দুস্একটি উপসর্গ, যা খারাপ, কঠিন পরিস্থিতি ইত্যাদি অর্থ করার জন্য প্রয়োগ করা হয়। যখন স্বরবর্ণ বা ঘোষবর্ণ আদিতে থাকে তখন ‘দুস্’ পরিবর্তিত হয়ে ‘দুর্’ হয়ে যায়
‘গ’ বর্ণ গতিময়তা, সমাপ্তি ইত্যাদি অর্থে প্রয়োগ করা হয়।
অর্থাৎ যা দুরবস্থা বা দুর্গতি থেকে গতিমান করে বা সমাপ্তি ঘটায় এরূপ শব্দের অর্থ ‘দুর্গ’। এবং স্ত্রীলিঙ্গ বোধক শব্দ ‘দুর্গা’।
শ্রীশ্রী সপ্তশতী চন্ডীতে দেবী স্বয়ং বলছেন (১১/৪৯-৫০),
তত্রৈব চ বধিষ‍্যামি দুর্গমাখ‍্যং মহাসুরম্।।
দুর্গা দেবীতি বিখ‍্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।

সেই শক্তি বা দেবী যিনি দুর্গমাসুরকে বধ করার পরে বা বধ করার জন্য ওনার নাম হবে ‘দুর্গা’।

কোনো কোনো সাহিত‍্যিক তথা গবেষক বলেন, ঋগ্বেদে দুর্গা নাম নেই। অবশ্যই সত্য যে দুর্গা নাম নেই। কিন্তু এর অর্থ এই করলে ভুল হবে যে, ‘দেবী দুর্গা নেই’। সংসারে নাম সম্বোধন করার একটি উপায় মাত্র। যদিও নামকরণে সংস্কার, তার ব‍্যবহারিক ও অন্যান্য বিশেষ কারণ আছে। কিন্তু অধ‍্যাত্মে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নিয়ে নামকরণ করা হয়। যখন সেই উদ্দেশ্য পূরণ না হয়, ততকালে ওইনাম প্রকাশিত হবে না বা গুপ্ত থাকবে। কিন্তু সংকেত বা প্রমাণ অবশ্যই থাকবে। ‘সন্ন‍্যাস সংস্কার’-এ এর প্রতিফলন দেখা যায়।
ঋগ্বেদের দেবীসূক্তের দ্বারা যেই দেবীর বন্দনা করা হচ্ছে, যে দেবী নিজেকে-“অহং রুদ্রেভির্বসুভি…” আদি বাক্য দ্বারা পরিচিত করাচ্ছেন, সেই দেবীই চন্ডীতে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন (১১/৪৯-৫০)।
যাঁকে বর্তমানে যজ্ঞোপবীতধারী সন্ধ‍্যোপজীবি আহ্বান জানান এবং পূর্বে সমগ্র ভারত-ভারতী আহ্বান করতেন- “আয়াহি বরদে দেবী …“, এই দেবীই মধ‍্যাহ্ন কালে যজুর্বেদধারিণী। সামবেদীয় কেনোপনিষদে – উমা হৈমবতী দেবীর যে আত্মপ্রকাশের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, সেই দেবীকেই অথর্ববেদে -“শন্নো দেবীরভিষ্টয়ে …” মন্ত্রে স্মরণ করা হয়েছে। সেই দেবীই অবতার কালের ইতিহাসে মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করতে এবং রাবণকে বধ করার জন্য আবির্ভূতা হয়েছিলেন (বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, পূর্বখন্ড, ২২/১১), “ত্বং বৈ শক্তী রাবণে রাঘবে বা রুদ্রেন্দ্রাদৌ….

কৃষ্ণাবতার কালে ব্রজবালাদের প্রার্থনা যে দেবীর উদ্দেশ্য ছিল “কাত‍্যায়নী মহামায়ে মহাযোগিন‍্যধীশ্বরী…”, আবার দেবী ভাগবতে (৫/১৮/২২) সেই দেবীই বচনবদ্ধ হচ্ছেন,”যদা যদা হী সাধুনাং দুঃখং ভবতি দানব।/তদা তেষাঞ্চ রক্ষার্থং দেহ সংধারয়াম‍্যহম।।
এই বচনবদ্ধতা স্মরণ করিয়ে দেয় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় সেই শক্তিরই পুরুষরূপী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বচনবদ্ধতাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের বাণীতে আছে, “একই ব‍্যক্তি যখন রান্না করেন, তখন ‘পাচক’, যখন পূজা করেন, তখন ‘পূজক’, যখন সেবা করেন, তখন ‘সেবক’ নামে পরিচিত হন।” একই শক্তিকে কোনো সাধক সখা বা পিতা ভাবে আরাধনা করেন, আবার অন‍্য কোনো সাধক সখী বা মাতৃ ভাবে আবাহন করেন,-“ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং।” মহানির্বাণ তন্ত্র (৪/১৬-১৭) বলছেন, “উপাসককে সহায়তা করার জন্য সেই শক্তিই দ্বিভুজা, বহুভুজারূপে আবির্ভূতা হন।” আবার অভুজ মহাপ্রভু জগন্নাথ রূপেও প্রকট হন। সাধকের কষ্ট নিবারণের জন্য শতাক্ষী রূপে বর্ষা করান, আবার শাকম্ভরী রূপে ভোজন করান।

অদ্বৈত বেদান্তের মূল সিদ্ধান্ত ‘একমেব অদ্বিতীয় ব্রহ্ম’, পূর্ব মীমাংসার ‘একোহং বহুশ‍্যাম্’, নীতির ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’…ইত্যাদি ভাবনা, যা ভারতবর্ষের মহানতা,অখন্ডতা এবং বিশেষতা দর্শায় সেই বিচারই শ্রীসপ্তশতীরও “একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।” একই সঙ্গে স্মরণীয় স্বামী বিবেকানন্দের, ‘আমার ভারত অমর ভারত’ প্রমাণ করার জন্য, দেবী আশীর্বাদ করছেন, বলছেন, যতদিন সৃষ্টি আছে ততদিন ভারতীয় সংস্কৃতি অমর, (বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, পূর্ব খন্ড, ২২/১৬) “এবং ক্ষিতিতলে স্বর্গে পাতালে চ নরাদয়ঃ।/অর্চিষ‍্যন্তি বিশেষেণ যাবৎ সৃষ্টি প্রবর্ততে।।” যতদিন সৃষ্টি থাকবে, যতদিন থাকবে এই স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল, সুর এবং নর, ততদিন এইরকমভাবেই সবিশেষে তার পূজা হবে।
ওঁ স্বস্তি।

(সুজিত ঘোষ, সদস্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস)

সুজিত ঘোষ (Sujit Ghosh)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.