’বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।’ প্রশ্ন হল বীর কে? “সমুকর্ষ-নিঃশ্রেয়সস্য একম্ উগ্রম্/পরং সাধনং নাম বীরব্রতম্”। হিন্দুরাষ্ট্রবাদীরা বলেন ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উৎকর্ষ সাধনের দ্বারা মোক্ষ লাভের যে পরম সাধনা তারই নাম বীরব্রত। যারা এই বীরব্রত পালন করেন তারাই বীর। হিন্দুত্ববাদীরা পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে বীরব্রত প্রার্থনা করেন। এই গুণের দ্বারা তারা ধর্মের সংরক্ষণ করতে সক্ষম হন এবং পরম বৈভব সম্পন্ন হিন্দুরাষ্ট্র পুনর্গঠন করবার সামর্থ্য অর্জন করতে চান। হয়তো পাঠক নিশ্চয়ই মনে মনে বলছেন “ধান ভানতে শিবের গীত” কেন! তাদের দুশ্চিন্তা দূরীকরণের জন্য আমি সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের স্মরণ নিচ্ছি। ধর্ম, দেশপ্রেম, আধ্যাত্মিক-বোধ ও মোক্ষ — হিন্দুরাষ্ট্রবাদের এই চারটি স্তম্ভ। পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ অধ্যয়ন করে থাকবেন। সেইকালে দেশপ্রেমিকদের কাছে ‘আনন্দমঠ’ ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘স্বরাজ গীতা’। ‘আনন্দমঠ’ গ্রন্থে ঋষি বঙ্কিম দেশাত্মবোধকে আধ্যাত্মিক বোধে উন্নীত করেছিলেন। ‘আনন্দমঠ’-এর সন্ন্যাসী-সন্তানদের কাছে দেশই হল তাদের মা, দেশই তাদের উপাস্য দেবী, মা দুর্গা। তাই ভবানন্দ সন্ন্যাসীর মুখে আমরা শুনতে পাই, “আমরা দেশ ছাড়া অন্য মা মানি না- জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। জন্মভূমিই জননী; আমাদের মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, বন্ধু নাই, স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই, তিনিই আমাদের দুর্গা, সর্বশক্তির আধার। তাই বলি তুমি যে হও, ভারতবাসী হইলেই মায়ের সন্তান, আমার ভাই; আর তুমি আমি সমগ্র ভারতবাসী একই জাতি।” বঙ্কিমচন্দ্র তাই দেশপ্রেমকে ধর্মে এবং ধর্মকে দেশপ্রেমে রূপান্তরিত করেছেন। দেশাত্মবোধই যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম তা তিনি পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেছেন। তার ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ উপন্যাসে ‘আমার দুর্গোৎসব’ খন্ডে সর্বপ্রথম তিনি জন্মভূমির মাতৃরূপ দর্শন করান।
আনন্দমঠে এরপর ব্রহ্মচারী সত্যানন্দ ঠাকুর মহেন্দ্রকে মায়ের তিনটি মূর্তি দর্শন করান। এক, মা যাহা ছিলেন। দুই, মা যাহা হইয়াছেন। তিন, মা যাহা হইবেন। অর্থাৎ দেশমাতৃকার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ রূপ — জগদ্ধাত্রী, কালী এবং দুর্গা। অতীতে ভারতমাতা শস্য-শ্যামলা, সম্পদশালীনি, কলা, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তাই তিনি ছিলেন জগদ্ধাত্রী — গৌরবোজ্জ্বল অতীত ভারতবর্ষের প্রতীক। আর তৎকালীন পরাধীন ভারত এবং বর্তমানের দুর্দশাগ্রস্ত ভারত হৃতসর্বস্বা, নগ্নিকা, রুধির সিক্তা, কঙ্কাল-মালিনী মা কালী। আর ভবিষ্যতের ভারতবর্ষ হলেন মা দুর্গা। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় সেই মা দুর্গার বর্ণনা এমনতরো, “মহেন্দ্র দেখিলেন এক মর্মর প্রস্তর নির্মিত প্রশস্ত মন্দির মধ্যে সুবর্ণ নির্মিতা দশভূজা প্রতিমা নবারুণ কিরণে জ্যোতির্ময়ী হইয়া হাসিতেছেন। দশ ভুজ দশদিকে প্রসারিত, তাহাতে নানা আয়ুধ রূপে নানা শক্তি শোভিত। পদতলে শত্রু বিমর্দিত, পদাশ্রিত বীর কেশরী শত্রু নিপীড়নে নিযুক্ত। দিগভুজা নানা প্রহরণ ধারিনী, শত্রু বিমর্দিনি, বীরেন্দ্র পৃষ্ঠ বিহারিনী, দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্য রূপিনি, বামে বাণী বিদ্যা বিজ্ঞানদায়িনী সরস্বতী, সঙ্গে বলরূপি কার্তিকেয়, কার্যসিদ্ধি রূপি গণেশ।” বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনায় এটিই হল ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের ছবি — শক্তি রূপিনি দুর্গতি নাশিনী মা দুর্গা। আর এই ছবি বাস্তবায়িত করিবার মানসেই হিন্দুরাষ্ট্রবাদীরা ধর্ম সংরক্ষণ পূর্বক পরম বৈভবশালী হিন্দুরাষ্ট্র পুনর্নির্মাণের জন্য ইশ্বরের নিকট বীরব্রত চাইছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটিই হিন্দুরাষ্ট্রবাদের মূল কথা। অতএব একথা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, মা দুর্গাই ভারত মাতা, ভারত-ভারতী। এবং দেশসেবা, দেশাত্মবোধ, আধ্যাত্মিকতা, ভারত-আত্মা সমার্থক এবং সমসূত্রে গ্রথিত। ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, প্রণবানন্দ, সুভাষচন্দ্র প্রভৃতি ভারত মনীষী তথা বাংলার বীর সন্তানদের চিন্তন -মনন -কথনের মূল সুর একই ঐক্যতানে ঝংকৃত। আর তা হল রাষ্ট্রসাধনা, মাতৃসাধনা, ধর্ম, দেশপ্রেম, আধ্যাত্ম সাধনা। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুরাষ্ট্রবাদীরা ভারত-মনীষার এই স্বপ্নকে সাকার রূপ প্রদানের জন্য রাষ্ট্র সাধনা করে চলেছেন।
পরাধীন ভারতকে শৃঙ্খলা মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিবেদিত মনীষীদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ সর্বাগ্রগণ্য এবং পথিকৃৎ। তাঁরই স্বদেশ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্বদেশী আন্দোলনের সেই যুগে হাজার হাজার যুবক, নর-নারী ভারত মাতার মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বিপ্লবীদের যেকোনো ঘাঁটিতে তল্লাশির সময়ে স্বামীজীর লেখা কোন না কোন বই পাওয়া যেত। বিপ্লবীদের শিয়রে টাঙানো থাকতো ‘সাইক্লোনিক হিন্দু monk’-এর ছবি আর সেখানে লেখা থাকতো “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।” ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলতেন বীরের মতো এগিয়ে যাও, সিদ্ধিলাভ আমরা করবই। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আমাদের নেতা। তিনি ধর্ম ও কর্মের দ্বারা এমন এক সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন যারা দেশমাতার শৃঙ্খল মোচনে প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত থাকবেন। তিনি বলেছিলেন, “জন্ম হইতেই তোমরা মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত।” প্রকৃতপক্ষে স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে আমরা আনন্দমঠের সন্ন্যাসী ভবানন্দের প্রতিমূর্তি দেখতে পাই। ভবানন্দের সুরে সুর মিলিয়ে তিনি বলেছেন, “অন্য সব দেবতাকে ভুলে আগামী পঞ্চাশ বছর ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্যা দেবী হউন।”
সেইসময় মুক্তি আন্দোলনের নেতারাও স্বামীজীর কাছে যাতায়াত করতেন। কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে দলে দলে তারা শ্রীমা সারদা দেবীকে প্রণাম করতে আসতেন। শ্রীমা বলেছেন, “সকলেই বলছে তারা স্বামীজীর শিষ্য।” তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের দেওয়া মন্ত্র “শিব জ্ঞানে জীব সেবা“-র আদর্শ রূপায়িত করবার জন্য তিনি সন্ন্যাসী সঙ্ঘের সূচনা করেন। রামকৃষ্ণ মঠের সন্ন্যাসীদের একমাত্র ব্রত মানুষের সেবা যা আজও প্রবহমান। রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে বিপ্লবীদের যোগাযোগ ছিল একথা ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্টে পাওয়া যায়। স্বামীজীর লেখা ‘বর্তমান ভারত’ রচনাতে সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা আমরা দেখতে পাই। স্বামীজী দেশ বলতে দেশের মানুষকে বুঝতেন। ভারতমাতার সর্বদক্ষিণ প্রান্ত কন্যাকুমারীর শিলাখণ্ডের উপর উপবেশন করে তিনদিন ধরে স্বামীজি মা ভগবতীর অখন্ড সাধনায় নিমগ্ন হলেন। মা ভগবতী অর্থাৎ মা দুর্গা। ভারত মাতার মানচিত্র উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম তার ধ্যান নেত্রে চিত্রপটের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তার মানস চোখে ধরা দিল ‘নতুন ভারত। অর্থাৎ স্বামীজীর ভাবনাতেও সেই মা দুর্গাই ভারতমাতা, স্বদেশ মাতা, ভারত ভূমি। হিন্দুত্ববাদীদের নিকট তাই স্বামী বিবেকানন্দ আদর্শ পুরুষ।
এখন আমি এমন একজন মহাপুরুষের কথা বিবৃত করব যাকে অগ্নিপুরুষ, শক্তি পুরুষ, সিদ্ধপুরুষ বা আধ্যাত্ম পুরুষ — কোন বিশেষণেই পূর্ণরূপে ব্যক্ত করা যায় না। তিনি ঋষি অরবিন্দ, পূর্বাশ্রমের নাম শ্রী অরবিন্দ ঘোষ। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীনই ভারত আত্মার মুক্তির জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলে ভাষণ দেন। আইএএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান করে তিনি বরদা কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। বরদা কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীনই বিপ্লবের কাজ শুরু করেন। এই বরদাতেই ভগ্নী নিবেদিতার সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় এবং তারই সহায়তায় কলকাতাতে গুপ্ত সমিতি স্থাপন করেন। পরে ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রর অনুশীলন সমিতির সহ সভাপতি হন। ভারত মাতাকে শৃঙ্খলা মুক্ত করার কাজকে তিনি ঐশ্বরিক কাজ বলে মনে করতেন। তিনি আরো বলতেন মাতৃভূমির মুক্তিসংগ্রামের জন্য চাই দেশপ্রেম, আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়। বন্দেমাতরম পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালীন তিনি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। ফলে ইংরেজ সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। মৃন্ময়ী মাতৃভূমিকে তিনি চিন্ময়ী মাতৃরূপে দেখতেন। তার কাছে দেশমাতাই ছিল দেবি দুর্গা। রাষ্ট্র সাধনাকে তিনি শক্তিপূজা, দেশমাতৃকার পূজা মনে করতেন। সত্যি বলতে কি ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের কল্পিতচরিত্র সন্ন্যাসী নেতা, সন্তান দলের পুরোধা, মঠ অধিপতি, দেশভক্ত সত্যানন্দ ব্রহ্মচারীর জীবনবেদের বাস্তব রূপ আমরা শ্রীঅরবিন্দের জীবনীতে প্রকটভাবে দেখতে পাই। পাঠকগণ যারা শ্রীঅরবিন্দের সেই ছোট্ট পুস্তিকা ‘ভবানী মন্দির’ পাঠ করেছেন তারা সবাই আমার সাথে একমত হবেন। স্বদেশপ্রেম কোন উচ্চতায় পৌঁছালে তা অধ্যাত্ম-সাধনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে তা এই ছোট্ট পুস্তিকা না পড়লে বোঝা যাবে না। এই পুস্তিকাটিতে তিনি একটি মন্দির নির্মাণের কথা বলেছেন, যে মন্দিরের দেবী হবেন দেশ জননী মাতৃরূপা ভবানী ভারতী। ভবানী হলেন মা ভারত মাতা — যিনি প্রেম, জ্ঞান, ত্যাগ ও দয়ার প্রতিমূর্তি। নিজের সমগ্র সত্তার মধ্যে দেশমাতা মাতৃরূপা দেবী দুর্গা মিলেমিশে একাকার নাহলে এ পুস্তিকা লেখা যায় না। শুধুমাত্র এই বোধ জন্মালেই কেউ দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারেন। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বালক ক্ষুদিরামের মত নির্ভীক কণ্ঠে বলতে পারেন, “আমি অক্ষয়,আমি অব্যয়, আমাকে মারে কার সাধ্য!” ইতিহাসের জঞ্জাল যে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় এবং অরবিন্দ সহ ৩৬ জন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক বৎসরের অধিক কাল বন্দি দশা কাটানোর সময় অরবিন্দ মহাজাগতিক চৈতন্য প্রভায় প্রভাবিত হন। তিনি ধর্ম ও দর্শন নানা বিষয়ে লিখতে থাকেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রখর যুক্তিবাদী সওয়ালের ফলে অরবিন্দ সহ সতের জন বিপ্লবী মুক্তি লাভ করেন। বিপ্লবের তীর্থভূমি বাংলায় তার শেষ আশ্রয় উত্তরপাড়া। যেখান থেকে তিনি উচ্চমার্গের আধ্যাত্মিকতা ও দেশপ্রেম সম্বলিত পুস্তিকা ‘উত্তরপাড়া অভিভাষণ’ স্বাধীনতা সাধকদের হাতে অর্পণ করে পন্ডিচেরি চলে যান এবং অখন্ড আধ্যাত্মিক সাধনায় মনোনিবেশ করেন। অরবিন্দ ঘোষ হয়ে ওঠেন মহাঋষি শ্রী অরবিন্দ। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্য ‘সাবিত্রী’ শেষ করেন। ‘সাবিত্রী’ কাব্যের নায়িকা সাবিত্রী হলেন বিশ্ব জননী, বিশ্ব মাতা, দেশমাতা দেবী দুর্গা। ‘ভবানী ভারতী’ নামক সংস্কৃত কাব্যে ভারত মাতাকে তিনি সর্বপ্রথম কালী রূপে ও তারপর বিভিন্ন রূপে যেমন সনাতনী, দশভূজা দুর্গা, অন্নপূর্ণা, রাধা, ভবানী, মহেশ্বরী এবং ভারতের ভারতী রূপে প্রকাশ করেছেন। ‘ভবানী মন্দির’-এর জীবন্ত বিগ্রহ মা ভবানী ঘোষণা করছেন, “আমিই বিশ্ব জননী, জগত জননী, আর তোমরা যারা এই পবিত্র আর্য ভূমির সন্তান, যারা তার মাটিতে জন্ম নিয়ে তার আলো-বাতাসে প্রতিপালিত হচ্ছো, তাদের কাছে আমি ভবানী ভারতী ভারতমাতা।” পন্ডিচেরিতে যারা শ্রী অরবিন্দের সাধন কক্ষ দর্শন করেছেন তারা জানেন, সেখানে যে বিগ্রহকে সামনে রেখে তিনি ধ্যান মগ্ন হতেন তা হলো অখন্ড ভারতবর্ষের মানচিত্রের উপর ভারতমাতার একখানি চিত্রপট।
এরপর ভারত ভারতী তথা মা ভবানীর সুযোগ্য সন্তান বিদ্যাদেবীর বরপুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে দু’একটি কথা না বলে পারছিনা। তিনি একাধারে বিশ্বকবি, ঋষি তথা দার্শনিক ও অাধ্যাত্ম পুরুষ। তার মূল কথা বন্ধনমুক্তি অর্থাৎ মোক্ষ। “এবার আমারে লহ করুণা করে”- ঈশ্বরের পায়ে নিঃশর্ত সমর্পণ। মনুষ্যত্বের মুক্তিই দেশের মুক্তি। সীমার মাঝে অসীমের সন্ধানই যে তার মূল দর্শন তা তার রচিত একটি গানের লাইন উদ্ধৃত করলেই বোঝা যাবে। হিন্দু রাষ্ট্রবাদের দর্শন “সর্বভূতে ঈশ্বর বিরাজমান” — এ সত্য তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি গেয়েছেন, “সীমার মাঝে অসীম তুমি,/বাজাও আপন সুর।/আমার মাঝে তোমার প্রকাশ,/তাই এত মধুর।” অর্থাৎ, সর্ব জীবে তারই অমল উপস্থিতি, তারই প্রকাশ। সীমা ছেড়ে অসীমের পানে যাত্রা। ব্রাহ্মধর্মের গন্ডি পেরিয়ে ভারত ধর্মের পথ বেয়ে বিশ্বধর্মে বিলীন। দেশ কালের গণ্ডি পেরিয়ে অনন্ত বিশ্বে যাত্রা অর্থাৎ ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, বিশ্ব মানবতাবাদ, হিন্দুত্ববাদ।
আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তো স্বামী বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য — এ কথা সবাই জানেন। ঋষি অরবিন্দের সুযোগ্য উত্তরসূরী, সশস্ত্র সংগ্রামের নায়ক। মতবিরোধের কারণে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ছদ্মবেশে বিদেশযাত্রা ও সশস্ত্র সৈন্য দল আইএনএ গঠন করেন। ইংরেজের বাধা ও রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে সুভাষচন্দ্র ‘ভারতমাতা’-র বিগ্রহ গড়ে পূজা করেছিলেন, এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র অবধি সমস্ত ভারত মনীষীদের চিন্তা-চেতনায় যে একই সুর ঝংকৃত তা পাঠক মাত্রেই স্বীকার করবেন ।
অতএব সুধী পাঠকগণ, আশা করি মা দুর্গা ও হিন্দুরাষ্ট্রবাদের সম্পর্ক, আরো স্পষ্ট করে বললে শক্তিপূজা (কারণ মা দুর্গা সমস্ত দেবগণের সম্মিলিত শক্তির আধার) ও হিন্দু রাষ্ট্রবাদের সম্পর্ক স্পষ্টরূপে আপনাদের হৃদয়ে স্ফুরিত হল। আসুন সবাই মিলে স্বামী বিবেকানন্দের সুরে স্বর মিলিয়ে উচ্চকণ্ঠে আকাশ-বাতাস মুখরিত করি –
”পুতুল পূজা করে না হিন্দু
কাঠ মাটি দিয়ে গড়া।
মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে
হয়ে যাই আত্মহারা।।”
পরিশেষে এই বলে শেষ করতে চাই যে, প্রাচীন পরম্পরাই আমাদের জীয়নকাঠি। ভারতের গৌরবময় উজ্জ্বল অতীত ইতিহাসের ধারক ও বাহক হয়ে যদি আমরা দেশকে আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে চাই, তবে ভারত মনীষীদের অনুসৃত পথে শক্তিপূজা অর্থাৎ ভারত ভবানীর পূজা (নিঃস্বার্থ দেশসেবা)-র মাধ্যমে হিন্দু রাষ্ট্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই দেবী দুর্গার আরাধনা সার্থকতা লাভ করবে।
(ডাক্তার নিত্যগোপাল চক্রবর্তী, সদস্য, শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস পশ্চিমবঙ্গ প্রান্ত)
ডা. নিত্যগোপাল চক্রবর্তী (Dr. Nityagopal Chakraborty)