বিশ্বে এমন কিছু মহামানবের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই যাঁদের তুলনা কেবলমাত্র তাঁরা নিজেরাই।যেমন ঠিক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তুলনা কেবল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাথেই করা চলে। বীরসিংহের বীর শিশুকে নিয়ে কিছু লেখা একই জেলায় জন্মানো এই ভাগ্যবানের কাছে এক পরম উপাদেয় বিষয়, এতে কোন সন্দেহ নাই। সমাজ- সংস্কারক,শিক্ষাব্রতী, সাহিত্যিক ও মহামানব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনে পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ এর ভূমিকা প্রগাঢ়ভাবে প্রভাব ফেলেছিল।বনমালীপুরে ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের মধ্যম পুত্র রামজয় তর্কভূষণ এর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল উমাপতি তর্কসিদ্ধান্তের তৃতীয় কন্যা দুর্গাদেবীর। রামজয় ও দুর্গা দেবীর জ্যেষ্ঠপুত্র হলেন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। গোঘাটের রামকান্ত তর্কবাগীশের দ্বিতীয় কন্যা ভগবতী দেবীর সাথে বিবাহ হয় ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এই ঠাকুরদাস ও ভগবতী দেবীর পুত্র হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তেজস্বিতা, স্বাধীনতা- প্রিয়তা, সত্যবাদিতা ও সরলতা সকলের কাছে চির প্রসিদ্ধ ছিল। আর এই সকল গুণাবলী তিনি পিতা ও পিতামহের কাছ থেকেই প্রাপ্ত করেছিলেন। পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন অসীম তেজস্বী পুরুষ। পৌত্রের নামকরণ করেন রামজয়- ঈশ্বর,…ঈশ্বরচন্দ্র। শিশু যেন সাক্ষাৎ ঈশ্বর।উত্তরাধিকারসূত্রে রামজয় তর্কভূষণ এর অমিত তেজ ও ঋজু চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সঞ্চারিত হয়েছিল শিশুর মধ্যে। পিতামহ রামজয়ের নয়নের মনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ধারক রামজয় ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যে আগামী ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন। তাইতো তিনি ঈশ্বরচন্দ্র ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই ছোট্ট সদ্যোজাত শিশুটির দিকে এগিয়ে গিয়ে তার ছোট্ট জিভের তলায় আলতা দিয়ে কিছু লিখে দিয়ে বলেছিলেন– “শোনো তোমাদের কালের কথা শুনিয়ে যাই। পরে মিলিয়ে নিয়ো। এই শিশু উত্তরকালে সকলকে পরাজিত করবে,এর প্রতিজ্ঞার পরাক্রমে চতুর্দিক কম্পিত হবে, এর দয়া-দাক্ষিণ্যে সকলে মুগ্ধ হবে। আমি এর দীক্ষাগুরু হলাম। এই বালক অন্য আর কোন গুরু গ্রহণ করবে না। এই বালক ক্ষণজন্মা, অদ্বিতীয় পুরুষ এবং এর কীর্তি দিগন্তব্যাপিনী হবে। আমার স্বপ্নদর্শন আজ সফল হল আমার বংশ আজ পবিত্র হল।”


হয়েছিল ও তাই।মাইকেল মধুসূদন বিদ্যাসাগরের চরিত্র ব্যাখ্যা করেছিলেন চমৎকারভাবে–” Genius and wisdom of an ancient sage ,the energy of an Englishman and the heart of a Bengalee mother. ” অর্থাৎ প্রাচীন ঋষিদের মতো প্রতিভা ও জ্ঞান, ইংরেজদের মত প্রাণ-শক্তি আর বাঙালি মায়ের হৃদয়। এই হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সেকালের বাল্যবিবাহের প্রথা অনুযায়ী ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র 14 বছর বয়সে দীনময়ী দেবীকে বিবাহ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনীকার চণ্ডীচরণ বনেদ্যাপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায় এই সময়ে বিবাহের কোন ইচ্ছা তাঁর ছিল না। কিন্তু বাবার একান্ত অনুরোধে এই বিবাহ করতে তিনি রাজি হন। কিন্তু এরপর তাঁর বিদ্যার প্রকৃত সমুদ্র মন্থন শুরু হয়।বাল্যবিবাহের এই ঘটনা তাঁর জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। আর তাই স্ত্রী শিক্ষার জন্য কেবলমাত্র বালিকাদের উদ্দেশ্যে তিনি 35 টি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ করা এবং বিধবা বিবাহ তথা পুনঃবিবাহ স্থাপনে তিনি ছিলেন বদ্ধ পরিকর। এই বিষয়ে তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ ও লিখেছিলেন।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন বাংলা গদ্য- সাহিত্যের জনক। তিনি সৃজনশীল সাহিত্যের পথে না হেঁটে সমসাময়িককালের প্রয়োজন মেটাতে শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রতিটি লেখা ছিল অতি উচ্চ সাহিত্য মানসের।

পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ অসীম তেজস্বী পুরুষ ছিলেন। তিনি কখনো কারোর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতেন না। এবং তাঁর এই স্বাধীনচেতা প্রকৃতির জন্য তাঁর গ্রাম প্রধান নিজ শ্যালক ও শ্যালকের পরিচিতরা রামজয়ের বিপক্ষেই ছিলেন। রামজয় তাই সর্বদা বলতেন– “এ দেশে মানুষ নাই, সবই গরু।” তিনি সৎসাহসী, নিরহঙ্কারী ও সত্যবাদী ছিলেন। এই সমস্ত গুণই ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল পরবর্তীতে। রামজয়ের রসবোধ ও কম ছিল না! একদিন গ্রামের পথ দিয়ে যেতে যেতে একজন বলল–“ও পথ দিয়া যাইবেন না,–বড় বিষ্ঠা..।” উত্তরে রামজয় বলেছিলেন– ” বিষ্ঠা কই ? সবই তো গরু এ গ্রামে, একটাও মানুষ নাই। ” গৃহত্যাগ করে যখন রামজয় বিভিন্ন তীর্থদর্শনে ছিলেন সেই সময়ে একদিন রাত্রে তিনি স্বপ্নাদেশ পান–” রামজয়! এইবার তুমি পরিবার-পরিজনের কাছেই গৃহে ফিরে যাও, অপেক্ষা করে থাকো। তোমার বংশে শক্তিশালী অদ্ভুতকর্মা এক মহাপুরুষের আগমন হবে। বংশের মুখ,দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে, সে হবে দয়ার অবতার। অবিলম্বে দেশে ফিরে গিয়ে পরিবার রক্ষা করো। পরিবারই মহাপুরুষদের আবির্ভাব ভূমি। সাত্ত্বিক ক্ষেত্র ছাড়া তাঁরা আসেন না। তিনি আসবেন, তোমরা গ্রহণ করো স্রষ্টার এই দান। পালন করো। রক্ষা করো।” পরদিন সকালেই রামজয় গৃহের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বরচিত জীবনচরিতে পিতামহ সম্বন্ধে বলেছেন– “তিনি কখনও পরের উপাসনা বা আনুগত্য করিতে পারেন নাই। তাঁহার স্থির সিদ্ধান্ত ছিল অন্যের উপাসনা বা আনুগত্য অপেক্ষা প্রাণ ত্যাগ করা ভালো। তিনি একাহারী, নিরামিষাশী,সদাচার পূর্ত ও নিত্য নৈমিত্তিক কর্মে সবিশেষ অবহিত ছিলেন।” রামজয় ছিলেন মন ও শরীরে বলবান। তাঁর শারীরিক বল ছিল অসাধারণ। দেহ ও মনের একটা অদ্ভুত মেলবন্ধন ছিল তাঁর মধ্যে। তাই শত-সহস্র বিপরীত পরিস্থিতিকে ও তিনি নিজ অনুকূলে করতে সমর্থ হয়েছিলেন।আর এই একই বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যেও। রামজয় ছিলেন নির্ভীক প্রকৃতির। তিনি সর্বদাই লোহার একটি লাঠি বা দণ্ড হাতে নিয়েই ভ্রমণ করতেন।একবার বীরসিংহ গ্রাম হতে মেদিনীপুর যাওয়ার পথে তিনি একটি ভালুক দেখতে পান এবং একটি বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। এরপর ঐ ভালুকটি ওই গাছের উল্টো দিক হতে আক্রমণ করলে তিনি ভালুকের সামনের দুটি হাত এমন সজোরে ওই গাছে ঘষতে থাকেন যে ভালুকটি প্রায় আধমরা হয়ে যায়। কিন্তু ভালুকের নখের আঘাতের ক্ষত-যন্ত্রণা তিনি প্রায় দু’মাস ভোগ করেন। রামজয় লৌহদন্ডের জন্য সেই সময়ে নির্ভয় যাতায়াত করতে পারতেন। দস্যুরা যে তাঁকে আক্রমণ করেনি তা নয় কিন্তু উপযুক্ত জবাব পেয়ে তারা ও আর পুনঃআক্রমণের সাহস করেনি। রামজয় এই সমস্ত ঘটনা এবং আরো অনেক গল্প শিশু ঈশ্বরকে উপদেশ বা নীতিবাক্যের সুরে শোনাতেন। রামজয়ের পৌরুষ,নির্ভীকতা ও অসম সাহসের প্রতি প্রবল আকৃষ্ট ছিলেন ছোট্ট ঈশ্বর। রামজয়ের
দেহাবসানের পর বাবা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় ও ঠাকুমার কাছ থেকে ঈশ্বরচন্দ্র পিতামহ রামজয় এর আরো অনেক গল্প মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলেন। এবং এ-সমস্তই প্রভাব ফেলেছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন-দর্শনে ও চিন্তনে। রামজয় সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর “বিদ্যাসাগর চরিত”এর একস্থানে বলেছেন–“এই দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁহার পৌত্রকে আর কোন সম্পত্তি দান করিতে পারেন নাই, কেবল যে অক্ষয় সম্পদের উত্তরাধিকার একমাত্র ভগবানের হস্তে,সেই চরিত্র-মাহাত্ম্য অখন্ড ভাবে তাঁহার জ্যেষ্ঠ পৌত্রের অংশে রাখিয়া গিয়াছেন।” সত্যি সত্যিই তাই। ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মের সময় রামজয় রহস্য করে বলেছিলেন– “এঁড়ে বাছুর হয়েছে”। আর এ সম্বন্ধে স্বরচিত জীবনচরিতে বিদ্যাসাগর লিখেছেন –“জন্ম সময়ে পিতামহদেব পরিহাস করিয়া আমায় এঁড়ে বাছুর বলিয়াছিলেন, জ্যোতিষ শাস্ত্রের গনণা অনুসারে বৃষরাশিতে আমার জন্ম হইয়াছিল। আর সময়ে সময়ে কার্যদ্বারা ও এঁড়ে গরুর লক্ষণ আমার আচরণে, বিলক্ষণ আবির্ভূত হইত।” রামজয় বলেছিলেন –“এঁড়ে গরু যেমন ‘একগুঁয়ে’ এ শিশুও তেমনই ‘একগুঁয়ে’ হইবে।” দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রবীণ রামজয় মনে হয় শিশুর ভাগ্যরেখা অথবা হাতের রেখা দেখে বুঝেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের একগুয়েমির পরিচয় তাঁর জীবনে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সময়ে। আর এই ‘একগুঁয়েমি’র ফল হল দৃঢ়প্রতিজ্ঞতা। ঈশ্বরচন্দ্র অত্যন্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন।’বৃষরাশি’তে জন্মগ্রহণ করলে জাতক/জাতিকা ‘একগুঁয়ে’ অথবা ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ হন।

“বৃষবৎ সন্মার্গবৃত্তোহতিরাং প্রসন্নঃ সত্য প্রতিজ্ঞহতি বিশালকীত্তিঃ ।।
প্রসন্নগাত্রো হতি বিশাল নেত্রো বৃষে স্থিত রাত্রিপতৌ প্রসূতঃ”।।

বিদ্যাসাগর ছিলেন অনন্য। কখনো তিনি বড়োলাট, ছোটলাট এর ভবনের সমাদরে কখনো তিনি যতীন্দ্রমোহনের প্রাসাদে আবার পরক্ষণেই তিনি দরিদ্রের পর্ণকুটিরে মুমূর্ষু রোগীর পাশে সকাল-সন্ধ্যা সেবারত অবস্থায়। বিদ্যাসাগরের চরিত্রের মেরুদন্ড টি তাহলে কি ? সে কি জিনিস যা তাঁর হৃদয়ে থাকার ফলে তিনি সোজাপথে চলতে সমর্থ হয়েছিলেন? আর তা ছিল পিতামহ রামজয় প্রদত্ত মানব জীবনের মহত্ব-জ্ঞান। ছোট ছোট গুল্ম আর ঘাসের মধ্যে যেমন দীর্ঘদেহী গাছ দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনিই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই পুরুষসিংহ, নিজের মহৎ মনুষ্যত্বের দ্বারা সমসাময়িক জনগণকে বহু পেছনে ফেলে উন্নত মস্তকে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। এমনও এক সময় এসেছে যখন ধর্ম গুন্ডারা পথে নেমে পড়েছে। বিদ্যাসাগরের রক্ত চাই। কাফেরকে আর এক মুহূর্ত বাঁচতে দেওয়া যাবে না। তখনও তিনি তাঁর অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন পিতামহ নির্ভীক রামজয়ের মতো। তাই বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রজনীকান্ত গুপ্ত যথার্থই বলেছেন–“বিদ্যাসাগর ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ!পৃথিবীতে যে সকল মহাপুরুষ মহৎকার্য্যে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, বিদ্যাসাগর তাঁহাদের অপেক্ষাও মহত্তর।তিনি প্রতিভাশালী পন্ডিত অপেক্ষাও মহত্তর।যেহেতু তিনি প্রতিভার সহিত অসামান্য তেজস্বীতার পরিচয় দিয়াছেন। তিনি তেজস্বী মহাপুরুষ অপেক্ষা মহত্তর, যেহেতু তিনি তেজস্বীতার সহিত স্বার্থত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছেন। তিনি দানশীল ব্যক্তিগণ অপেক্ষা মহত্তর,যেহেতু তিনি দানশীলতা প্রকাশের সহিত বিষয়-বাসনা ও আত্মগৌরব ঘোষণার ইচ্ছা সংযত রাখিয়াছিলেন। “

ড. সুমন পানিগ্রাহী (Dr. Suman Panigrahi)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.