শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী

কল্যাণ গৌতম।

১৯৩৪ সালের ৮ ই আগষ্ট মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ভারতবর্ষের সর্বাপ্রেক্ষা বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে আসীন হলেন শ্যামাপ্রসাদ। পিতাপুত্র কোনো একটি ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রসরতাকে প্রবলগতি-সম্পন্ন করেছেন এমন উদাহরণ সম্ভবত একটিই — উপাচার্য হিসাবে স্যার আশুতোষ মুখার্জী এবং তাঁর উত্তরাধিকারী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী৷ আশুতোষের প্রয়াণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে উৎকর্ষতার যারপরনাই অভাব অনুভূত হয়েছিল; তা একাগ্রতায়, অধ্যাবসায়ে, সাধনায় ও প্রজ্ঞায় পূরণ করে দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে ও প্রশাসনে দুজনেই উল্লেখযোগ্য রূপান্তর সাধন করেছিলেন। আশুতোষের হাতে উপাচার্যের দায়িত্ব ছিল ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এবং তারপর দ্বিতীয় দফায় ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত। জীবদ্দশায় পিতার শিক্ষাচিন্তার সঙ্গে সম্যক পরিচিতি লাভ করার সুযোগ পেয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। সামান্য সময়ের জন্য হলেও পরিচালনার কাজ একসঙ্গে করার সুযোগ ঘটেছিল। কারণ ১৯২৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় সেনেটের সদস্য মনোনীত হন তিনি, তার কয়েকমাস বাদে পিতার মৃত্যু ঘটে। তারপর তিনি সিন্ডিকেটেরও সদস্য হলেন। তখন তাঁর বয়স মোটে ২৩। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মনে করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে অভাব অভিযোগ জানানোর একমাত্র পাত্র হচ্ছেন শ্যামাপ্রসাদ। ১৯২৫ সালে একটি চিঠিতে প্রফুল্লচন্দ্র লিখছেন, “University-র ব্যাপারে তুমি দেখিতেছি বাপ কা বেটা হইয়াছো। কেননা এত অক্লান্ত পরিশ্রম ও স্বার্থত্যাগ কেহই করিতে পারিবে না।” ১৯৩৪ থেকে ৩৮ সাল পর্যন্ত উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ তথা কর্মবহুল যুগ হচ্ছে পিতার ১০ এবং পুত্রের এই চার বছর মেয়াদি উপাচার্য পদে আসীন হবার কালপর্ব। অনেকের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কুশলি কার্যকর্তা হিসাবে অনেকদিন থেকেই De facto উপাচার্য ছিলেন, ১৯৩৪ থেকে হলেন De jure উপাচার্য। বিদায়ী উপাচার্য স্যার হাসান সুরাবর্দীও তাঁর নিয়োগে উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

উপাচার্য পদ থেকে সরে যাবার পরও ১৯৫২ সাল পর্যন্ত শ্যামাপ্রসাদ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে যা বক্তব্য রেখেছেন, তার মধ্যে মৌলিক শিক্ষাচিন্তার নির্যাস রয়েছে। ১৯৩৭ সালে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে বললেন, পরাধীন ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থার সকল স্তরের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার রয়েছে। ভারতবর্ষে নানা প্রান্তে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে বৈচিত্র্য রয়েছে, তার মধ্যে ঐক্যসূত্রটি তুলে আনা দরকার। যখন ১৯৪৩ সালে গুরুকূল বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন ভাষণ দিচ্ছেন ততদিনে বুঝতে পেরে গেছেন ভারতের স্বাধীনতা কেবল সময়ের অপেক্ষা। তাই উত্থাপন করলেন জাতীয় শিক্ষানীতির প্রসঙ্গ। এইভাবে বাংলার শিক্ষাবিদ হিসাবে ভারতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বললেন, জাতীয় শিক্ষার এমন একটি সুস্থ নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখতে চাই যা সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে পার। এই প্রসঙ্গে তিনি কতকগুলি দিক চিহ্নিত করলেন যা পরবর্তীকালে দেশের শিক্ষাবিদদের কাছে তা মার্গদর্শন হয়ে উঠলো, যেমন — সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত জাতীয় ভাষাগুলির মাধ্যমে পঠন-পাঠন ও পরীক্ষার ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়া, দেশের প্রয়োজন ও প্রত্যাশা মেটাতে পাঠ্যসূচী পুনর্বিন্যস্ত ও নবায়িত করা, ভারতীয় সভ্যতার মৌলিক উপাদানগুলির সঙ্গে বৈজ্ঞানিক যুগের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলির সুষ্ঠু সমন্বয়ের পদ্ধতি।

ড. শ্যামাপ্রসাদকে ত্রিভাষার প্রয়োজনীয়তার কথা সওয়াল করতে দেখা যায়। আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষা, জাতীয় ভাষা যা ভারতের সর্বত্র যোগাযোগ রক্ষার ভাষা এবং আন্তর্জাতিক ভাষা যা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অপরিহার্য। ভাষা সম্পর্কে তিনি গোলমেলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবার পক্ষপাতি ছিলেন নি। ইংরাজী ভাষা ব্রিটিশের ভাষা বলে উপেক্ষা করেন নি, আবার প্রাচীনতম সংস্কৃত ভাষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে তার মধ্যেকার মণিমাণিক্য সংগ্রহে জোর দিয়েছেন।
নারী শিক্ষার প্রতি যত্নবান শিক্ষাবিদ হিসাবেও তাঁর বিশিষ্ট অবদান আছে। মহিলাদের জন্য গার্হ্যস্থ বিজ্ঞান পাঠ্যক্রমের সূচনা করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরও যে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সকলের, তা হল কলকাতায় কৃষিবিদ্যা অধ্যয়নের ব্যবস্থা; ফলিত পদার্থবিদ্যায় Communication Engineering পাঠক্রমের আয়োজন, শিক্ষকদের শিক্ষাদানে দক্ষ করে তুলতে Teachers Training Course -এর প্রবর্তন, প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতির নিদর্শন সংরক্ষণ, চর্চা ও গবেষণার জন্য মিউজিয়াম স্থাপন ইত্যাদি।

শরীরচর্চা যে জাতি গঠনের অন্যতম বিষয়, তা বুঝেছিলেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে খেলাধূলার উন্নতিতে তাঁর অনন্য পরিকল্পনা ও রূপায়ণ ছিল।
১. ছাত্রদের খেলাধূলা এবং ব্যায়াম চর্চার ব্যবস্থা করলেন।
২. ঢাকুরিয়া লেকে তৈরি হল University Rowing Club.
৩. তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হল University Athletics Club.
৪. ময়দানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা খেলার মাঠের ব্যবস্থা হল। ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.