলেন স্বার্থপর জগতে তাঁর স্থান বড্ডই বেমানান! জমিদার দুর্গাচরণ তাই চাকরি থেকে ছুটি দিয়ে গৃহবাসের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলেন রামপ্রসাদকে এবং কাব্যচর্চার অনুরোধ করলেন। আমৃত্যু তাঁর জন্য মাসিক বৃত্তির ত্রিশ টাকা বরাদ্দও করলেন।

রামপ্রসাদের কবি প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশে বারি সিঞ্চন করেছিলেন কৃষ্ণনগরাধিপ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। যাঁর সভা অলঙ্কার করে বসতেন পঞ্চরত্ন। তাদের অন্যতম রত্ন ছিলেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, রসিক সম্রাট গোপাল ভাঁড় এবং বিশিষ্ট তান্ত্রিক তথা রামপ্রসাদের গুরু কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র এই নির্লোভ নিরহংকারী ব্যক্তিটিকে ব্রহ্মময়ীর পদতল থেকে টলাতে সক্ষম হলেন না৷ তিনি নিজের রচিত পঞ্চবটির তলায় পঞ্চমুণ্ডীর আসন ছাড়তে নারাজ। যিনি প্রলুব্ধ হন না, পার্থিব ধনসম্পদে তৃষিত নন, শঙ্করী ভিন্ন অন্যের অধীনতা স্বীকার করেন না, তাঁকে মায়ের চরণপদ্মের মকরন্দ থেকে বঞ্চিত করবেন কীভাবে! অতএব চেষ্টায় ক্ষান্তি দিলেন। কিন্তু রুষ্টও হলেন না৷ বুঝলেন —
“ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না–
ওকে দাও ছেড়ে, দাও ছেড়ে।”
মন যদি সে না দিল, তারই মন নিক কেড়ে। তিনি রামপ্রাসাদকে ১০০ একর নিষ্কর ভূ-সম্পদ দান করলেন। আর কবিত্বকীর্তির পুরস্কার স্বরূপ দিলেন ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি।

বাংলায় একটা একসময় ছিল, যখন সমাজজীবন ছিল রামায়ণ ও রামনামে পরিপূর্ণ। বাঙালি তাদের সন্তানের নামে ‘রাম’ কথাটি যোগ না করে পারতেন না। সন্তানকে ডাক দিয়ে পরমাধ্যকেই তাঁরা ডাকতেন। ‘রামপ্রসাদ’ এমনই এক নাম। যদি রামপ্রসাদের বংশতালিকা দেখি, তবে দেখবো সেখানেও ‘রাম’ নামের ছড়াছড়ি। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে তিনি যে ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন, সেখানে আত্মপরিচয় অংশে পূর্বপুরুষের নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে —
“সেই বংশ সম্ভূত ধীর সর্ব-গুণযুত,
ছিল কত শত মহাশয়
অনাচার দিনান্তর জন্মিলেন রামেশ্বর ,
দেবীপুত্র সরল হৃদয়।।
তদঙ্গজ রামরাম মহাকবি গুণধাম,
সদা যারে সদয়া অভয়া।।
প্রসাদ তনয় তার কহে পদে কালিকার
কৃপাময়ী ময়ি কুরু দয়া।।”
দেখা যায় রামেশ্বর সেনের পুত্র রামরাম সেন; তার পুত্র রামপ্রসাদ সেন; রামপ্রসাদের দুই পুত্রের নাম রামদুলাল ও রামমোহন। একইভাবে আমরা দেখতে পাই গদাধর শ্রীরামকৃষ্ণের বংশলতিকায় ‘রাম’-যুক্ত বহু সন্তানের নাম রয়েছে। নরেন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দের বংশলতিকাতেও তাই। বাংলায় শ্রীরাম-উপাসনার ধারা যে কতটা গভীর ও বাস্তব, এ তারই প্রমাণ। ভগবান রাম কেবলই উত্তর ভারতের আরাধ্য নন।

তখন কৃষ্ণনগর নবাব সিরাজদৌল্লার অধীনে শাসিত অঞ্চল। কুমারহট্ট-হালিশহর কৃষ্ণনগরের শাসনাধীন। রামপ্রসাদের সরাসরি শাসক হচ্ছেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। কর্মোপলক্ষে তিনি যাচ্ছেন মুর্শিদাবাদে। সঙ্গে নিয়েছেন পুণ্যশ্লোক সাধককবি রামপ্রসাদকে। গঙ্গানদীর বক্ষে তাদের জলযান। সাধনমার্গের অপরূপ সঙ্গীত কালীকীর্তন গাইছেন সাধক। সে এক প্রসাদী সুর; মধুময় সঙ্গীত; বাউল-কীর্তন-শাস্ত্রীয় ধারা মিলেমিশে অপরূপ তার রাগরাগিণী৷ অমিয় সুধায়, অমল নদীপথ তাতে আপ্লুত। কল্লোলিত নদীর অনুক্ষণ ঢেউও তাঁকে সঙ্গত দিচ্ছে। মহারাজ আবিষ্ট হয়ে আছেন। এমন সময় নবাবী জলযানে জল-বিহারে বেরিয়েছেন নবাব সিরাজদৌল্লা। তিনি শুনতে পেলেন নদীবক্ষের অমৃতোপম সঙ্গীত-মাধুরী। তিনিও আবিষ্ট, পুলকিত, রোমাঞ্চিত। নৌকো ভিড়ালেন মহারাজের তরীর কাছে। তাদের দু’জনকেই তুলে নিলেন আপন তরীতে। নবাব কি বাংলা বুঝবেন! তিনি যে মুসলমান! তার কাছে কী হিন্দুয়ানি পরিবেশন করা যায়। রামপ্রসাদ তাই হিন্দি খেয়াল গাইতে শুরু করলেন, গাইলেন ধ্রুপদ, গজল। নবাব তাতে আনন্দ পেলেন না। বললেন, সেই গানটিই হোক, যা তাঁকে আবিষ্ট করেছে! রামপ্রসাদ এবার উদাত্তকণ্ঠে গাইলেন কালীগান, গাইছেন তো গাইছেন। নবাবের কঠিন হৃদয় তরল হচ্ছে। তিনি ধন্য হচ্ছেন সনাতনী সংস্কৃতির পরত পেয়ে। হয়তো নবাবকে সেদিন বাঙালি করে তুলেছিলেন রামপ্রসাদ। বাঙালির যথার্থ সংস্কৃতিতে সম্পৃক্ত হলেন সিরাজদৌল্লা।

রামপ্রাসাদ কেন লিখতেন প্রসাদী-গান? তাঁর ভক্তিগীতি রচনার উদ্দেশ্য কী ছিল? শাক্ত পদাবলী লিখে তিনি কী সুখ পেতেন? রামপ্রসাদ সঙ্গীতের টেক্সট রচনা করতেন তাঁর ইষ্টদেবতাকে আরাধনার জন্য৷ এটাই তাঁর নিত্যদিনের সাধনা। গান লিখে যশস্বী হতে চান নি। মহামায়ার পুণ্যপরশে হৃদয় যখন মেতে উঠতো, তিনি মুখেমুখেই রচনা করে নিতেন শাক্তসঙ্গীত। হৃদয় উদ্বেলিত তার ভাষা ও শব্দ। যে ভাষায় তিনি ব্রহ্মময়ীকে তুষ্ট করতে চান, তা তো অমৃত হবেই। কিন্তু কতশত গান লিখেছিলেন তিনি? তার সংখ্যা পাওয়া যায় না। সব লিপিবদ্ধও নেই। কালের গর্ভে লোকস্মৃতিতে তা হয়তো প্রকৃতির মধ্যেই মিশে আছে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “এ মহাবিশ্বে কভু হারায় না তো কিছু।” হয়তো আবারও কোনো মাতৃ-আরাধক সেই শব্দ প্রকৃতি থেকে নিষ্কাশন করে গানের টেক্সট করে নেবেন। একটি গানে রামপ্রসাদ নিজেই উল্লেখ করেছেন, “লাখ উকীল করেছি খাঁড়া।” এ থেকে অনুমান করা যায়, তিনি এক লক্ষ শাক্তপদাবলী রচনা করে থাকতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে তার এক শতাংশও সংরক্ষিত নেই। তাঁর গানের বিষয়বস্তু জাগতিক নয়। জগতের মধ্যেই তিনি জগত-বহির্ভূত সত্তাকে লালন করেছেন। বিশ্ব জননীকে নিয়েই তাঁর সাধনা। মাতা-পুত্রের বাক্য-সংলাপ নিয়েই যাবতীয় গানের টেক্সট। মাতৃময়ী দেবী বাঙালি ঘরের মা হয়ে উঠছেন তাঁর মননে। স্বরচিত সেই গানই দেবীকে নানান উপলক্ষে তিনি পরিবেশন করতেন। যখন গাইতেন তার সুমিষ্ট রস সাধকের মনোমন্দির ছেড়ে দেবালয়ের দেবীতে ছড়িয়ে পড়তো। তাই দেবীও গান শোনার প্রলোভনে ছুটে আসতেন তাঁরই কাছে। এই নিয়ে রয়েছে একটি কিংবদন্তী।

একবার এক সুন্দরী যুবতী এলেন তাঁর গর্ভধারিণী মায়ের দুয়ারে। এসে বলছেন, “হ্যাঁগা মা! তোমার রামপ্রসাদ কোথা গা? সে নাকি খুব ভাল গান গাইতে পারে? বনের পশুপক্ষীও নাকি তার গান শুনে মোহিত হয়? আমি লোকের মুখে শুনে — তাই আজ তার গান শুনতে এলাম, সে কোথা মা?” রামপ্রসাদ তখন গঙ্গায় স্নানে গিয়েছেন, তারপরই দেবীকে ভোগ নিবেদন করবেন। মা তাই জানালেন। যুবতী চলে গেলেন। গঙ্গার ঘাটে অবগাহন সেরে উঠেছেন রামপ্রসাদ; সিক্ত বসন। সেই যুবতী গান শোনানোর আর্জি জানাচ্ছেন সাধককে। রামপ্রসাদের তখন তাড়া। গাইতে চাইলেন না তিনি। পুজোর উপকরণ নিয়ে দেবীর কাছে এলেন৷ কিন্তু দেবী অন্তরে শোনালেন তাঁর অনুযোগ। গান শুনতে চেয়ে তিনি কাশী থেকে এসেছিলেন দেবী অন্নপূর্ণা। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন। কথাটি সাংঘাতিক ভাবে বাজলো তাঁকে। সেইক্ষণেই গর্ভধারিনীকে নিয়ে নৌকা ধরে কাশীধামে ছুটলেন। ভয়ঙ্কর ভুল হয়ে গেছে! দেবী এসে ফিরে গেছেন। হায় হায়! পথে রাত্রিযাপনের অবসরে স্বপ্নাদেশ পেলেন, “এরজন্য তোর কাশীতে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই।” সুরধুনী নদীতীরে হালিশহরেও তিনি অধিষ্ঠান করছেন। তিনি সর্বত্র রয়েছেন। রামপ্রসাদ লিখলেন সেই বিখ্যাত গান —
“আর কাজ কি আমার কাশী?
মায়ের পদতলে পড়ে আছে, গয়া গঙ্গা বারাণসী।।
হৃদকমলে ধ্যানকালে, আনন্দসাগরে ভাসি
ওরে কালীপদে কোকনদ, তীর্থ রাশি রাশি।”
রামপ্রসাদ দেখালেন, তাঁর ব্রহ্মময়ী কালী সর্বঘটে, পদে পদে, সর্বত্র বিরাজিত। প্রথমে সাকারবাদী হয়েও, ব্রহ্মজ্ঞানে তিনি হয়ে উঠলেন নিরাকারের উপাসক।

কল্যাণ গৌতম ও সৌকালিন মাঝি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.