জাতীয় জীবনে শক্তি সংহতি, শক্তি সাধনার প্রবর্তন যে জরুরি, উপলব্ধি করেছিলেন যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ ও প্রণব মঠে মহাশক্তি শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

১৯৪০ সালের অক্টোবর মাস। কাশীধামে সঙ্ঘের দুর্গাপূজা ও উৎসব-সম্মেলনের আয়োজন করেছেন তিনি। সম্মেলনের দিনকয় আগে আচার্য দেব বলছেন, শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে এসো এখানে। কিন্তু তিনি কীভাবে এখানে আসবেন এখন, বিস্ময়ে হতবাক সঙ্ঘ-সন্তানেরা। তিনি কী এখন কাশীধামে অবস্থান করছেন? তিনি কী এখানে এসেছেন? আচার্যদেব জানালেন, “এসেছে, খুঁজে দেখো”। আর আসবেন নাই বা কেন! সে বছরই যে জন্মাষ্টমীতে বিরাট হিন্দু সম্মেলনের মঞ্চে অনন্ত আশীর্বাদ করে শ্যামাপ্রসাদের গলায় আপন মাল্য পরিয়ে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “বাঙালী হিন্দুর সামনে দাঁড়াবার লোক ঠিক করে দিলাম।” শ্যামপ্রসাদ এখন তাই ‘যন্ত্র’, আর আচার্যদেব ‘যন্ত্রী’

ভক্তমণ্ডলী খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, শ্যামাপ্রসাদ সপরিবারে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছেন। এবার তাই শক্তিদান করে দিতে হবে সেই আধারকে, দেবীর কাছ থেকে নিয়ে তা তুলে দেবেন এক আগামী দিনের হিন্দু রাজনীতিবিদকে। তবেই তিনি বাঙালীর পরিত্রাতা হতে পারবেন। শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে আপনার সকল শক্তি, যা তাকে হিন্দু বাঙালীর জন্য লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে সহায়তা করবে, পায়ের তলায় শক্ত জমি দেবে। এই ঐশীকর্মে দেবী দুর্গা অন্যতম সহায়ক শক্তি। দুর্গাপূজাকে এইভাবেই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন স্বামী প্রণবানন্দজী। সঙ্ঘের দুর্গাপূজার মূলসুরটি ছিল এভাবেই বাঁধা

সঙ্ঘের সন্ন্যাসীরা তাঁর নির্দেশ পেয়ে শ্যামাপ্রসাদের কাছে গেলেন, “স্বামীজি মহারাজ আপনাকে স্মরণ করেছেন, চলুন একবার আমাদের আশ্রমে।” রাজি হলেন শ্যামাপ্রসাদ। মহাষ্টমীর দিন সকালে সপরিবারে আচার্যদেবের সম্মুখে উপস্থিত হলেন, মায়ের চরণে অঞ্জলি দিলেন, তারপর আচার্যের প্রকোষ্ঠে একাকী প্রবেশ করলেন। সেখানে কী ব্রত নিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, কি আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন তিনি? হ্যাঁ, সেদিনই বাঙালী হিন্দুর বাঁচবার জন্য এক চিলতে জমি পাবার পথ প্রশস্ত হল, পশ্চিমবঙ্গ গঠনের অন্যতম রূপকার তৈরি হয়ে গেলেন দেবী দুর্গার ঐশী আবেশে।

ধর্মযুদ্ধে বিজয়লাভের জন্য ধর্মসেনার মধ্যে মহাশক্তির প্রেরণা সঞ্চারের প্রয়োজন হয়, তারজন্যই দরকার হয় মহাশক্তির সাধনা। আজ আমাদের রাজনীতির ব্যাপারীরা দুর্গাপূজার তাৎপর্য ভুলিয়ে দিয়েছেন। তা একটি উৎসবে পরিণত করে দিয়েছেন, নামটি আর ‘দুর্গোৎসব’-ও নেই, হয়েছে ‘শারদোৎসব’, যাতে মা দুর্গার শক্তিপূজার সকল কথা হিন্দু বাঙালী ভুলে যায়। যাতে অস্ত্র পূজার কথা আমরা মনে না রাখি, আমরা পলায়নপর একটি ভীতু জাতির তকমা আদায় করে ফিরি। যে দেবীর দশহাতে আয়ুধ, তার উপাসক কেন আপন জমি-জিরেত ছেড়ে ভয়ে পালাবে? দেবী দুর্গার উপাসক কেন দেশান্তরী হবে? এই প্রশ্ন নিজেকে করেছিলেন বলেই স্বামী প্রণবানন্দ শক্তি সাধনার ধারা বাঙালী হিন্দুকে ভুলতে দেন নি। তিনি জাতীয় জীবনে মহাশক্তির লীলা প্রকট করতে চেয়েছিলেন। প্রজ্ঞালোকে দেখছিলেন শ্রীশ্রী দুর্গারাধনার মধ্যেই রয়েছে এক মহাসঙ্কল্পের কোটি কোটি বীজ। সেই যাবতীয় বীজ ভারতবর্ষ নামক বৃহত্তর উদ্যানে বপন করে দিতে হবে।

দুর্গাপূজা হুল্লোড়ের পার্বণ নয়; শক্তি সংহতির পার্বণ, অস্ত্রপূজার পার্বণ, আপনার বোধের মধ্যে ভেতর থেকে শক্তি জোগানের পার্বণ। বাঙালী হিন্দু তা কবে বুঝবে? এই বছর স্বামী প্রণবানন্দের আবির্ভাবের ১২৫ বছর, তাই তাঁকে স্মরণ-মননের সেরা বোধ এবং সেরা পুষ্পার্ঘ্যটি হতে পারে দেবীর শক্তিসত্ত্বাকে জীবনের যাবতীয় কাজে ব্যবহার করে বাঙালী হিন্দুকে সংহত করা। অচিরেই শক্তিবৃক্ষের ফুল ফুটুক, আর তাই দিয়েই হোক দেবী আরাধনা। শক্তি আবেশে শরীরচর্চা ও মানসচর্চা জরুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.